মুক্তাগাছায় মুক্তিযুদ্ধ : আমার ঠাকুরমা ও গরুর মাংস
মনোনেশ দাস
বাংলাদেশে পাক হানাদার ও তাদের দোষররা নির্বিচারে অগনিত মানুষকে হত্যা করে । মুক্তাগাছার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এর বর্ণনা দিয়ে কাঁদতেন আমার কর্তামা (দাদীমা) । ১৯৭১ সালে কর্তা সৌদামনী যামিনী দাস তার নির্মহ যন্ত্রনার বর্ণনা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠতেন । সেদিন ছিল রবিবার । পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোষরা পৌরসভাধীন মুজাটিস্থ আমাদের দাস বাড়ি থেকে আমার জেঠা পরেশ দাসকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে । ভাই শহীদ হয়েছেন এই খবর পেয়ে বাড়ির বাইরে অবস্থানরত আমার ধনজেঠা নরেশ দাস, রাঙ্গাজেঠা অমরেশ দাস ও আমার বাবা ভবেশ দাস আর বাড়িতে ফিরেন নাই । জেঠিরাও যার যার বাড়ি থেকে পালিয়ে বাপের বাড়ি চলে যান । বাড়িতে থাকা একমাত্র আমার কর্তাকেই প্রহড়া দিতে হয় । একদিকে পুত্রশোক অপরদিকে অপরাপর পুত্রদের অনুপস্থিতির কারণে পাগলপ্রায় হয়ে যান কর্তা । বাড়িতে একা পেয়ে রাজাকাররা ঠাকুরমার চুল কেটে ন্যাড়া করে দেয় । জোর পূর্বক গরুর মাংস খাওয়ায় । শাঁশিয়ে বলে বুড়ি গরু খা নইতে তোর বাকী পুত্রদের হত্যা করবো।
স্বাধীনতার ১৫ বছর পর তখন আমার বয়স ১০ বছর । কর্তা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, ভাই তুই আমার একটা গতি করিস । আমার মৃত্যুর পর তোর জেঠার পিন্ড দিন । ওর আত্নাকে শান্তি দিস । আর যদি সম্ভব হয় আমার আত্নার শান্তির জন্য প্রায়শ্চিত্য করিস । গরু খেলে হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়ে যায় । প্রায়শ্চিন্ত করলে পাপ মোচন হয়। আজ কর্তা নেই । রবিবার এলেই কর্তার কথা মনে পড়ে । তখন কাঁদি । আমাদের মুক্তিযদ্ধ ও স্ব্বাধীনতা হঠাৎ করেই অর্জিত হয়নি। দীর্ঘ ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সংগ্রামের ফসল আজকের এ স্ব্বাধীন বাংলাদেশ। পাকিস্তানি শোষক শ্রেণী আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য কোনকিছুই মেনে নিতে চায়নি। জাতিসত্তার স্ব্বীকৃতির পরিবর্তে মধ্যযুগীয় স্বৈ্বরতন্ত্র কায়েম করে শাসন শোষণের মাধ্যমে আমাদের সর্বস্ব্ব ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো আঁধারে পশ্চিমা হানাদার বাহিনী হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙালি জনগণের ওপর। যেমনিভাবে তারা ১৯৫২ সালে মুখ থেকে 'মা' ডাক কেড়ে নিতে চেয়েছিল। তখন বাঙালি সমাজ অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য রুখে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের চেতনায় এক মোহনায় এসে মিলিত হয়েছিল। আমাদের ভাইদের প্রতিরোধের আগুন জ্বলে ওঠেছিল দ্বিগুণ দারুন দ্রোহ প্রতিশোধে। রাজপথে জনপদে নিভৃত পল্লীর মাঠে প্রান্তরে জেগে উঠেছিল বিক্ষোভের ঢেউ। একইভাবে অর্জিত হয়েছে স্ব্বাধীনতা।
মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে অবুঝ শিশুর চোখ দিয়ে দেখা এক অস্থির ও বেদনার সময়। তেমন কিছুই মনে পড়ে না - শুধু দু'একটি করুণার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সন্তান হারানোর বেদনায় আমার পাগল প্রায় মা কেবলই এদিক সেদিক ছুটতেন। কোন এক মধ্যাহ্নে আমার জন্য খাবার তৈরি করতে চুলোয় উনুন ধরাতে যান তিনি, কোলের সন্তানের জন্য তার খাবার তৈরিও প্রায় শেষ। এমনি সময় মধ্যাহ্নের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে মিলিটারি হায়েনার গর্জে ওঠে। আমার বড় ভাই রেজাউল করিম জিন্নাহর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে নিমিষেই পুড়িয়ে দেয় আমার বাবা-মায়ের তিল তিল কষ্টে গড়া ঘর-দরজা। মাটিতে ভাতের হাঁড়ি পড়ে থাকে, এ দৃশ্য স্মৃতিতে একটু গেঁথে আছে। মা তার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের একটি ছুটকেস বাথরুমে লুকিয়ে রেখেছিলেন এই ভেবে যে সেখানে হযতো পাকহানাদারদের দল খোঁজ করবে না। কিন্তু হায়েনার দল সেখানে কাপড়চোপড় তছনছ করেছিল। এছাড়া মা এবং বড় ভাইবোনদের কাছ থেকে শুনে এবং নিজের মস্তিষ্কে গাঁথা নানা স্মৃতি চিহ্ন আচমকাই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আমার মা সন্তান হারানো ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার যন্ত্রণায় কিছুটা উদ্ভ্রান্ত হয়ে আগুনে পড়ে গিয়েছিলেন। এতে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে যায়। পাশেই আমার নানার বাড়ি।
