মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কথা
দেবেশ চন্দ্র সান্যাল
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের গন পরিষদ (জাতীয় পরিষদ এর) এর ১৬২ টি আসনের ১৬০টিতে গণ ভোটে বিজয়ী হয় তৎকালীন বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ আরো ৭টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের অধিকারী হয়। মোট ১৬৭টি জাতীয় পরিষদের আসনের অধিকারী হয়ে আওয়ামী লীগ সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। তখন দেশের সামরিক প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান। বাঙালিদের বিজয়ে বিহারী শাসক সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে নারাজ। তিনি ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের পরিকল্পনা করলেন।
৩ জানুয়ারী’৭১ রমনা রেস কোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু নিজে শপথ করেন এবং তাঁর ডান পার্শ্বে ১৫১ জন এম.এন.এ ও বাম পাশের্^ ২৬৮ এম.পি.এ কে দাড় করিয়ে শপথ বাক্য পাঠ করান। ২২ ফেব্রুয়ারী’৭১ পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলদের এক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপন নির্দেশ দিলেন, ‘৩ মিলিয়ন আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকদের হত্যা করুণ”। তাঁর ধারণা ছিল নির্যাতন করে লাখ দুয়েক বাঙালি হত্যা করলেই আন্দোলন থেমে যাবে’। কালক্ষেপন করে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য ১৩ ফেব্রুয়ারী’৭১ ইয়াহিয়া মিথ্যা আশ্বাস দিলেন ৩ মার্চ’৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে। ১৬ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধুকে পার্লামেন্টারী নেতা নির্বাচন করা হয়। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান দুপুর ১২টায় দেওয়া বেতার ভাষণে ৩ মার্চ আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বে-আইনী ভাবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন। বেতার ভাষন শুনে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিলেন।
সারা দেশের মানুষ বাঁশের লাঠি হাতে রাস্তায় নেমে এলেন। পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ কে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালনের নির্দেশ দিলেন। ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩-৫ মার্চ সারাদেশ ব্যাপী হরতাল আহবান করলেন। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা...” গানটি নির্বাচিত হলো। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও জাতির পিতা ঘোষণা করা হল। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ানো হলো। ৬ মার্চ’৭১ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম বেলুচ টিক্কা খান কে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর মনোনয়ন দেন। কিন্তু বাঙালি প্রধান বিচারপতি জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে টিক্কা খানকে গর্ভনর হিসেবে শপথ করাতে অস্বীকৃতি জানান। উপায় না পেয়ে ইয়াহিয়া খান তখন টিক্কা খান কে পূূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্র জাতির পিতা বুঝতে পারলেন।
৭ মার্চ’৭১ ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির পিতা বললেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। ১৫ মর্চ নতুন কুট কর্ম-কৌশল নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। ১৬ মার্চ থেকে কাল ক্ষেপন ও ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রস্তুতি মূলক কার্যাদি করার জন্য প্রহসন মূলক আলোচনা শুরু করেন। গোপনে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও গোলা বারুদ আনতে থাকেন। জেনারেল টিক্কাখান ও অন্যদের দিয়ে বাঙালি নিধন যজ্ঞ চালানোর জন্য অপারেশন সার্চলাইট, পরিকল্পনা চুড়ান্ত করেন। ২৫ মার্চ বিকাল পৌঁনে ৬টায় আলোচনা শেষ না করে “অপারেশন সার্চ লাইট নামক বাঙালি নিধনযজ্ঞ চালানোর নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্ট বিশেষ বিমান যোগে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন। পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি সৈনিক, ইপিআর ও অন্যান্যদের নিরস্ত্র করে আটক করতে থাকলো। অবস্থা বুঝে বাঙালি সৈনিক ও ইপিআর গণ অনেকে অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে এলেন।
