আফগানিস্তান কোন পথে?
রণেশ মৈত্র
বিশ্বব্যাপী প্রায় সকল গণমাধ্যমে সদ্য বিজয়ী (?) তালেবানদের ক্ষমতায় আসা ও আমেরিকানদের ও তাদের সৈন্য ও নাগরিকদের আফগানিস্তান ত্যাগ আজ শিরোনাম পেয়েছে। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে-এই পরিবর্তন আফগান নাগরিকদের মনে কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে, তাঁরা কীভাবছেন, কী করছেন তা ঐ সকল গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ ওই দেশের জনগণই আসল শক্তি, আসল লাভবান অথবা আসল ক্ষতির সম্মুখীন।
মনে পড়ে ছোটবেলার কথা। জন্মসূত্রে প্রায় ১৫ বছর বয়স পর্য্যন্ত গ্রামেই বাস করেছি-প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে মাধ্যমিকে সপ্তম শ্রেণীর বাৎসরিক দেওয়া পর্য্যন্ত গ্রামেই ছিলাম। তখন দেখেছি এক মস্তবড় কাপড়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে, হাতে লাঠি নিয়ে গ্রামে গ্রামে এক ধরণের অবাঙালি কারও কারও বাড়ীতে যাচ্ছেন-দাবী করছেন তাঁদের দেওয়া ঋণের টাকা শোধ করতে। শ্বেতবর্ণ, দীর্ঘদেহ ঐ মানুষগুলি আধো বাংলা, আধো ঊর্দুতে কথা বলতেন। টাকা না পেলে কোথাও কোথাও বলতে শুনেছি “আসলি নেহি তো সুদ দো” যেন সুদের টাকাটাই তাঁদের মূল দাবী ঋণের আসলা টাকা নয়।
পরে যখন শহরে এলাম স্থায়ীভাবে তখন পাবনা বাজারে দেখতাম বেশ কিছু সংখ্যক আফগানকে নৈশ প্রহরী হিসেবে বাজার এলাকা প্রহরা দিতে যতটুকু মনে পড়ে, তাদের হাতে কদাপি বন্দুক-রাইফেল দেখিনি- দেখেছি কাউকে কাউকে খালি হাতে ঘুরতে, কেউ বা হাতে লম্বা একটা লাঠি আবার কেউ বা ফালা হাতে নিয়ে বাজার প্রহরা দিতেন। ওঁদের কাছে থাকতো বিপদ সংকেত জানানো বাঁশি বা হুইসেল ও টর্চলাইট। বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তাঁরা পূরো বাজার এলাকা পাহাড়া দিতেন-রাতের বেলা পাহাড়া দান কালে কেউ কদাপি একা ঘুরতেন না। এভাবে গ্রামে যাঁদেরকে ঋণের টাকাও সুদ আদায় করতে বা শহরে যাঁদেরকে বাজার পাহাড়া দিতেন দেখতাম-তাঁদেরকে আমরা কাবুলিওয়ালা বলে ডাকতাম বা জানতাম। জানতাম সাধারণ অর্থে সৎ ও সাহসী বলে। গ্রামে যাঁরা ঘুরতেন তাঁরা বছরের শীত ঋতুতে আসতেন অন্য সময় তাঁদেরকে দেখা যেত না। শীত শেষে তাঁরা চলে যেতেন তাঁদের নিজ দেশে-আবার ফিরতেন পরবর্তী শীতে। কিন্তু শহরে যাঁরা থাকতেন তাঁরা স্থায়ীভাবে থাকতেন ততবে স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে থাকতেন এমন কথা শুনি নি। অথবা এঁদের কোন দুর্নামও কারও মুখে শুনি নি। বরং এঁদের সাহস ও সততা ছিল সর্বজনস্বীকৃত।
অষ্টম শ্রেণীতে পাবনা শহরে এসে যখন ভর্তি হই, তার কিছুকাল পর থেকেই ভাষা আন্দোলনে যেমন অংশ গ্রহণ করি, তার পর থেকেই রুশ বিপ্লবের প্রতি, সমাজতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা, শোষণ মুক্তি, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সকল প্রকাশ বৈষম্যের বিরোধিতার ও স্বদেশ চিন্তা স্থায়ীভাবে মাথায় বাসা বাঁধে। বস্তুত: ১৯৫০ সালে শিখাসংঘ নামক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলে অসংখ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ও প্রাথমিক স্তরে মার্কসবাদী বই পত্র পড়া ও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং সুকান্তের কবিতা, গোপাল হালদার ও অপরাপর মার্কসবাদী লেখকের লেখা গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও তাত্ত্বিক লেখা প্রভৃতি পাঠের মাধ্যমে ঐ চেতনা গড়ে ওঠে। ঐ সময় থেকেই বিশেষ করে ১৯৫২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের শাখা গঠন এবং তার কার্য্যকলাপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতিও আকৃষ্ট হই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, বৃটিশ, ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের গোটা বিশ্বের মানুষের শত্রু এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক দেশ সমগ্র বিশ্বের জনগণের মি ত্র।