উৎকণ্ঠিত অবস্থায় তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। নানার বাড়ির উঠোনে মাটিতে লুটোপুটি খেয়ে মা কেঁদেছেন অন্তর্জ্বালায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কোন এক দুপুরে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা আমাদের বাড়ির উঠান দিয়ে হাঁটছিল, আমি দৌড়ে তাদের দিকে যেতে চাই, এসব দৃশ্য একটু একটু মনে পড়ে। দেশ তখন স্ব্বাধীন হয়েছে। বাইরের উঠোনে বাবা জালাল উদ্দিন সরকার, বড় ভাই মোহাম্মদ আলী খসরু, নাজিম উদ্দিন মজনু ও কয়েকজন দিনমজুর নিয়ে পুড়ে যাওয়া ঘরের টিন খড় দিয়ে ঘসে পরিষ্কার করছিলেন। কোনো এক বিকেলে বাড়ির সঙ্গের ঈদগাহ মাঠে ঘর তৈরির জন্য আমার বাবা ঘর তৈরির জন্য কামলা খাটিয়ে বাঁশের খুঁটি বানাচ্ছিলেন। সামনে দিয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা গৌরা বাইদের ধানক্ষেতের দিকে রাইফেল নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। এসব দৃশ্য কিছুটা মনে পড়ে। পরবর্তীতে বড় ভাইয়ের কাছে শুনছি সেদিন স্থানীয় রাজাকারদের ধরে নিতে তারা মুক্তাগাছা থেকে এসেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আমার এটুকুই মনে পড়ে। আমার মা একজন মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে দেশমাতৃকার বিষয়টি অনেক হৃদয় যন্ত্রণার মাঝেও গভীরভাবে লালন করেন। মা আমাকে বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। প্রায়শই বাড়ির উত্তর পাশে সবুজ ধানক্ষেতের দিকে (গৌরা বাইদের) তাকিয়ে তার মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের প্রতীক্ষায় কালক্ষেপণ করতেন। আমার মা আমাকে কোলে নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতেন কখন তার হারানো সন্তান ঘরে ফিরবে। হঠাৎ একদিন একজন বোরকা পরিহিত লোক হাঁটতে হাঁটতে একেবারে আমার মায়ের কাছে চলে আসেন। হঠাৎ বোরকা খুলে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন। তিনি তার বীর মুক্তিযোদ্ধা বড় ছেলে রেজাউল করিম জিন্নাহ। অনেক দিন পর এসব স্মৃতি রোমন্থন করে মা কেঁদে ফেলেন। মা'র বয়স প্রায নব্বই বছর। তাই অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না। মনে করতে গেলেও যন্ত্রণায় কাতরে উঠেন। স্বাধীনতার পর কেটে গেছে অনেক বছর। আমি এখন যৌবনদীপ্ত এক পুরুষ। চারপাশে শুনি মুক্তিযুদ্ধের কত কথা কিন্তু কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল তা অাঁচ করতে পারি না।
স্ব্বাধীনতার সোনার হরিণ যেন ক্রমেই হয়ে ওঠে বর্ণহীন। লেখালেখি অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত তাই নিজের তাগিদেই জানার অনেক চেষ্টা। কী হয়েছিল সে দিনগুলোতে? মুক্তিযুদ্ধ কি লাখ লাখ মানুষের দৌড়ে চিৎকার করে মাঠে পথে ঘাটে নেমে আসা, নাকি দেশপ্রেমীদের ত্যাগ, বিদেশি শক্রদের নির্মম অত্যাচার, দেশি দালালদের ভয়াবহ নিষ্ঠুুরতা, বাংলার মা- বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন? সবই এখন আমি বুঝি, তবে আমার এ জানা শুধু লোকমুখে, বই পড়ে। তাই অনেকের কাছে ছুটে যাই মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব চিত্র শুনে হৃদয়ে উপলব্ধির জন্য। নানাজনের কাছে নানা কথা শুনে বিমূর্ত ও বিমূঢ় হয়ে উঠি। আমার মা ছখিরন নেছা একজন মুক্তিযোদ্ধা জননী। যিনি আমাকেও গর্ভে ধারণ করেছেন এবং সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সযত্নে লালন করে পৃথিবীর বুকে তিল তিল করে মানুষ করেছেন। তার কাছেই আমি প্রথম জানতে চেয়েছি এবং জেনেছি মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ সম্পর্কে। বয়সের ভারে মার স্মৃতিশক্তিও লোপ পেয়েছে। সবকিছু মনে করতে পারেন না। আবার কখনো বা ইচ্ছে করেই কষ্টের স্মৃতি মনে করতে চান না। একান্তই আমার অনুরোধে ''কি অইব হেইসব কথা মনে কইরা, খালি খালি কষ্ট পাওনের কাম কি পিছনের কথা টাইনা। তারপর তিনি বলেন- বেশ কিছুদিন যাবৎই দেশময় অশান্ত হাওয়া বইছিল।
দেশ স্ব্বাধীন করার গুঞ্জন চারদিকে। অনেকেই দলে দলে ভাগ অইয়া কানাঘুসা করে। ঢাকায় নাকি গ-গোল শুরু অইছে। আস্তে আস্তে এই গ-গোল এই দিকেও নাকি ছড়াই পড়ব। সত্যি সত্যিই এই গ-গোল আমাগো এই দিকেও ছড়াইয়া পড়ল। গ্রামেগঞ্জে মিলিটারিরা আইতে শুরু করে। তারা লুটপাট করতে থাকে এবং জোয়ান ছেলেমেয়েদের ধইরা নিয়া যায়। মিলিটারিগো ঠেকানো এবং দেশ স্ব্বাধীনের লাইগ্যা সবাই মিলে তখন গ্রামে গ্রামে মুক্তিফৌজ গঠন করে। হঠাৎ একদিন দেহি আমার বড় ছেলে জিন্নাহ নাই। তখন আমি আগল পাগল অইয়া ঘুইরা বেড়াইছি। আমার তিন মেয়ের পর আল্লায় আমারে এই ছেলে দিছিল। তাই ছেলে হারাইয়া আমি খাওয়া-দাওয়া সব ভুইল্ল্যা কেমন অইয়া গেছিলাম তা বুঝাবার পারমু না। কয়েকদিন পর হঠাৎ একদিন জিন্নাহ বাড়িতে আসে। ছেলেকে কাছে পেয়ে আমি বাড়িঘর সবকিছুর কথা ভুলে যাই। তাকে ধান-চাউলের গোলা ঘরে লুকিয়ে রেখে খাবার দিতাম। মনে মনে তৃপ্তি অনুভব করতাম আমার সন্তান আমার বুকের কাছেই আছে। সে এটা-ওটা খেতে চায়। সন্তানের তৃষ্ণা মিটাতে আমার স্ব্বামী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছেলের সাধ পূরণ করে। তারপর হঠাৎ একদিন সে আবার যুদ্ধে চলে যায়। একদিন প্রচন্ড গোলাগুলি, জিন্নাহ তখন বাড়ির পেছনে গৌরা বাইদের ধানক্ষেতের মধ্যে শুয়েছিল। সবাই আমাকে টেনে বাড়ির মাঝে নিতে চাইছে আমি আমার ছেলেকে রেখে বাড়ির ভেতরে যেতে পারছিলাম না। আমার কোলের শিশু তুহিন একদিন খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছিল তার খাওন তৈয়ার করতে রান্নাঘরে যেতেই বাড়ির পাশে স্কুলের ওখানে গুলির শব্দ শুনতে পাই। মিলিটারিরা তখন সাহা পাড়ায় আগুন দিয়ে এই দিকে আইতাছিল। সাহাপাড়া থেকে তিনজন হিন্দুু ধইরা আইন্যা স্কুলের পেছনে ঈদগাহ মাঠে শোইয়ে গুলি করে হত্যা করে। তারপরই আমার ঘরে এসে আগুন দেয়। তখন তুহিনের কান্না থাইমা যায়।