২৫ মার্চ’৭১ রাত সাড়ে ১১টায় টিক্কা খান মর্টাশেল, কামান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র নিয়ে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করে। তারা একযোগে ঢাকার পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, জগন্নাথ হল, ইকবাল সহ বিভিন্ন গুরুত্বর্পূণ স্থানে আক্রমণ করে। একযোগে অন্যান্য শহরে ও গণ হত্যা নির্যাতন ও জ¦ালাও পোড়াও শুরু করে। নিরীহ, ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। পাখির মত লোক হত্যা করে। বস্তি ও অন্যান্য স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাকিস্তানি হানাদারেরা বাঙালিদের উপর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। দেশের সার্বিক অবস্থা দেখে ও বুঝে ২৬ মার্চ’৭১ প্রথম প্রহরে রাত ১২.২০মি. এ জাতির পিতা ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর নিজ বাড়িতে উপস্থিত নেতা কর্মীদের সম্মুখে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শেষবাণী প্রদান করেন’। জাতির পিতা বললেন- “মধ্যরাতে বর্বর পাক বাহিনী ঢাকা পিলখানা এবং রাজার বাগ পুলিশ লাইনে অতর্কিত হামলা চালায়। লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়েছে। যুদ্ধ চলছে। আমি শেখ মুজিবুর রহমান এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করছি এবং সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাকামী দেশ সমূহের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করছি। এই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলদেশের মানুষকে আহবান জানাচ্ছি আপনার যে যেখানে আছেন এবং আপনাদের যার কাছে যা আছে তাই নিয়েই শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যত দিন পর্যন্ত শেষ পাকিস্তানী সৈন্য বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎঘাত না হয় এবং যত দিন পর্যন্ত চুড়ান্ত বিজয় না আসে তত দিন আপনারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। জয় বাংলা।” “স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি দেশও বিদেশে পাঠানোর জন্য ই.পি.আর ওয়ারলেস কেন্দ্র, ঢাকাস্থ মগবাজার ওয়ারলেস কেন্দ্র ও টিএনটি অফিসে পৌঁছানোর নির্দেশ দিলেন।
স্বাধীনতা বার্তার মুল মেসেজে লেখা ছিল-গত মধ্য রাতে দুর্বৃত্ত পাকিস্তানি সেনা বাহিনী ট্যাংক মেশিন গ্যানও অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র সহযোগে পিল খানার ইপিআর সদর দফতরে ও রাজার বাগের পুলিশ ভবনে অতর্কিতে হামলা পরিচালনা করে এবং শত সহ¯্র নিরীহ জন সাধারণকে হত্যা করে। ঢাকা বাসীরা অত্যন্ত বীরত্বের সাথে রাস্তায় শত্রু সেনাদের মোকাবিলা করিয়া যাইতেছে।এত দ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হইল। প্রিয় দেশবাসী,আপনারা দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ুন। আমাদের সংগ্রামে বিশে^র প্রতিটি শান্তি প্রিয় নাগরিকের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করি।খোদা আমাদের সহায় হোক। জয় বাংলা। শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ,১৯৭১”। ২৬ মার্চ সকাল ৮.০০ টায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ওয়ারলেস কপি শাহজাদ পুর থানার ওসি জনাব আব্দুল হামিদ পেয়ে ছিলেন। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা, ইপিআর, আনসার ও ছাত্র জনতা প্রতিরোধ যুদ্ধ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। রাত ১.