তাই পৃথিবীর যে দেশেই বিপ্লব ঘটেছে বা ঘটছে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন ভিয়েতনাম, কোরিয়, আলজেরিয়া, কিউবা প্রভৃতি দেশের জনগণের প্রতি-তাদের বিপ্লবী যোদ্ধার প্রতি স্বত:স্ফূর্ত সমর্থন নানা সমাবেশ থেকে জানিয়েছি।
এবারে, ওই পটভূমিতে আসা যাক মূল আলোচ্য আফগানিস্তান প্রসঙ্গে। ওই দেশটির রাজনীতি-অর্থনীতি তেমন কিছু জানার সুযোগ ঘটেনি ২০০৮ সালের আগ পর্য্যন্ত। আরও বেশী কারণ দেশটি বহুলাংশে মৌলবাদ ষেঁষা বলে পরিচিত থাকার কারণে। যেমন আগ্রহ অনুভব করিনি সৌদি আরব, কামাল আতাতুর্ক-পরবর্তী তুরস্ক, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠির প্রতি। এরা সকলেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুগত দেশ-সে কারণেই মূলতঃ।
কিন্তু অন্তত: পক্ষে আমার দৃষ্টিতেআফগানিস্তানের প্রতি আগ্রহ জনালো ঐ দেশে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে। তখন জানা গেল, এই নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত আগে আফগানিস্তানে একধরণের মৌলবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং ওই সরকারের পিছনে প্রাকশ্য সমর্থন ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের । পাকিস্তান সরকারের সমর্থন ও ছিল তাদের প্রতি। সে সময় ভারতে মোটামুটি অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতন্ত্রে সমর্থক এবং তৃতীয় বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জোটের অন্যতম নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকার ও আমেরিকা ও পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় ভারত সহ জোট নিরপেক্ষ তৃতীয় বিশ্বের জোটের কোন প্রকার সমর্থন আফগান সরকারের প্রতি ছিল না। তবে অকুণ্ঠ চিত্তে ভারতসহ তৃতীয় বিশ্বের জোট নিরপেক্ষ দেশগুলি অকুণ্ঠ সর্মথন জানিয়েছিল সোভিয়েত সমর্থিত নতুন আফগান সরকারের প্রতি। যদিও সোভিয়েত সমর্থিত ঐ সরকারটি সে দেশের কোন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। বস্তুত: আজতক আফগানিস্তানে কখনও সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে সে দেশের গোপন বামপন্থী দল সামরিক বাহিনীর এক অংশের সর্মথনে অকস্মাৎ একটি প্রগতিশীল সরকার গঠন করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সমগ্র সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব তার প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করে।
৯/১১র ঘটনা আমেরিকা সহ সারা বিশ্বে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তখন আমেরিকার সুউচ্চ চাওয়ার, বাজার-বিপণী, আবাসিক এলাকা আকস্মিক বোমা ও গোলাবর্ষণে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করেছিল অষংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। এই ভয়াবহ হত্যালীলার পর মার্কিন সরকার এর জন্য ইসলামী জঙ্গীবাদীদেরকে দায়ী বলে ঘোষণা করেছিল। তখন থেকে মার্কিন স রকার ঐ মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করেছিল।
কিন্তু যেই মাত্র আফগানিস্তানে সোভিয়েত সমর্থিত প্রগতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো, মুহুর্তকাল বিলম্ব না করে আফগানিস্তান ও তার পাশ্ববর্তী এলাকায় অবস্থিত পাকিস্তানে তালেবানদের সমর্থীকই না-রুশ সমর্থিত আফগান সরকারকে উৎখাতের জন্য তাদেরকে উৎসাহিত করে তোলে। সি.আই.এ. আই এস আই প্রভৃতি অস্বাভাবিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করে ঐ সরকার যেন তেন প্রকারে উৎখাতের। সে কারণে তারা ইসলামী মৌলবাদীদের দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এবং তাদেরকে মিলিয়ন-মিলিয়ন ডলার অর্থ, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয় তালেবানদের।