এক পর্যায়ে আমি দিশাহারা হয়ে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ায় শুধু আমার ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। ঘর-দরজা পুড়ে যাওয়ার পর স্ব্বামী-সন্তান নিয়ে পথে-ঘাটে ঘুরে ফিরেছি। আমার স্ব্বামী শীতের রাতে খালি শরীরে সারারাত কাটিয়েছে। খেয়ে না খেয়ে দিন কেটেছে। প্রহর গুনেছি কখন দেশ মুক্ত হবে। হঠাৎ একদিন জিন্নাহ বোরকা পড়ে পুড়ে যাওয়া বাড়িঘর দেখতে আসে তখন তাকে কইছিলাম আমার ঘর-দরজা পোড়াতে পিঠ পুড়েছে বুক পুড়েনি। তোমরা বেঁচে থাকলে আবার আমার সব হবে। আমার আশা ছিল আমার বড় ছেলে জিন্নাহ সংসারের সবকিছু আগলে ধরে রাখবে কিন্তু এত দিন পর আমি কি পেয়েছি? ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকেই বা কি পেলাম? তারপরও দেশ স্ব্বাধীন অইছে এটাই শান্তি।" বাবা জালাল উদ্দিন সরকার মুক্তিযুদ্ধের সরব সাক্ষী ছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, তিনি ৩০ আগস্ট ২০০০ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তার দুই চোখে দেখা নানা স্মৃতি ও ঘটনা জেনে রাখতে পারিনি। স্বীয় মুক্তিযোদ্ধা বড় ভাই রেজাউল করিম জিন্নাহ যুদ্ধে যাওয়ায় আমরা হারিয়েছি আমাদের বাড়িঘর। আমার মা আগুনে পুড়ে যাওয়ায় এখনও সংজ্ঞাহীন রোগে ভুগছেন, শরীওে পোড়া দাগ। নিজের অজান্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। হয়তো দেশমাতৃকা ও সন্তানের নানা স্মৃতি মনে করেই তার এসব বেদনা। জানি না আমার বড় ভাই আমাদের প্রিয় মাকে কিভাবে সান্ত্বত্মনা দেন? তার প্রতি কতটুকু দায়িত্ব পালন করেছেন বা মায়ের কষ্ট কতটুকু লাঘব করেছেন? অনেকেই আমার বড় ভাইকে সম্পদ হারানোর বেদনায় দোষারোপ করেন। কিছু ক্ষতি হয়েছে ঠিকই কিন্তু আমরা পেয়েছি একটি স্ব্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের অহংকার। বড় বোন তাহমিনা সুলতানা মিনুর কাছ খেকে শুনেছি বড় ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় একাত্তরের দিনগুলি ছিল আমাদের জন্য আরও দুর্যোপূর্ণ ও বিভীষিকাময়।
মৌসুম আমার মা তার সন্তান হারিয়ে সব সময় বাবাকে বিরক্ত করতেন সন্তানকে বুকে এনে দেয়ার জন্য। প্রচ- বর্ষা সত্ত্বেও বাবা প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে পড়তেন সন্তানের খোঁজে। ত্রিশ থেকে চলি্লশ মাইল পথ সাইকেল চালিয়ে সন্ধ্যায় ফিরতেন শূন্য হাতে। একদিন বাবা অল্পের জন্য রাজাকারদের কবল থেকে প্রাণে বেঁচে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু কি পেয়েছেন বাবা? আমাদের পাশেই হিন্দুপাড়া। পাক হানাদাররা হিন্দু বাড়ি পুরিয়ে যাওয়ার সময় যদুনাথ সাহা ও তার সন্তান প্রাণনাথ সাহাকে আমাদের ঈদগাঁ মাঠে শুইয়ে গুলি করে হত্যা করে। পিতা-পুত্র জল জল করে পাখির মতো হাত-পা ঝাপটাচ্ছিল। সেই হিন্দুু মহিলা পুকুর থেকে অাঁচল ভিজিয়ে একবার সন্তানের মুখে আরেকবার স্ব্বামীর মুখে পানি দিচ্ছিলেন। সে স্মৃতি মনে করলেই শরীর শিউরে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে অনেকেই হারিয়েছেন তাদের বাবা-মা, ভাই-বোনকে। মা-বাবা হারিয়েছেন সন্তানকে, স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামীকে। তাদের বেদনাহত, ভয়ার্ত, হৃদয়ের যন্ত্রণা কত কঠিন তা কেবল তারাই অনুভব করতে পারেন। আমরা হারিয়েছি আমাদের সোনার মানুষদের।
ধ্বংস, লুটপাট, ধর্ষণ, খুন এসব ক্ষতি আমরা কি করে ভুলে যাই। লাখ লাখ নারী যে নির্মম পাশবিক নির্যাতন সহ্য করেছে, মা তার সন্তান হারিয়ে বুকে বুলেটবিদ্ধ হয়েছেন। আমার অনেক বন্ধুু-বান্ধব, পিতা-মাতা হারানোর কষ্ট পেয়ে এখনও চলে নীরবে। তারপরও সামনে এগিয়ে যায় একে অন্যের হাত ধরে। তাদের সান্ত্বত্মনা দেয়ার দুঃসাহস আমার হয় না। ওদের যন্ত্রণাকে শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগের জাতীয় স্বীকৃতি, সন্তান হারানো পিতামাতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও সাহায্যে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন কার্যকরী ভূমিকা। ১০৭১ সালে বৃহৎ কর্ম মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বিশাল অর্জন স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা ইতিহাসের বুক জুড়ে বিস্তৃত বাঙালির আত্মত্যাগের স্বর্ণোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
২৫ মার্চ কাল রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে ঢাকায় ঘুমন্ত মানুষের ওপর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের মধ্যদিয়ে শুরু হওয়া পাকিস্তান বাহিনীর বর্বর নির্যাতন ক্রমেই বিস্তার লাভ করতে থাকে। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগ, গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, এমন কোন হীন কর্ম নেই যা মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে নয় মাসে বাঙালির ভাই দাবিদার পাকিস্তানিদের দ্বারা পদ্মা মেঘনা যমুনা বিধৌত বঙ্গীয় ব-দ্বীপে সংগঠিত হয়নি। শহর থেকে গ্রাম, অফিস থেকে ঘর-বাড়ি, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, স্কুল, কলেজ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ কিলোমিটারে এমন কোন স্থান বাদ ছিল না যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালায়নি। শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-যুবা এক কথায় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার ওপর নির্যাতনের খড়গ চলে নির্বিচারে। নয় মাসে শহীদ হন ৩০ লাখ বাঙালি, সম্ভ্রম হারান ২ লাখ নারী। পুরোপুরি বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয় বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা। ধ্বংসের তা-বলীলা থেকে বাদ যায়নি দূরের জনপদ মুক্তাগাছাও।