১০টার পর জাতির পিতাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ঢাকা সেনা নিবাসে নিয়ে যায়। পরের দিন জাতির পিতাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ মার্চ’৭১ চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র স্বাধীণ বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দুপুর ১.১০মি. এর পর জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষনার বার্তাটি পাঠ করেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম,এ হান্নান। ঘোষণাটি বেশ কয়েক বার প্রচার করা হয় তখন সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। অপর দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারাদেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করলো।
২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭ টায় মেজর জিয়াউর রহমান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধরু পক্ষে স্বকন্ঠে যে স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করে ছিলেন তা হলো- ‘I Major zia on behalf of our great national Leader Bangabandhu Sheik Mujibur Rahman do hereby Declare Independence of Bangladesh...’। তিনি ১০ কিঃও মধ্যম তরঙ্গের স্বাধীন বাংলাবেতার কেন্দ্র (কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র ) থেকে এই বক্তব্যটি পাঠ করে ছিলেন। মো: নুরুল আমিন ও অধ্যাপক গোলাম আযম সহ ১২জন ইসলামী দলগুলোর নেতারা টেক্কা খানের সাথে সাক্ষাত করে। টেক্কা খান স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রলোভন দেয় যে- ‘৭ডিসেম্বর’৭০ এর সাধারণ নির্বাচন বাতিল করা হবে।স্বাধীনতা ঘোষণা করার করণে ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট আওয়ামী লীগ কে নিষিদ্ধ ও শেখ মুজিব কে দেশদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। প্রেসিডেন্টের সাথে আমার কথা হয়েছে। দেশদ্রোহী হিসেবে শেখ মুজিব এর বিরুদ্ধে মামলা করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। নির্যাতন, ধর্ষণ ও জ্বালাও পোড়াও করে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও ভারতের দালাল হিন্দুদের কে শেষ করে দেওয়া হবে। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন পুনরায় সাধারণ নির্বাচন দিয়ে ইসলামী দলগুলোর হাতে পূর্ব-পাকিস্তানের ক্ষমতা দেওয়া হবে’। টেক্কা খানের প্রলোভনে ইসলামী দলগুলোর স্বার্থা ন্মেষী মৌলবাদী কিছু নেতারা পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করলো।
১ সেপ্টেম্বর’৭১ খুকনী উচ্চ বিদ্যালয়ের খ্যাতনামা প্রধান শিক্ষক বাবু হিতেন্দ্র নাথ চন্দকে ব্যারিষ্টার কোরবান আলীর নির্দেশে কৈজুরী রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকারেরা রাত তিন টার দিকে স্ত্রী,পুত্র পরিজনের সন্মূখে নির্যাতন করে ধরে নিয়ে বাড়ির কিছু দূরের রাস্তার উপর গুলি করে হত্যা করে। শাহজাদপুর ক্যাম্পের পাকিস্তানি হানাদারেরা কৈজুরী রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকাদের সহযোগিতায় বেলতৈল গ্রামের সুনীল ও অনিল দুই ভাইকে নিষ্ঠুর ভাবে নির্যাতন করে গুলি করে হত্যা করে ছিল। শাহজাদপুর দরগা পাড়ার এক সুন্দরী হিন্দু কুন্ডু যুবতীকে ধরে নিয়ে জোর ধর্মান্তরিত করে ধর্ষণ করেছিল। রতন কান্দি হাট থেকে ভৈরব পাড়া গ্রামের নারায়ন চন্দ্র সরকার কে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে ছিল। দরগার চরে তার লাশ পাওয়া গিয়া ছিল। স্বাধীনতা বিরোধীরা পীচ কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও অন্যান্য বাহিনী করে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যোগ দিল। জীবনের ভয়ে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও এ দেশের অধিকাংশ হিন্দুরা ভারতে আশ্রয় নিল। পোরজনা রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকারেরা পোরজনা গ্রামের অধিবাসী মনীন্দ্র নাথ ঘোষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ছিল। ১০ এপ্রিল’৭১ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করল। ১৭ এপ্রিল’৭১ শপথ গ্রহণ করল। ১৯ এপ্রিল ডাব বাগান (বর্তমান শহীদ নগর) প্রতিরোধ যুদ্ধ হলে। ১৪ মে ডেমরা