পথের ধুলো থেকে : পর্ব-১৭
‘মুজিব বা তার দল একটি ‘পেটি বুজুয়া’দের দল, এই দল কখনোই জনগণের স্বাধীনতা এনে দিতে পারবে না’
সাইফুল ইসলাম
২৫ মার্চ গভীর রাতে ঢাকায় হামলা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এ হামলা প্রতিরোধের প্রস্তুতি বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না বললেই চলে। তবুও অসহযোগ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সেনানিবাস এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া প্রায় পুরো বাংলাদেশ ‘বাঁশের লাঠি’ দিয়ে মুক্ত করে ফেলে জনগণ। সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের পাকসেনা না থাকায় প্রশাসনও মুক্ত হয়ে পড়ে খুব সহজেই। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের তরুণ নেতৃত্ব প্রশাসনের কিছু অস্ত্র নিয়ে ছোটে সিরাজগঞ্জ মহুকুমাকে মুক্ত রাখতে। আরও বেশ কিছু অস্ত্র মহুকুমা অস্ত্রাগার এবং বিভিন্ন থানায় থেকে যায়। কিন্তু ২৫ এপ্রিল বগুড়া ও পাবনা এলাকা থেকে পাকিস্তান সেনারা এসে নগরবাড়ি-বগুড়া সড়ক দখলে নেয়। ২৭ এপ্রিল দখলে নেয় সিরাজগঞ্জ মহুকুমা শহর। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীরা পিছু হটতে হটতে বাঘাবাড়ি ঘাইটনা হয়ে শহরে এসে তারপর গ্রামে চলে যায়। প্রশাসনের এসডিও শামসুদ্দিন চলে যান তার নিজ এলাকা টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকায় এবং এসডিপি আনোয়ার উদ্দিন লস্কর ভগ্রঘাট হয়ে পাড়ি জমান অজানার উদ্দেশ্যে।
গ্রামে চলে যায় ‘বামপন্থী’ হিসেবে পরিচিতরাও। তবে তারা আশ্রয় নেয় পূর্বের তৈরি করা ‘ঘাটি’ এলাকাগুলোতে। তার আগে তারা ‘জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ তথা বিপ্লবের জন্য যে অস্ত্রের প্রয়োজন তা সংগ্রহের চেষ্টা করে। ‘সাধারণের চোখে মুক্তিযুদ্ধ’ প্রস্তত করতে গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া যায়। কালিয়াহরিপুর ইউনিয়নের চরকল্যানী গ্রামের বাসিন্দা তৎকালীন রায়পুরের কওমী জুটমিল শ্রমিক বর্তমানে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট নেতা মোঃ খয়ের আলী তালুকদার [৭২] জানান, ‘গ্রামে গুজব ছড়াতে থাকে যে, শহরে ব্যাপক লুটপাট করছে বিভিন্ন গ্রুপ। কখনো কখনো গোলাগুলির শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। থানার অস্ত্র লুট হয়ে গেছে। আমাদের গ্রামের আব্দুল মান্নান, নক্সালপন্থী- সে-ও ৬/৭টি রাইফেল নিয়ে এসেছে তার বাড়িতে।’ একই ভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করতে দেখা যায় তোয়াহা গ্রুপের কিসমত আলীসহ অন্যদেরও। এসময়ে অবস্থান করতে দেখা যাচ্ছে, প্রবীর কুমার নিয়োগীকে বহুলী, কিসমত আলীকে শিয়ালকোলের রঘুনাথপুর, মনিরুজ্জামান তারা ও আব্দুস মান্নানকে কালিয়া কান্দাপাড়া, ছাতিয়ানতলীতে অনিল ঠাকুর—আব্দুল হাইকে। এদের প্রায় সবাই প্রাথমিক অবস্থায় আত্মগোপন করে অস্ত্র সংগ্রহ করেন, কারণ তারা ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব’ করবেন। সাধারণ ভীতসন্তুস্থ মানুষ যখন শহরে ফিরতে শুরু করেন, তখন তাদের সঙ্গে ‘বামপন্থী’দের কেউ কেউ ফিরে এসে শহরে অবস্থান নেয়। এছাড়াও তোয়াহ গ্রুপের অন্যতম আশ্রয় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ইসমাইল হোসেনের গ্রুপে। এদের অনেকেই তোয়াহা গ্রুপ করতেন বলে পাওয়া যায়।