২৩ এপ্রিল থেকে সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতির জনপদ মুক্তাগাছায় শুরু হয় বর্বরতা। এদিন সুসজ্জিত কনভয় বহর থেকে অনবরত গুলি করতে করতে জামালপুর হয়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে মুক্তাগাছা দখল করে নেয় পাকবাহিনী। শুরুতেই শহরের বিভিন্ন স্থানে লুটপাট চালায় এবং বাড়ি ঘরে অগি্নসংযোগ করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। দখলদারদের এলোপাতাড়ি গুলিতে এদিন লক্ষ্মীখোলার মনিরুদ্দিন, টানবাজারের অমিয়বালা সাহা, সুরেন্দ্র চন্দ্র শেখসহ অনেকেই শহীদ হন। ২৫ এপ্রিল দালাল চক্রের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে ভারত চলে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা শিশির কুমার রক্ষিতের মুজাটির গ্রামের বাড়িতে হামলা চালায়। তাকে না পেয়ে রক্ষিত বাড়িসহ আশপাশের বাড়িঘরে লুটতরাজ ও অগি্নসংযোগ করে তার অসুস্থ ভাই সুবোধ চন্দ্র রক্ষিতসহ ছয়জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে পরেশ দাস, ব্রজেন দাস, হরিদাস বৈরাগী ও বসুয়াকে গুলি করে হত্যা করে। সুবোধ রক্ষিতকে ধনবাড়ি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ২-৩ দিন নির্মম নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে।
মেকানিক দীনেশ ভাট্টকে সে ক্যাম্পে আটকে রেখে তাদের গাড়ি মেরামতের কাজে লাগিয়ে দেয়। কিছুদিন পর দীনেশ ভাট্ট সেখান থেকে সুযোগ মতো পালিয়ে বাঁচে। ২৮ এপ্রিল রাতের গভীরে স্থানীয় সহযোগিদের নিয়ে পাকিস্তনি বাহিনীর একটি দল মুজাটি গ্রামের শ্রীশ চন্দ্র দের বাড়িতে হামলা করে মালপত্র লুটপাট করে। গুলি করে হত্যা করে শ্রীশ চন্দ্র দে ও তার পুত্র রবি চন্দ্র দেকে। গুলি লেগে শ্রীশ চন্দ্রদের স্ত্রী, কন্যা, ভাইসহ কয়েকজন আহত হন। মে মাসের ১৩ তারিখ পাকবাহিনী মুক্তাগাছার বেশ কয়েকটি এলাকায় হামলা চালায়। এদিন শহর থেকে মিজুরিয়া হরিজনকে তুলে নিয়ে যায়। বিকেলে পাথালিয়া গ্রামের ব্রজগোপাল দত্তের বাড়িতে হামলা চালিয়ে মুক্তাগাছা পৌরসভার সচিব তৈলোক্য বাবু ও তার দেহরক্ষীকে ধরে নিয়ে যায় এবং বাড়িতে লুটপাট শেষে আগুন ধারিয়ে দেয়। একই দিন গাবতলীর ব্যবসায়ী নুকুল চন্দ্র দেকে বাড়ি থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়।
২৩ মে স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় দখলদার বাহিনী মুক্তাগাছা শহরের পার্শ্ববর্তী শ্রীপুরমাইজহাটি ও মুজাটি গ্রামে আক্রমণ চালায়। সেখানে দাসবাড়িতে ময়মনসিংহ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধরে আনা পাঁচ যুবককে হাত-পা বেঁধে একটি ঘরে ঢুকিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে হত্যা করে। মে মাসের শেষের দিকে বিলসিংলা (গোয়ারী) গ্রামের দেব বাড়িতে পাকবাহিনী হামলা চালিয়ে লুটপাট শেষে অগি্নসংযোগ করে। জুলাই মাসে হানাদার বাহিনী পুনরায় মুজাটি ভাট্ট বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগি্নসংযোগ করে। সেখান থেকে মোটর মেকানিক দীনেশ ভাট ও যতীন ভাটকে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে গুলি ও পরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। এর কয়েকদিন পর কালিবাড়ি বাস স্ট্যান্ডের কাছে সুবোধ চন্দ্রের বাড়ি, গাবতলীর জহর উদ্দিন সরকারের (জহর সরকার) বাড়িসহ কালাঘোগা গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগি্নসংযোগ করে। এদিন কালাঘোগার কুমুদ বাবু ও দামু বাবুকে পাকিস্তান আর্মি গুলি করে ও বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে। ১৯৭১-এর ২ আগস্ট সোমবার তথাকথিত দুষ্কৃতকারী (মুক্তিযোদ্ধা) নিধনের নামে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গে নিয়ে সকাল থেকে মুক্তাগাছা-জামালপুর রাস্তার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে দুই শতাধিক রাজাকার, আলবদর অংশ নেয় বলে জানা যায়।