রূপসী-বাউসি গন হত্যা হলো। এই গনহত্যায় আমার ৫ জন নিকট আত্মীয় সহ ৭ শতাধিক নারী- পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান গণহত্যায় জীবন দিলেন। আমি ২১মে আমার আত্মীয় স্বজনের খোঁজ নিতে ডেমরা গিয়ে ছিলাম। গনহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষ দর্শীদের কাছে থেকে গণ হত্যার নিষ্ঠুরতার কথা শুনে শোকাভিভুত হয়ে পড়লাম। ২৩ মে আমার এক গণহত্যায় স্বামী হারা দাদি স্নেহলতা দেব্যা কে নিয়ে রতন কান্দি বাড়ি ফিরলাম। শাহজাদপুরের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব মোঃ
আব্দুর রহমানের সাথে যোগা যোগ করলাম। মহান মুক্তিযুদ্ধ কী, কিভাবে যুদ্ধ করতে হবে, কতদিনে দেশ স্বাধীন হবে, একটি প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন সম্ভব কিনাআমেরিকা ও চীনসহ বেশ কিছু দেশ পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ নিল। আন্তর্জাতিক চাপে ভারতে কে সহযোগিতা করা সম্ভব হবে কীনা ইত্যাদি বোঝার বয়স তখন আমার হয় নাই। আমি বুঝলাম মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া অর্থ “স্বজ্ঞানে সুস্থ-শরীরে মৃত্যু জন্য যাওয়া”। আমি তখন রতন কান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের গণহত্যা, জ্বালাও পোড়াও, হত্যা ও অন্যান্য মানবতা বিরোধী নিষ্ঠুরতার কথা শুনে জাতির ক্রান্তিকালে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
২৩ জুলাই’৭১,৬ শ্রাবণ ১৩৭৯ শুক্রবার মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যাওয়ার একটা সুযোগ এলো। আমাদের শাহজাদপুরের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব মোঃ আব্দুর রহমান সাহেব মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ দিতে ইচ্ছুকদের ভারতে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের গ্রামের সুনিল কুমার হাজরা সহ আমরা ২২ জন মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের জন্য রওনা হলাম। আমাদের বাড়ির ঘাট থেকে নৌকা ছাড়া হলো। আমি ঐ নৌকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারত যাত্রা করলাম। ঝুঁকি পূর্ণ এলাকা দেখে শুনে ভোরে আমাদের কে নামিয়ে দেওয়া হলো সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া নামক স্থানের কাছে। সেখান থেকে পায়ে হেটে সুজানগর গেলাম। এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে আশ্রয় নিলাম, খাওয়া দাওয়া করলাম। এম,পি,এ স্যার পদ্মা পার হয়ে কুষ্টিয়া যাওয়ার জন্য নৌকা ভাড়া করলেন। সবাই বললেন দিনের বেলা পদ্মা পার হওয়া যাবেনা। পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা স্পিড বোর্ড দিয়ে পদ্মা নদীতে টহল দেয়। তারা নৌকা ধরলে সবাইকে নির্যাতন করে হত্যা করবে। দিনে সুজানগর থাকলাম। রাত ৯টায় নৌকা পদ্মানদী পার হয়ে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। রাত ২টার পর কুষ্টিয়া জেলার এক নিভৃত গ্রামে পৌঁছালাম। এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। তারা প্রথমে কাঁঠাল গাছ থেকে কাঁঠাল পেরে মুরি দিয়ে আমাদের খাওয়ালেন। জানা গেল স্থানটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অদূরে পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকার ক্যাম্প আছে। গ্রামেও পীচ কমিটির সদস্য আছে। তারা জানতে পারলে পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকারদের হাতে ধরিয়ে দেবে।
পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকাররা নির্যাতন করে হত্যা করবে। ঐ বাড়িতে ডাল ভাত রান্না হলো। আমরা তাড়াহুড়া করে খেয়ে হেটে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ঐ রাতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতেই পথ চলা। এম,পি এ স্যারের হেঁটে চলা কষ্ট হচ্ছিল। সুনিল কুমার হাজরা ও অন্যান্যরা পর্যায়ক্রমে ধরে হাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ভোরে নিরাপদে ভারতের নদীয়া জেলার জলঙ্গী বর্ডার পার হলাম। বর্ডারের কাছেই ছিল একটি বি.এস,এফ ক্যাম্প। বি.