তৎকালীন স্পিনিং মিল শ্রমিক শিয়ালকোল ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুল হোসেন আবুল মিস্ত্রি জানান, ‘২৫ মার্চের পরে বিভিন্ন থানা ও অস্ত্রাগার থেকে বের হয়ে আসা বিপুল পরিমান অস্ত্র তারা কৌশলে হস্তগত করে। এসব অস্ত্র দিয়ে নিজস্ব বাহিনী ও প্রশাসন গড়ে তোলে তারা। তারা অবস্থাপন্ন কৃষককে লেভি [খাজনা] দিতে বাধ্য করতে থাকে। এছাড়াও কেউ কিছু বেচাকেনা করলেও তার কাছে থেকে লেভি আদায় করতে শুরু করে। ‘কমিউনিষ্ট’রা তাদের মুক্ত এলাকার সংগঠন চালাতে এসব লেভি আদায় করছে বলে প্রচার করতে থাকে। এ ছাড়াও তারা প্রচার করতে থাকে যে, মুজিব বা তার দল একটি ‘পেটি বুজুয়া’দের দল, এই দল কখনোই জনগণের স্বাধীনতা এনে দিতে পারবে না। ‘কমিউনিষ্ট’দের দলই শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে পাকিস্তানের কবল থেকে জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতা এনে দিয়ে দেশে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’ কায়েম করবে। সেখানে কায়েম হবে শ্রমিকরাজ কৃষকরাজ।’
তাদের তৎপরতা সম্পর্কে আরো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে খয়ের আলী তালুকদারের সঙ্গে কথা বলে। তিনি জানাচ্ছেন, ‘এলাকায় নক্সালপন্থীরাও ছিল বেশ তৎপর। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ, ফরহাদ হোসেন, আকতার হোসেন। নক্সালপন্থীরা এলাকার শান্তি কমিটির জয়নাল জনুকে হত্যা করে। তাছাড়াও তারা শ্রেণিশত্রু খতমের নামে হত্যা করে বেলায়েত হোসেন [বিড়ি কারখানার মালিক], কোরবান আলী [বিড়ি কারখানার মালিক], মোকসেদ মণ্ডল [জোতদার] কে। আহমেদ ডাকাতের দলকেও তাড়িয়ে দেয় তারা।’ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, এই ব্যবসায়ী বা জোতদার ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক।
শহরেও একটি ইউনিটের তৎপরতা এবং অস্তিত্বের খবর পাওয়া যায়। তবে এদের অনেকেই এখন রাজনীতিতে নিস্ক্রিয় তো বটেই, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে কথা বলতেও রাজী হন না। ভাবটা এমন যে, কী লাভ এসব আলোচনা তুলে। এদের মধ্যে কথা বলেন, বাহিরগোলার বাসিন্দা মির্জা আব্দুর রাজ্জাক। তাদের গ্রামের বাড়ি বেলকুচির ক্ষিদ্রমাটিয়া গ্রামে। বাবা মির্জা শমশের আলী সিরাজগঞ্জ এসডিও কোর্টে চাকুরি করতেন। ১৯৭১ সালে জ্ঞানদায়িনী স্কুলে এসএসসি পরীক্ষার্থী। শহরে মিলিটারি আসার গুজব ছড়িয়ে পড়ায় পবিরাব চলে যায় গ্রামের বাড়িতে। বাসায় রেখে যায় মির্জা আব্দুর রাজ্জাক আর তার মামাতো ভাই দেলোয়ার হোসেনকে। পাকিস্তান সেনা আসার পর তারা বাসা ত্যাগ করে। এর দুই মাস পর রাজ্জাক ফিরে আসে তাদের বাসায়। শহরে তখন লোকজন খুবই কম হলেও কিছু লোকজন বসবাস করছে। তার মধ্যে তার কিছু বন্ধুবান্ধবও রয়েছে। এরা সবাই ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ করতেন। তারা একটা কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী মির্জা আব্দুর রাজ্জাক লেখক-সংগঠকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন-‘আমাদের যুদ্ধ কৌশল অনূযায়ী ‘অপেক্ষাকৃত দূর্বল স্থানে আঘাত’ করার সিদ্ধান্ত নেই। বাগবাটী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সেখানকার শান্তি কমিটির নেতা ঘোড়াচড়ার বাসিন্দা মফিজ ভূঁইয়া [তিনি মহুকুমা শান্তি কমিটির প্রভাবশালী নেতা তরিকুল ইসলাম লেবু মিয়ার শশুর] প্রতিদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসতেন বাহিরগোলায়। সেখানে তিনি লেবু মিয়ার বাড়ির সামনের হিন্দু সম্প্রদায়ের সুধা ঘোষের পরিত্যাক্ত বাড়ি দখলে নিয়েছিলেন। তাকেই ‘হিট’ করার সিদ্ধান্ত নেই আমরা। অক্টোবরের মাঝামাঝি পরিকল্পনা কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়ে এগোতে থাকি। সেদিন ভোর বেলা। মফিজ ভুঁইয়া হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছেন বাহিরগোলায়। আমি আর জহুরুল ইসলাম বকুল তাকে ডেকে নেই তার দখল করা সুধা ঘোষের বাড়ির ভিতরে। এ কথা সে কথা বলতে বলতে আমাদের কাছে লুকিয়ে রাখা ড্যাগার ঢুকিয়ে দেই তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে। দূর্বল শরীরের মানুষটি আচমকা আঘাতে সহজেই ঢলে পড়ে সেখানেই। আমরা ধীরে সুস্থে ড্যাগার দু’টো ফেলে দিয়ে খাল পাড় হয়ে চলে যাই রাণীগ্রামের দিকে। এ ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিপুল সাহস জোগায়।’ বকুল ও রাজ্জাক যোগাযোগ রাখতেন ইসমাইল গ্রুপের সঙ্গে। স্বাধীনতার পর অস্ত্র জমা দেন প্রবাসী সরকারের অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীর কাছে। তবে নিবন্ধিত মুক্তিযোদ্ধা নন। যাইহোক, জহুরুল ইসলাম বকুল সিরাজগঞ্জ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এবং মির্জা রাজ্জাক একই সংগঠনের সদস্য হন।
যাইহোক, এলাকায় আওয়ামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল কম, ফলে বামপন্থীদের ছিল অবাধ বিচরণ। সেপ্টেম্বর থেকে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসতে থাকে। ফলে ‘বামপন্থী’রা চাপে পড়তে শুরু করে। তারা এমনিতেই গোপনীয়তার প্রতি সজাগ ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ ভুঁইয়া জানান, ‘এক রাতে শেল্টার নেওয়ার জন্য যাই এক বাড়িতে। এই বাড়িতে আগেও শেল্টা নিয়েছি। কিন্তু সেদিন আমাকে আশ্রয় দিতে রাজী হন না তিনি। আমি অবাক হই। এত রাতে যাব্ইো বা কোথায়? কিন্তু তিনি কোনোক্রমেই থাকতে দিতে চাইলেন না। তার বাড়ি থেকে বের হয়ে পথে নামি। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কেন এমন হলো? কিছু দূর যেতেই বাড়িওয়ালা আবার দৌড়ে এলেন। বললেন, চলেন আমার বাড়িতেই থাকবেন, অসুবিধা নাই। আমি দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যাই, এক ধরণের কৌতুহল জাগে আসল ঘটনা খুঁজে বের করার। তাই ফিরে আসি তার বাড়িতে। ঘরে ঢুকেই আমি তো অবাক! সেখানে আশ্রয় পেতেছেন সিরাজগঞ্জ ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রবীর কুমার নিয়োগী [পরবতীতে সিরাজ শিকদারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, ছদ্মনাম কামাল হায়দার।]’ তারপর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প করতে করতে পাশাপাশি ঘুমিয়ে পড়েন। ফিরোজ ভুঁইয়া ঘুম থেকে ওঠার আগেই বিদায় নেন প্রবীর নিয়োগী। যুদ্ধকালীন সময়ে আর প্রবীর নিয়োগীর সঙ্গে আর দেখা হয়নি ফিরোজ ভুইয়ার। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধ আবু তাহের জানান, ‘নভেম্বর মাসে এলাকা ত্যাগ করে টাঙ্গাইলের দিকে চলে যান প্রবীর নিয়োগী।’
এভাবে এলাকা ছাড়তে থাকে ‘বামপন্থী’রা। এ পরিস্থিতিতে দেশ স্বাধীন হয়, পলাতক হয় পাকিস্তানি প্রশাসনও। মুক্ত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয় মুক্তিযোদ্ধারা, কারণ সিরাজগঞ্জে তখনো যৌথ বাহিনী পৌছেনি। ‘বামপন্থী’দের বিষয়ে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের একডালা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন তাঁর যুদ্ধস্মৃতিতে জানান, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এবং প্রশাসন চালু করতে বিভিন্ন থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো হয়। কামারখন্দ থানা মুক্তিযোদ্ধা প্রশাসনের দায়িত্ব পেয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল কুমার দাস। আমাদের দলকে পাঠানো হয় কামারখন্দের ঝাঁটিবেলাই গ্রামে নক্সালপন্থী দমনের উদ্দেশ্যে। এ সময় বেশ কয়েক জনকে নক্সালপন্থী হিসেবে আটক করা হয়। কিন্তু দেখা যায়, নক্সালপন্থীদের প্রধান ব্যক্তিরা পাকিস্তান প্রশাসনের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে ইতিমধ্যেই এলাকা ত্যাগ করেছে।’
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, আহ্বায়ক-সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।