এ সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আলবদর বাহিনীর প্রধান কামারুজ্জামান মুক্তাগাছা বড় মসজিদসংলগ্ন আলবদর ক্যাম্পে উপস্থিত থেকে সব তদারকি করেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। হত্যাযজ্ঞে তার নিয়ন্ত্রণাধীন জামালপুরের কামাল খান মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররাও অংশ নেয়। ঘাতকরা মানকোন, বিনোদবাড়ি, বাজেমানকোন, দড়িকৃঞ্চপুর, কাতলসার, মির্জাকান্দা, বুনবাড়ি, কেজাইকান্দা, সুবর্ণখিলা, শিবপুর, মোগলটুলাসহ ১০-১২টি গ্রামে বৃষ্টির মতো গুলি, অগি্নসংযোগ ও লুটপাট চালিয়ে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায়। দিনব্যাপী এ উন্মত্ততায় নারী-শিশুসহ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে ৩ শতাধিক নিরীহ মানুষ নির্মম গণহত্যার শিকার হন। আহত অবস্থায় পালিয়ে বাঁচে ২ শতাধিক লোক। নির্বিচারে হত্যা, অগি্নসংযোগ, ধর্ষণ ও অবাধ লুটপাটে মুহূর্তে তছনছ হয়ে যায় ১০-১২টি গ্রাম। শতশত ঘর বাড়ি পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় ঘাতকেরা। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় পুরো এলাকা। সেদিনের সেই ভয়ংকর স্মৃতিস্মরণে আজও আঁতকে উঠেন এলাকার মানুষ। ঘাতকদের টার্গেট ছিল এলাকার হিন্দু পরিবার, আওয়ামী লীগ কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোকে ধ্বংস করে পুরো এলাকায় ভীতি সঞ্চার করা। চোখের সামনে স্বামী, সন্তান, দেবরসহ ১৭ জনের নির্মম মৃত্যু দেখে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়েও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান নুরবানু (৭৬)।
বাজেমানকোন গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী হাজের মন্ডলের বাড়িতে নারী-শিশুসহ ১৮ জন লোককে হত্যা করে ঘাতকরা মন্ডলের বংশ উজাড় করে দেয়। ভাইস্যা বিলে রাজাকার আলবদররা একত্রে দাঁড় করিয়ে ২৮ জন লোককে হত্যা করে। দড়িকৃষ্ণপুরের দালাল আলী আকবর মুক্তার এলাকার ভয়ার্ত মানুষকে বাঁচানোর নামে নিজ ঘরে ডেকে এনে আটকিয়ে রেখে ঘাতকদের খবর দিয়ে এনে ১৭ জনকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করায়। কাতলসার উত্তরপাড়া গ্রামে ঘাতকরা ১৪ জনকে হত্যা করে। কেজাইকান্দা গ্রামের ১৩ জন কৃষককে জামালপুরের কামাল খান মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা মিলে পাক আর্মিকে সঙ্গে নিয়ে হত্যা করে।
এদিন নৃশংস গণহত্যার শিকার সাধারণ মানুষদের একটি তালিকা (অসম্পূর্ণ) এখানে তুলে ধরা হলো। সর্ব শহীদ জীতেন্দ্র প্রসাদ ঠাকুর (৬০), পিতা-গিরীজা প্রসাদ ঠাকুর, দিলীপ কুমার ঠাকুর (২৪) পিতা- জীতেন্দ্র প্রসাদ ঠাকুর, নারায়ণ কুমার দে তারেন (৩০) পিতা- গোপাল চন্দ্র দে, যতীন্দ্র মোহন রায় (৬০), পিতা- শশী মোহন রায়, হাজী মহর আলী (৬৫) পিতা-গহর আলী, খালেতন নেছা (৪৫) স্বামী-হাজর আলী মন্ডল, রহিমন নেছা (৫০) স্বামী-হাজর আলী মন্ড, হামিদা খাতুন (৪) পিতা-হাজর আলী মন্ডল, জয়গন নেছা (৪০) স্বামী-নজর আলী, মালেকা খাতুন (৩০) স্বামী- শামসুল হক, ফেরদৌসী (০৫) পিতা-শামছুল হক, জুলেখা খাতুন (০২) পিতা শামছুল হক, কুবেদ আলী (২৫) পিতা- ছাবেদ আলী, জহুর আলী (৪৫) পিতা- জমির মন্ডল, সখিনা খাতুন (৩৫), স্বামী মহর আলী, নজরুল ইসলাম (০২) পিতা- মহর আলী, বিবি হাওয়া (০৪) পিতা- মহর আলী, সুরুজা খাতুন (০৮) পিতা আজগর আলী, সখিনা খাতুন (৪০) স্বামী- ফজর আলী।
উপরের সবাই বিনোদবাড়ি-মানকোন গ্রামের নিরীহ জনগণ। আ. রহমান চিনু মিস্ত্রি (৫০) পিতা- সিরাজুল ইসলাম, হাজেরা খাতুন (৪৫) স্বামী-জাহদে আলী মন্ডল, কুমেদ আলী কুমু (৩৫) পিতা-ছাবেদ আলী, ইউসুব আলী (৩০) পিতা-ইন্তাজ আলী, ইসমাইল হোসেন (২৮) পিতা- ইন্তাজ আলী, খস্তর আলী (৪০) পিতা- ইন্তাজ আলী, জাফর আলী শেখ (৫০) পিতা- ঘেরু শেখ, আজগর আলী (৫০) পিতা-ওমার আলী শেখ, উসমান আলী (২৫) পিতা-আজগর আলী এরা ঘাটুরি গ্রামের বাসিন্দা। শামছুল হক (৩০) পিতা- ময়েজ উদ্দিন গ্রাম-শিবপুর, রহমত আলী (৪০) পিতা-গুল মাহমুদ মন্ডল, হোসেন আলী (৫০) পিতা উসমান সরকার, আবদুল খালেক (৪৫) পিতা-উসমান সরকার, আবদুল মজিদ (৪৫) পিতা-নাজিরা শেখ, আবদুর রাজ্জাক (০৬) পিতা-জাহেদ আলী, জোৎস্না বেগম (০৮) পিতা- জাহেদ আলী, আ. মোতালেব (৩৫) পিতা- গুল মাহমুদ মন্ডল, রেজিয়া বেগম (২০) পিতা- আ. খালেক, আম্বিয়া খাতুন (০২) পিতা- আ. খালেক, মানিকজান (৫০) স্বামী- আজগর আলী মন্ডল, ময়না বেগম (৫০) স্বামী- ইয়ার মাহমুদ, আসাদ আলী (৬০) পিতা- লাল মামুদ, হযরত আলী (১৮) পিতা- আসর আলী, হাসিনা বানু (৭০) স্বামী-শের মাহমুদ মুন্সি, দিলজান বিবি (৩৫) স্বামী-আ. গণি মন্ডল, হাজেরা খাতুন (০২) পিতা- আ. গণি মন্ডল, নিতাই (২২) পিতা-হডু মালী, রানী (১২) পিতা- হডু মালী, হাজেরা খাতুন (৪৫) স্বামী-মুনছুর আলী, ফিরোজা খাতুন (০৩) পিতা-মুনছুর আলী, বানেছা খাতুন (২০) (৯ মাসের গর্ভবতী ছিলেন) স্বামী- আহেদ আলী, ছমেদ আলী (৫০) পিতা-জাল মামুদ মন্ডল, ছফুরণ নেছা (৪০) স্বামী- ছমেদ আলী, দিলোয়ারা খাতুন (০৭) পিতা- ছমেদ আলী, ইয়াদ আলী (৬০) পিতা- কবির মন্ডল, নজিব উদ্দিন (৬০) পিতা- আবি শেখ, আমেনা খাতুন (৪৫) স্বামী-নজিব উদ্দিন, হাবিবুর রহমান (০৬) পিতা-ইমান আলী ক্বারী, আমিরজান (৬৫) স্বামী- ইব্রাহিম মুন্সী, এরা দরিকৃঞ্চপুর গ্রামের সাধারণ জনতা। রজব আলী (৫০) পিতা- নছিমদ্দিন, আবেদ আলী (৪৮) পিতা-নছিমদ্দিন, আহাদ আলী (৫০) পিতা- শুকুর আলী, রাজ মামুদ (৪৫), পিতা-আবদুুল আলী, হাছেন আলী (৬৫) পিতা আজিম উদ্দিন, সাহাব আলী (৪৫) পিতা-হাসেন আলী, কুমেদ আলী (১৮) পিতা- হাসেন আলী, শাহেদ আলী ম-ল (৭০) পিতা- আয়েন ম-ল, জবেদ আলী (৪০) পিতা-শাহেদ আলী, মনির উদ্দিন (৪২) পিতা- আয়েদ আলী মুন্সি, মেহের আলী ম-ল (৬০) পিতা- চামারি ম-ল, কানু মন্ডল (৬৫) পিতা- মন্তি মন্ডল, খোরশেদ আলী (৪০) পিতা-সফর আলী ম-ল, মন্নেছ আলী (৩৫) পিতা- সিরাজ আলী এরা সবাই কাতলসার উত্তরপাড়া গ্রামের। এদের ধরে কয়াবিলের