এস.এফ ক্যাম্পে ঢুকে সবাই প্র¯্রাব পায়খানা করে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। এম,পি,এ স্যার সবার যাবার জন্য বাসের ব্যবস্থা করলেন। আমাদের কে নিয়ে গেলেন মালদহ শহরে। মালদহ শহরে দুপুরে কাঠাল ও মুরি খাওয়ালেন। এম,পি,এ স্যার আমাদেরকে বালুর ঘাটের নিকটে কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি প্রবাসী সরকারের উদ্দেশ্যে কলিকাতা রওনা হলেন। আমরা রাত ৯টায় কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে পৌঁছালাম। আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। পরদিন ফলইন করিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ানো হলো ও পিটি প্যারেড করানো হলো। একদিন পর আমাদের কয়েকজন কে কুড়মাইল ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হলো। পরের দিন কুড় মাইল থেকে মালঞ্চ ক্যাম্পে স্থানাস্তর করা হলো। তাঁর পরের দিন পতিরাম ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হলো। দুদিন পর আমাদের ২০০ জন কে পতিরাম ক্যাম্প থেকে ভারতীয় সেনা ট্রাকে শিলিগুড়ির পানি ঘাটা নামক মুক্তিযোদ্ধা হায়ার ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো। পানি ঘাটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিখ সেনা ডি.এস ভিলন এর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাদের দ্বারা বিভিন্ন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ হলো।
২১ দিন প্রশিক্ষণ হলো। আমার এফ এফ নম্বর হলো- ৪৭৪২। রবীন্দ্র নাথ বাগচী,রতন কুমার দাস, মোঃ নজরুল ইসলাম ও আমাকে পানি ঘাটা থেকে ৭নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার পশ্চিম দিনাজপুরের তরঙ্গপুর নিয়ে আসা হলো। আমাদের প্রত্যেকের নামে অস্ত্র ও গোলা বারুদ ইস্যু করা হলো। একই এলাকার রাস্তা চেনা মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ১০ সদস্যের একটি গ্রুপ করা হলো। গ্রুপ কমান্ডার নিযুক্ত হলেন বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের জনাব এম,এ,মান্নান, ডেপুটি কমান্ডার বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী। আমাদেরকে রেশনিং ও পকেট মানির টাকা দেওয়া হলো। মৃত্যুর প্রস্তুতি হিসেবে তরঙ্গপুর বাজার থেকে আমি একখানা শ্রী শ্রী চন্ডীগ্রন্থ, বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত একটি জাতীয় পতাকা ও একটি চার ব্রান্ডের রেডিও ক্রয় করলাম। তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে কিছু পথ বাসে এসে একটি রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনে শিলিগুড়ি রেলওয়ে জংসনে এলাম। শিলিগুড়ি জংসন থেকে ট্রেন বদলি হয়ে আসামের ধুবরী স্টেশনে এলাম। ধুবরী স্টেশন থেকে বাস যোগে ব্রহ্মপুত্র নদীর ফেরী পার হয়ে মানিকার চর এলাম। রাত হয়ে পড়ায় রাতে মানিকার চর বোডিং এ থাকলাম। পরের দিন সকালে মানিকার চর নদী পার হয়ে তদানিন্তন রংপুর জেলার মুক্তাঞ্চল রৌমারীতে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে এলাম। স্নান খাওয়া-দাওয়া করলাম। আমাদের কমান্ডার স্যার সিরাজগঞ্জ চড়ে পৌঁছার জন্য ছইওয়ালা নৌকা ভাড়া করলেন।
সন্ধ্যা ৭.০০টার দিকে আমাদের নৌকা ছাড়লো। বাহাদুরাবাদ, ফুলছড়ি, জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের সম্মুখ দিয়ে আসতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সৈনিক ও রাজাকারদের ক্যাম্প। তারা নদী পাহারা দেয়। প্রতিটা মুহুর্ত ছিল ঝুঁকি পূর্ণ। সব সময় আমাদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হতো। সব চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাহাদুরাবাদ ঘাট। পাকিস্তানি হানাদাররা স্পিডবোর্ড দিয়ে নদী টহল দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পেলে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে। বাহাদুরাবাদ ঘাট অতিক্রম করার পূর্বে কমান্ডার স্যার নির্দেশ দিলেন- ‘আপনারা সবাই নৌকার ডওরার মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকুন। পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকার স্পিডবোর্ড নিয়ে ধরতে এলে আমরা ধরা দিব না, যুদ্ধ করব। যুদ্ধে শহীদ হবো কিন্তু হায়েনাদের হাতে ধরা দিয়ে নির্যাতীত হয়ে জীবন দিব না’। রাত ২ টার দিকে বাহাদুরবাদ ঘাটের সম্মুখ দিয়ে নৌকা অতিক্রম করতে থাকলো। সার্চ লাইটের আলো এসে নৌকায় পড়ছিল। ভাগ্যক্রমে হানাদাররা স্পিডবোর্ড নিয়ে আমাদের কে ধরতে এলোনা। বাহাদুরাবাদ ঘাট অতিক্রম করে এক কাইশা বনের মধ্যে নৌকা লাগিয়ে দিল। আমরা প্রস্রাব পায়খানা করে নিলাম। আমাদের সঙ্গে চিড়াগুড় ছিল। সকলে চিড়াগুড় দিয়ে সকালের খাবার খেলাম। দেখে শুনে থেমে থেমে মাঝিরা নৌকা চালাচ্ছিলেন। আমরা নৌকায় ঘুম ও বিশ্রাম নিতে থাকলাম। নৌকায় ডালভাত রান্নার ব্যবস্থা ছিল।
মাঝিরা ডাল ভাত রান্না করে আমাদের খাওয়ালেন। আমরা দুপুর ও রাতের খাবার খেলাম। দুই দিন পর রাত ৪ টায় গিয়ে যমুনার চর পৌছালাম। নৌকায় শেষরাত ও সারা দিন যমুনার চরে থাকলাম। পরের রাতে যমুনা পার হয়ে কামারখন্দ বেলকুচি নির্বাচনী এলাকার এম,এন,এ জনাব মোঃ আব্দুল মোমিন তালুকদারের গ্রামের বাড়ি এলাম। এম,এন,এ স্যার বাড়িতে ছিলেন না। তার ভাই জনাব মো: রশিদ তালুকদার আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আমরা বেলকুচি থানার বিভিন্ন গ্রামে থাকতে থাকলাম। স্বাধীনতা বিরোধীদের ভয়ে অনেকেই বাড়িতে আশ্রয় দিতে সাহস পেতেন না। অধিকাংশ সময় আমরা স্কুলে ও অন্যান্য যায়গায় আত্মগোপন করে থাকতাম। আজ এখানে কাল সেখানে থাকতে থাকলাম। আমরা দিনের বেলা রেকি করতাম। রাতে আজ এ থানা কাল এ রাজাকার ক্যাম্প গেরিলা আক্রমন করে পাকি হানাদার ও রাজাকারদের আতঙ্কিত করতে থাকলাম। প্রতিরাতে কমান্ডার স্যার আমাদের কে পাশওয়ার্ড দিতেন। প্রতিদিন আমরা অস্ত্রে ফুলতরী মারতাম ও পরিষ্কার করতাম। আমরা বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ, কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ব্রিজ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস, কল্যানপুর ও শাহজাদপুর থানার ধীতপুর নামক স্থানে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছি।
পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়ে আমরা জামিরতা হাই স্কুলে ক্যাম্প করে থাকতে থাকলাম। জয় বাংলা ছিল আমাদের রনাঙ্গনের রনধ্বনি। দেশের প্রতি ভালবাসাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের রনাঙ্গনে সাহসি হয়ে উঠার মূল শক্তি। আমাদের কোন মৃত্যু ভয় ছিলনা। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বলে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর কাঁপিয়ে পড়তাম। বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য হাসতে হাসতে শহীদ হয়েছেন। আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের সংবাদ থানা ও আশে পাশে ছড়িয়ে পড়লো। শাহাজাদপুর রাজাকার ক্যাম্প থেকে রাজাকারেরা আমাদের বাড়ি গেল। আমার পিতৃদের সহ সবাইকে আলটি মেটাম দিল- “দেবেশ মুক্তিযুদ্ধে গেছে ৭ দিনের মধ্যে দেবেশকে হাজির করে দিতে হবে”। অন্যথায় বাড়ির সবাইকে সারিবদ্ধ করে গুলি করে হত্যা করা হবে। বাড়ি ঘর লুট করে পুড়িয়ে দেওয়া হবে। আমাদের গ্রামের মুসলমানেরা খুব ভাল। তাঁরা অসাম্প্রদায়িক। তাঁরা গ্রামের সকল হিন্দুর বাড়িঘর পাহাড় দিয়ে,আশ্রয় দিয়ে রাখতো। আমাদের গ্রামের একজন লোকও শান্তি কমিটি, রাজাকার ও স¦াধীনতা বিরোধী হয় নাই। রাজাকারদের আলটি মেটামে আমার গোটা পরিবারকে বাড়িঘর সব ফেলে জীবনের ঝুঁিক নিয়ে ভারতের আসামের মানিকার চর শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