মাঝখানে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে একই সঙ্গে ২২ জনকে হত্যা করে। ফনীন্দ্র চন্দ্র দে (৪০) পিতা- কৃঞ্চ চরণ দে, সুধীর চন্দ্র দে (৫০) পিতা- শশী মোহন দে, সরেন্দ্র চন্দ্র সরকার (২৫) পিতা- বিরেন্দ্র নাথ রায়, ইন্দ্র বালা দেবী (৫০) স্বামী-জয় চন্দ্র দে, জয়নাল খান (৭০) পিতা- আলামিয়া খান, আ. রহিম (রহিম পাগলা) (৩৫) পিতা-অজ্ঞাত এদের বাড়ি বাজে মানকোন গ্রামে। হানিফ শেখ (৫৫) পিতা-মামদি শেখ, আইজ উদ্দিন মুন্সী (৫০) পিতা- মইন উদ্দিন সরকার, জহুর আলী (৭০) পিতা- আইন উদ্দিন এরা কেজাই কান্দা গ্রামের নিরিহ জনতা। বিল্লাল উদ্দিন (৫০) পিতা_ জইমদ্দিন, আ. জলিল জলি (৪০) পিতা- শরতুল্লাহ, গ্রাম- সুবর্ণখিলা, সমেদ আলী (৪৫) পিতা- মুন্তাজ আলী গ্রাম- কোনাগাঁও, আহমত আলী (২৫) পিতা- আফর আলী, গ্রাম- সুবর্ণখিলা, রঘুপোদ্দার (৭০) পিতা- অজ্ঞাত, গ্রাম- বড়গ্রাম।
এদিন ১০-১২টি গ্রাম তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে দিনব্যাপী হত্যাযজ্ঞ চালায়। এলাকায় দালালদের কয়েকটি বাড়ি ছাড়া সব ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। আশ্বিন মাসের ২৪-২৫ তারিখ ভোর রাতে শশাঁ গ্রামের অভিমন্যু দাস উকিলের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ২০-২২ জনকে ধরে ফেলে। আশপাশের বিভিন্ন বাড়ি থেকে আরও কয়েকজনকে ধরে এনে সেখানে তাদের লাইনে দাঁড় কারিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তাদের কোন সৎকার করা হয়নি। একটি ক্ষেতের মাঝে গর্ত করে লাশগুলো পুঁতে রাখা হয়। সেখানে গণহত্যার শিকারদের একটি তালিকা নিম্নরূপ_ পূর্ণ চন্দ্র দে (৩০) পিতা-ভূপেন্দ্র চন্দ্র দে, চন্দন কুমার দেব (২০) পিতা- রমনী মোহন দেব, চিত্তরঞ্জন নন্দী (২৩) পিতা- জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র নন্দী, মনোরঞ্জন দে (২৫) পিতা_ অজ্ঞাত, বসন্ত কুমার দাস (৪০) পিতা- নীলকমল দাস, জীতেন্দ্র সাহা (৩৮) পিতা- কাশি সাহা, রমেশ চন্দ্র সাহা (৪৫) পিতা- রসিক সাহা, মহিম চন্দ্র সাহা (৩৫) পিতা-অজ্ঞাত, যোগেশ চন্দ্র আচার্য (৬০) পিতা- ওমেশ চন্দ্র আচার্য, অবনী কান্ত আচার্য (২৫) পিতা- যোগেশ চন্দ্র আচার্য, অভিমন্যু দাস উকিল (৬৫) পিতা- রাজ চন্দ্র দাস, ডা. সুপ্রিয় দাস (২৫) পিতা-অভিমন্যু দাস উকিল, হরিপদ হংস ( ৪০) পিতা- হরেন্দ্র চন্দ্র হংস হরেন্দ্র মাস্টার, গোবিন্দ চন্দ্র সাহা (৭০) পিতা- জগত কুমার সাহা ঠিকানা- শশালক্ষ্মিপুর, মকবুল হোসেন (২৮) পিতা- জইমদ্দিন ঠিকানা-শশা কান্দাপাড়া, প্রেমাদা সুন্দরী সাহা (৭২) স্বামী- বসন্ত কুমার সাহা, গ্রাম শশাঁ-কাশির বাজার।
যে জমিতে গণকবরটি অবস্থিত ১৯৭৫ পরবর্তীতে সে জমির মালিক হিন্দু ভদ্রলোক জমি রেখে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকায় এখন গণকবরের অনেকাংশ বেদখল হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার-দাবারসহ নানাভাবে সহযোগিতা করার অপরাধে দাওগাঁও ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামের বৃদ্ধ হাজী কাসেম আলীকে নির্মম নির্যাতন শেষে মাথা মাটিতে ঠেকিয়ে পায়ুপথে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। সেই সঙ্গে সেখানে মহেশপুর গ্রামের আলী মদ্দিন পিতা- খামজি আকন্দ, আক্কাস আলী পিতা- নিয়ত আলী, সাহেদ আলী পিতা- জমির শেখ ও কমলাপুর গ্রামের নফা মিয়া নফা পাগলা পিতা-আজগর আলীকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। শেষে এলাকার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। বনবাংলা গ্রামের সন্তোষ চন্দ্র ধর ও জগদীস চন্দ্র সংস্কৃতিমনা গ্রাম্য সরল দুই হিন্দু ভদ্রলোক মুসলিম লীগ নেতা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার তথাকথিত সাক্ষী কুখ্যাত রাজাকার কেরামত আলী তালুকদারের কথা অমান্য করে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার অপরাধে রাজাকাররা তাদের ধরে স্থানীয় বিজয়পুর বাজারের নিয়ে বেঁধে রাখে। পরে সেখানে বেস্নড ও কাস্তে দিয়ে একটু একটু করে তাদের শরীর কেঁটে সেখানে লবণ ও শুকনো মরিচ লাগিয়ে দিতে থাকে ঘাতকের দল। তাদের কান্নায় আকাশ ভারি হয়ে উঠতে চাইলে তা অট্টহাসিতে বিলীন করে দেয়ার জঘন্য কান্ডে মেতে উঠে ঘাতক দালাল চক্র। আশপাশের লোকজনকে ডেকে সে দৃশ্য অবলোকনে বাধ্যও করানো হয়। এক পর্যায়ে দেহ নিথর হয়ে পড়লে অনেকটা নিষ্প্রাণ দেহেই ব্রাশফায়ার করে মৃত পশুর মতো ক্ষেতের কোণে লাশ ফেলে রেখে যায় ঘাতকের দল।
১৩ মে তারিখে মুক্তাগাছার শেষ জমিদার বকুল আচার্য চৌধুরী (৬৫) পিতা-বিনায়ক আচার্য চৌধুরী ও তার কর্মচারী অমর বাহাদুর রানা (৬০) পিতা- জয় বাহাদুর রানাকে রাজাকার আব্দুল হেকিম শেখ ও সুরুজ্জামান ওরফে সুরত চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে আটানী বাজারে তৈলক্যনাথ সরকার (৬০), মিজরিয়া হরিজন (৪৫), ভারতী রানী ঘোষ (৬০) স্বামী- সতীশ চন্দ্র ঘোষ, তারাটি তেরিপাড়ার কানু দেব, বনবিহারী দে (৫৪), কুমুদ কান্ত ধর, ভরত রাজভর (৪৫), মুজাটির দীনেশ চন্দ্র ভাট (৬০), চৌরঙ্গী মোড়ের যতীন্দ্র চন্দ্র মোদক (৪০), শ্রীপুর মাইজহাটির গজেন্দ্র নারায়ণ দাস (৪৫) পিতা- অমৃত নারায়ণ দাস, আবুবকর সিদ্দিক, টানবাজারের অমর চন্দ্র পাল দাগু (৩৫) পিতা- মনীন্দ্র চন্দ্র পাল, ফনীন্দ্র চন্দ্র পাল (৪০) পিতা- মনীন্দ্র চন্দ্র পাল, তারাটি গ্রামের মো. আইন উদ্দিন ও কাজিমদ্দিন, জয়দা গ্রামের জীতেন্দ্র চন্দ্র দে হামালু পিতা কেতন দে, রায়মোহন কর্মকার (৩৮) ও জগমোহন কর্মকার (৪০), ঈশ্বগ্রামের দীন দয়াল দাস (৭০) তার দুই ছেলে দীনেন্দ্র চন্দ্র দাস (২৮) ও বীরেন্দ্র চন্দ্র দাস (২৩), বড়গ্রামের ডা. অনিল চন্দ্র বণিক (৫০) ও দুর্গাচরণ পোদ্দার (৭০) পিতা- শিবচরণ পোদ্দার, কান্দাপাড়া গ্রামের আন্নেছ আলী (২০) পিতা হাছেন আলী, ছয়রন বেগম স্বামী বগু শেখ, মদনপুরের তোরাব আলী (৫০) ও তার ছেলে ওসমান আলী (২৫), ময়দান আলী (২০), নছি শেখ (২৫), বলরামপুরের জিনমুন্সি, কুড়িপাড়া গ্রামের মুকুর চন্দ্র দে (২৫), নন্দী বাড়ির কাশেম আলী মাস্টার (৪২), সত্রাসিয়ার আ. সাত্তার (৪০), পিতা- হাসেন আলী, পাইকাশিমুলের মনসুর আলী (৪০) পিতা-কলিম মন্ডল, বাদে কলমোহনার ফজলুল হক (২৫), ফয়েজ উদ্দিন (৫০) পিতা সিরাজ শেখ, কাউডাঙ্গার চরের কার্তিক ঠাকুর পিতা- শ্রীনাথ ঠাকুর, সৈয়দ গ্রামের জয়নাল আবেদীন মাস্টার, গোয়ালগাতির আব্দুল আজিজ পিতা- জাফর আলী মন্ডল, বিলসিংলা গ্রামের নারায়ণ দে পিতা- রজনী কান্ত দে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হন। এভাবে ২৩ এপ্রিল থেকে ১০ ডিসেম্বর দখলদার পাকবাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদরদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তাগাছার বিভিন্ন এলাকায় নৃশংস কায়দায় নির্বিচারে হত্যা, গণহত্যা চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। শহরের অদূরে বেগুনবাড়ি রাস্তার পাশে আয়মন নদীর তীরে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরা আনা বহু বাঙালিকে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয়।
পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির পুরাতন ইদারাটি (কূপ) ছিল গণহত্যার এক রাজসাক্ষী। নারী, পুরুষ, ধনী, গরিব সব শ্রেণীর মানুষকে হত্যার পর ঘাতকরা লাশগুলো সেই ইদারায় ফেলে দিত। অসংখ্য শহীদের লাশে ভরা বিরাট ইদারাটির এখন আর চিহ্ন মাত্র নেই। বর্তমানে সেখানে আর্ম পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদর দফতরের গাড়ি রাখার গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়কের পাশে বানারপাড় নামক স্থানে বানার নদীতে বহু মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী লাশ ফেলে রাখে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দখলদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকার, আলবদর, আল-শামস, দালালদের সহযোগিতায় চালানো নির্যাতনে মুক্তাগাছার প্রায় সহস্রাধিক নিরীহ মানুষকে শহীদ হতে হয়েছে। সেখানেই শেষ নয় রক্তে কেনা স্বাধীন দেশেও স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে এসব শহীদ পরিবারকে। পঁচাত্তর পরবর্তীতে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদর চক্রের দ্বারা বড়গ্রাম গণহত্যার শিকার শহীদ পরিবারসহ অনেক শহীদ পরিবারকে হামলা, মামলা, জমি বেদখলসহ নানা হয়রানিতে পড়তে হয়েছে। স্বাধীনতার দীর্ঘদিনেও এসব শহীদ পরিবারের খোঁজ কেউ নেয়নি। এসব শহীদদের ভাগ্যে রাষ্ট্রীয় কোন স্বীকৃতিও মেলেনি। বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি দানে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে এসব শহীদ পরিবারের সদস্যরা তাদের শহীদদেরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানান। প্রকৃতির নিয়মে নদীর এক কূল ভেঙ্গে আরেক কূল গড়লেও কিছু কিছু নদী শুকিয়ে গিয়ে সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের তেমনি এক শাখা নদী শিরোখালি।
ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার বিভিন্ন জনপদের মাঝ দিয়ে প্রবাহমান এ নদী। ব্রহ্মপুত্রের জীবন যৌবন শুকিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাখা নদীগুলোর অবস্থা মরণাপন্ন। এক সময় শিরোখালি নদীকে কেন্দ্র করে নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছিল জনপদ, হাটবাজার, উপশহর, জমিদার বাড়িসহ নানা কিছু। এ নদী তীরের এক উল্লেখযোগ্য জনপদ রৌয়ারচর। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার মশিউরনগর রেল স্টেশনের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র থেকে এ নদী উৎপত্তি লাভ করে অত্র অঞ্চলের নিমতলা, খামারের বাজার, কলাকান্দা, চন্দবাড়ী, মৈশাদিয়া, রৌয়ারচর, তারাটি, মুজাটি হয়ে মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির তথা শহরের পেছন দিক দিয়ে বয়ে গেছে। সতের শতকের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তাগাছায় জমিদারদের আগমন ঘটে এই নদী পথ ধরে। মুক্তাগাছায় তৈরি হয় জমিদার বাড়ি। শিরোখালি নদী রৌয়ারচর নামক স্থান ছিল গহিন, নদী তীর ছিল জঙ্গলাকীর্ণ জীবজন্তু সংকুল। স্থানীয় প্রবীণদের তথ্য মতে, এই নদী পথে বড় বড় নৌকা যাতায়াত করত। এখানে নদীর পাড়ের জনপদে গোধূলীর আলো ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হত হুতুম পেঁচার ডাক। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই পেঁচার দল রাত্রি যাপনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত তাদের নির্ধারিত স্থানে।