৯ ডিসেম্বর’৭১ আমি আমার রণাঙ্গনের সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিজ গ্রাম রতন কান্দি এলাম। বিজয়ের আবেগ আর আনন্দে আমি থ্রিনট থ্রি রাইফেল থেকে ৩টি আকাশ মুখী গুলি করলাম। স্বাধীনতা আসন্ন বুঝে কর শালিকা ও পোরজনা রাজাকার ক্যাম্পের সবাই পালালো।বাঘাবাড়ি ও অন্যান্য জায়গার রাজাকারেরা কেহ অস্ত্র সহ, কেহ খালি হাতে আমাদের গ্রাম হয়ে পালাতে থাকলো। পাকি হানাদার ও তাদের দোসরদের অত্যাচারের কথা স্মরণে আসায় গ্রামের কিছু কিছু যুবক রাজাকারদের উপর মার মুুখী হলো।দু’চার জন কে চর থাপ্পর মারলো। আমি সবাইকে বুঝিয়ে ও দেরকে ক্ষমা করে দিতে বললাম। কারণ রাজাকার হওয়ার জন্য তাঁরা দায়ী নয় । ওরা গরীব মানুষ। যারা ওদের কে রাজাকারে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে তারা দায়ী। সবাই আমার কথা মানলো। রাজাকারদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিল। আমি আমার সাথীদের নিয়ে আমার রতন কান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে উপস্থিত হলাম। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু দেবেন্দ্র নাথ সান্যাল ও অন্যান্য শিক্ষক স্কুলের ছাত্র ও আমার রণাঙ্গনের সাথীদের নিয়ে আমি স্কুলে ভারতের তরঙ্গপুর থেকে কেনা জাতীয় পতাকা উড়ালাম এবং সবাই কে নিয়ে জাতীয় সংগীত গাইলাম। রাতে রণাঙ্গনের সাথীদের নিয়ে হেটে জামিরতা হাই স্কুল ক্যাম্পে ফিরে এলাম।মাও: সাইফুদ্দিন এহিয়া খান মজলিশ, ব্যারিষ্টার মো: কোরবান আলী, করশালিকা রাজাকার ক্যাম্পের, মোঃ আব্দুল খালেক, পোরজনা রাজাকার ক্যাম্পের মোঃ আতাউর রহমান আতা সহ পাকিস্তানি হানাদার দের পক্ষে কাজ করা সবাই দেশ বিদেশে পালালো।
২১ নভেম্বর’৭১ মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী নিয়ে যৌথ বাহিনী গঠন করা হয়। জাতির পিতার জন্য কবর খোড়া হয়ে ছিল। কবর দেখিয়ে আপোষ করানোর চেষ্টা করা হয়ে ছিল। ৩ ডিসেম্বর ৭১ ৪ মাস প্রহসন মূলক বিচার চালিয়ে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মৃত্যু দন্ডের আদেশ দেয়। পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ভারতের বিমান ঘাটিতে বোমা হামলা চালায় । পাকিস্তান যাতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দন্ড কার্যকরী করতে না পারে সে জন্য ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের পরিকল্পনা করে। পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু মৃত্যু দন্ডের রায় ঘোষণার পর ৬ ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় ভুটান বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। জাতির জনকের মৃত্যুদন্ডের আদেশ কার্যকরী করার পূর্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন করার অঙ্গীকার নিয়ে যৌথ বাহিনী দুর্বার বেগে পাক হানাদার বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৬ ডিসেম্বর ৭১ সোমবার বেলা ১০.৩০ টায় ভারতীয় লোক ও রাজ্য সভা উভয় সংসদের সর্বসন্মতিতে তুমুল করতালির মধ্যে ভারতীয় প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ঘোষনা করেন ।
৮ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী বিমান আক্রমন শুরু করে। ভারতীয় বিমান ও বেতার থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের আত্ম সমর্পনের আহবান জানানো হলো। বিমান থেকে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের আত্ম সমর্পনের আহবান জানিয়ে হাতিয়ার ডাল দো... প্যাম্পলেট ছাড়লো। স্বাধীনতা বিরোধীরা বাঙালি জাতি কে মেধা শুন্য করার পরিকল্পনা করলো। ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ধরে আনলো। তাঁদের কে টর্চারিং সেলে নির্যাতন করলো।আলবদর বাহিনীর লোকেরা বুদ্ধিজীবীদের চোখ তুলে ছিল। বিভিন্ন আমানবীয় অত্যাচার করে ছিল নৃশংস ভাবে হত্যা করলো। ১৪ ডিসেম্বর ৩০ এর অধিক বাঙালী বুদ্ধিজীবীকে রায়ের বাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে লাশ রেখে এসে ছিল।