তাদের কোয়াক কোয়াক শব্দে ঘুম ভাঙত এলাকাবাসীর। পাখির কলরব জানিয়ে দিত সুবহে সাদিকের উপস্থিতি। এখনও নদীর পাড়ে নানা ফুল ফলের গাছগাছালি শোভিত হয়েছে আপন মহিমায়। শিশিরসিক্ত গগনের দিগন্তে সূর্যের আভা বের হতেই নীড় ছেড়ে বেরিয়ে যায় পাখিরা, জেগে ওঠে নানা প্রাণিকুল। পাখির গানে নিসর্গ অপরূপ মোহে মোহচ্ছন্ন হয়। বসন্তে কোকিলের কুহতান, ফাগুনের দামাল হাওয়া, নদী পাড়ে ঘন ঘাসে সিক্ত শিশিরবিন্দু, জলধারে সূর্যস্নান এসব প্রাকৃতিক দৃশ্য শিহরণ জাগায় মনে। স্থানীয় জনগণ ব্যস্ত থাকে নানা কৌশলে মাছ ধরার। এক সময় এ নদী ছিল মাছে ভরপুর। জেলেরা জাল ফেলতেই মাছেরা খেলা খেলতে খেলতে আটকে যেত জালে। নির্দিষ্ট সময়ে জাল ওঠাতেই ধরা পড়ত ছোট বড় নানা প্রজাতির মাছ। এই নদীতে চলত নৌকাবাইচ। কেউ কেউ ডিঙি নিয়ে ছুটত কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। শিরোখালি পারের গায়ের বধূরা ঘোমটা টেনে পানিতে নেমে গোসল সেরে নিত। নদীর পানি টলমলে ও গরমকালে শীতল হওয়ায় গোসল করতে পছন্দ করত এলাকাবাসী। শুধু মানুষই নয় একটি নির্দিষ্ট ঘাটে গোসল করে এলাকার গবাদিপশু। শিরোখালি নদীর পূর্ব প্রান্তে খোলা ও বিস্তৃীর্ণ ফসলের মাঠ হওয়ায় সারাদিনের সূর্যের আলো জলধারাকে ঝলমলিয়ে দেয় এবং শীতকালে পানি ততটা শীতল থাকে না। সূর্যের আলোয় দূরীভূত হয় পানির শীতলতা। গ্রীষ্মে খোলা আকাশের মুক্তবাতাস জুড়িয়ে দেয় নদী তীরের মানুষের শরীর ও মন। এ নদীর পাড়ের গ্রাম বৌয়ারচরে বাস করতেন এক সাদা মনের মানুষ জালাল উদ্দিন সরকার।
তিনি এই নদী, এখানকার মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে সখত্যা করেছিলেন। নদীর পাড়ে গুছিয়ে ছিলেন কিছু মাটি ও মানব সেবার উপাদান। তিনি এখানকার পানি, মাছ, পাখি, গাছ গাছরার সঙ্গে করেছিলেন মিতালী। প্রতিদিন এই নদীর পাড়ে না আসলে স্বস্তি পেতেন না। এ নদীর কিছু জমি তিনি সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়েছিলেন। তার জমির ফসল, গাছ, নদীর মাছ বিলিয়ে দিয়ে তৃপ্ত বোধ করতেন। দু'চোখ ভরে উপভোগ করেছেন নদীর পাড়ের প্রাকৃতিক শোভা ও শিরোখালি নদীর পাড়ের মানুষের সচিত্র জীবন ও এই নদী কেন্দ্রিক জীবন জীবিকা। তিনি মারা গেছেন ২০০০ সালের ৩০ আগস্ট। তবে তার দানশীলতা ও কর্মের কারণে এখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত তাকে স্মরণ করে। এখানে এলে উপভোগ করা যায় ছোট নদীর নানা দৃশ্য ও নদী পারের মানুষের নানা চালচিত্র। রাজধানী থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ময়মনসিংহ জেলার মুক্তগাছা উপজেলার রৌয়ার চর গ্রামের অবস্থান শহরের কোলাহল থেকে কিছু দূরে। এখানে উপভোগ করা যায় প্রকৃতির স্পন্দন।
নদী বয়ে যায় আপনগতিতে, মাঠ-প্রান্তর ফসলি জমি সবই একাকার। বর্ষায় খাল বিল হয়ে ওঠে পানিতে সয়লাব। শাপলা শালুকে বিল ঝিল হেসে ওঠে। জল এসে যায় বাড়ির আঙিনায়। ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে জাল, খালই ও মাছ ধরার নানা উপকরণ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ক্ষেতের আইল ধরে। জলের শিহরণে পুলকিত হয় তারা। মাছরাঙা বসে থাকে কোন এক গাছে অথবা কঞ্চির গায়ে। তাকিয়ে থাকে মাছের দিকে। ছোঁ মেরে ওঠিয়ে নিয়ে আসে মাছ। কৃষক বেরিয়ে পড়ে নৌকা নিয়ে বিল ও জলাশয়ে, গান গায় আপন মনে। তুলে নিয়ে আসে শাপলা শালুক, শামুক। বর্ষায় এখানে খুঁজে পাওয়া যায় লোকায়ত সমাজ জীবনের নানা সংস্কৃতি। এক সময় রৌয়া ও বাইশা বিল ভরপুর ছিল নানা প্রজাতির মাছে। কলমি, হেলেঞ্চা, শাপলা, পদ্ম পাতার সঙ্গে ছিল মাছ ও শামুক ঝিনুকের মিতালী। উনিশ শতকের শেষের দিক পর্যন্তও এখানকার বিলে এসব দৃশ্য ছিল সরব। বিলের চারি পাশে এখন নানা গাছগাছালি ঘেরা গাঁ, বিলের পরিধিকে কমিয়ে ফেলেছে। এখানে ষড়ঋতুতে ফুটে ওঠে নানা চিত্র।
নানা রূপে নানা প্রকার উতালা ছবি। ভরা বর্ষার রূপ তন্বী অভিসারিকার মতো। শরতের রূপ তৃপ্ত রমণীর মতো সি্নগ্ধ নির্জন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে শোনা যায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার শনশন শব্দ, বাঁশ ঝাড়ে শালিকের কিচিরমিচির আওয়াজ। গরু নিয়ে রাখাল ছেলের ঘরে ফেরা, লাঙল কাঁধে নিয়ে কৃষকের বাড়ি ফেরা, পুকুরে, নদীতে হাঁস খেলা করে আপন মনে, খালের পাড়ে বরশি দিয়ে মাছ ধরা, গরু মহিষের গাড়ি দিয়ে ক্ষেত থেকে ধান নিয়ে আসা, কোন এক জলাশয়ে পানিতে শুয়ে মহিষেরা অলস সময় কাটানো, পাশের ঝোঁপে বেজি দৌড়ে পালায় এসব দৃশ্য এখানে বর্ণিল। শীতের পিঠা উৎসবে ঘরে ঘরে নবান্নের স্বাদ, ধানের ঘ্রান, এসবই এই গ্রামের অহংকার। এই গ্রামের একই চত্বরে রয়েছে উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঈদগাহ মাঠ, হাটবাজার। গ্রামের প্রবীণ পুরুষ হাজী নায়েব উদ্দিন সরকার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে শিক্ষা লাভ করে দেশ-বিদেশে অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষা সংস্কৃতি ও নানা ঐতিহ্যে আদর্শ হয়ে আছে বাংলার এ গ্রাম।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও ব্লগার।