১৪ ডিসেম্বর ৭১ আমাদের শাজাদপুর থানা হানাদার মুক্ত হলো। ১৬ ডিসেম্বর ৭১ বিকাল ৪-৩০মি: এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৯১,৫৪৯জন সদস্য নিয়ে সবার মাথা নীচু করে লে: জেনারেল এ.এ কে নিয়াজী আত্মসমর্পন করে। দেশ স্বাধীন হবার পর বধ্যভূমীতে শহীদ মুনীর চৌধুরী সহ অনেকের ক্ষত বিক্ষত লাশ পাওয়া গিয়াছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনী সদস্য, ইপি আর, আনসার মুক্তিবাহিনীসহ ত্রিশ লক্ষ বাঙালি শহীদ হন এবং দুই লাখ মা বোন সম্ভ্রম হারান। ৩ লক্ষ মা-বোন অন্যান্য নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হন। দেশের সকল মানুষ বিভিন্ন প্রকার ত্যাগ স্বীকার করেন। স্বাধীনতাত্তোর জাতির পিতা শহীদের সম্মানে আমাদের জাতীয় পতাকা থেকে দেশের মানচিত্র তুলে দিয়ে শহীদের রক্তের প্রতীকি হিসেবে সূর্যাকৃতির লাল বৃত্ত বসানোর বিধান চালু করার নির্দেশ দিলেন। আমাদের জাতীয় পতাকার সবুজের বুকে লাল বৃত্তটি শহীদের রক্তের তৈরী। আমি যখনই জাতীয় পতাকাটি দেখি তখনই আমার সম্মূখে আমাদের গ্রুপের শহীদ হওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা জয় গুরু বিশ্বাস সহ দেশের সকল শহীদের কথা স্মরণ হয়। আমি লাল বৃত্তের মধ্যে শহীদের রক্ত দেখতে পাই। শহীদেরা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন।
৮ই জানুয়ারী’৭২ পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদিন লন্ডন অবস্থান করে পরের দিন বাংলাদেশে আসার পথে ভারতের নয়াদিল্লিতে সংবর্ধনা নিয়ে ১০ই জানুয়ারী’৭২ বাংলাদেশে আসেন। ১১ই জানুয়ারী অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন, ঐ আদেশের মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু প্রধান বিচারপতির কাছে প্রথমে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং পদত্যাগ করেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে দেশের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন।
১২ই জানুয়ারী’৭২ শুরু হয় জাতির পিতার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শাসনামাল। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পরিচালনা করতে থাকেন। জাতির পিতা ১৬ জানুয়ারী কে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু সরকার ভারত থেকে ফিরে আসা শরনার্থীর মধ্যে চাল, গম ও অন্যান্য সাহায্য করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। ভারতীয় সৈন্যদেরকে এ দেশ থেকে চলে যেতে বলেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অস্ত্র জমা দিতে বলেন। জাতির পিতার আদেশ পেয়ে আমাদের গ্রুপ ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারী রবিবার সিরাজগঞ্জ ইব্রাহিম বিহারীর বাসায় অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা নেয়া ক্যাম্পে সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর সম্মুখে লেঃ সাইফুল্লাহ স্যারের কাছে অস্ত্র জমা দিলাম। প্রত্যেককে অস্ত্র জমা দেয়ার রশিদ নিয়ে আমাদেরকে বাড়ীতে চলে আসতে বললেন।
১৪ই ফেব্রুয়ারী’৭২ সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সংবাদ দেয়া হলো। আমি সিরাজগঞ্জ এস.ডি.ও অফিসে গেলাম। আমার অস্ত্র জমা রশিদ ফেরৎ নিয়ে আমাকে মহান মুক্তি বাহিনীর সেনাবাহিনী প্রধান কর্ণেল (অব:) মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট নং-১২৯১৫৮, একটি সাদা কম্বল ও বকেয়া রেশন মানি ও পকেট মানি হিসাবে ১১০ টাকা দেয়া হলো। সরকারী উদ্যোগে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের পশ্চিম পার্শ্বে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের জন্য ন্যাশনাল মিলিশিয়া ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। এস.ডি.ও অফিস থেকে ইচ্ছুক সব মুক্তিযোদ্ধাকে মিলিশিয়াতে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেন। আমি ন্যাশনাল মিলিশিয়ায় ভর্তি হলাম না। আমি বাড়ীতে চলে এলাম। আমি মহান মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব শেষ করে রতনকান্দি আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক বাবু দেবেন্দ্র নাথ সান্যালের কাছ থেকে ৮ম শ্রেণির অটোপাশের টি.সি নিয়ে শাহজাদপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেনীতে ভর্তি হয়ে লেখা-পড়া শুরু করলাম। ১২ই মার্চ ভারতীয় সৈন্য সর্ব-শেষ কুজ জাতির পিতাকে স্যালুট দিয়ে কাওয়াজ করে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেলেন।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ব্যাংকার।