রুশ-সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্য্যন্ত অর্থাৎ ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্য্যন্ত তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানে নারীদের মুখ, চুলসহ সম্পূর্ণ দেহ ঢাকা বোরখা পরা বাধ্যতামূলক ছিল। মেয়েদের বয়স ১০ বছরের বেশী হলেই স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। শরিয়া আইনের নামে তারা চালু করেছিল দোবরা ও পাথর ছুঁড়ে হত্রার মত ভয়ংকর শাস্তি।
অপরদিকে সোভিয়েত সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মেয়েদেরকে সকল বৈষম্যমূলক বন্ধন থেকে মুক্তি দেওয়া হয় তাদের জন্য উচ্চতম শিক্ষাগ্রহণ ও চাকুরীসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে নারী সমাজকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। নতুন নতুন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয় এবং ঐ সরকার তাবৎ জনহিতকর কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের প্রগতিমনা ও শমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের মধ্যে জনপ্রিয়াত অর্জন করতে থাকে।
আফগানিস্তানের জনগোষ্ঠি বিপুল সংখ্যায় মুসলিম। তাদেরকে এতকাল শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল-আধুনিকতার কোন ছোঁয়াও সে দেশের মানুষকে স্পর্শ করার কোন সুযোগ দেওয়া হয় নি। তাই অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত আফগান মুসলিমদেরকে ধর্মের নামে উস্কে তোলা সি.আই.এ ও আই এস আই এবং তালেবানদের জন্য অত্যন্ত সহজ হয়ে পড়ে। সোভিয়েত সমর্থিত সরকারকে নাস্তিক ও ইসলাম-বিরোধী সরকার বলে ব্রাপক প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে হিংশ্রতার মুখে ঠেলে দেওয়ার সহজ হয়ে পড়ে। দেশের গণতন্ত্রী, আধুনিক উদারপন্থী ও প্রগতিশীল আফগানরা হয়ে পড়েন মারাত্মকবাবে সংখ্যালঘিষ্ট।
একের পর সন্ত্রাসী আঘাত হানা হতে থাকে রুশ সমর্থিত সরকার তার মন্ত্রী ও আমলাদের বিরুদ্ধে। অবরোধ মুক্ত মেয়েদেরকে নানা অপবাদের মাধ্যমে হতাশা গ্রস্ত করে তোলা হয়। গোটা জাতি হয়ে পড়েন সিস্পৃহ, নিস্ক্রিয় ও স্থবির। এই পরিস্থিতি এবং তা ছাড়াও রাজনৈতিক দলুগুলি জনতার মাঝে তেমন ঠাঁই করে নিতে না পারা এবং কার্যত: জনসমর্থিত কোন রাজনৈতিক না গড়ে ওঠায় তার সুযোগ নিয়ে এবং মার্কিন ও পাকিস্তানী সকর প্রকার বৈষয়িক সহযোগিতার কারণে তালেবানরা সোভিয়েত সমর্থিত সরকারকে উৎখাত করতে সমর্থন হয়। পুনরায় চালু হয় প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গী শাসন। ১/১১ র ঘটনার মাধ্যমে আমেরিকা ও সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি যতটাই ইসলামী জঙ্গীবাদের যতটাই বিরোধী হয়ে উঠেছিল, আফগানিস্তানে রুশ সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ততোধিক ঐ জঙ্গীদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে পড়ে।
সেই পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমেই রুশ-পন্থী সরকার উৎকাত করে আফগানিস্তানে তারা মার্কিন সমর্থক তাঁদের সরকার গঠন করে। অস্ত্রের জোরে এই সরকার ২০ টি বছর ঐ দেশে আমেরিকার তাঁবেদার একটি পুতুল সরকার দিয়ে দেশ পরিচালনা করে। এই সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থাননের উগ্রপন্থী তালেবানদের তারা তাঁবেদার আশরাফ ঘনির সরকারকে উৎখাত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এই তালেবানরা আফিন পাচার, কালোটাকা ও নানা অসৎপথে এবং দেশ-বিদেশের নানা সূত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিকানা অর্জন করে। বিস্ময়কর হলেও সত্র, আমেরিকাও তাদেরকে অস্ত্র সজ্জিত করে অর্থ সংকুলান করে। এই দ্বৈত নীতি আমেরিকার জন্য নতুন নয়।
অবশেষে ২০ বছর পর তালেবানরা ক্ষমতায় এলো। এই নিবন্ধ লেখা পর্য্যন্ত তারা তাদের মন্ত্রীসভা ঘোষণা করতে পারে নি। অনুমান করা যায়, তালেবানদের মধ্যে তীব্র উপদেশীয় বিরোধ থাকার কারণেই মন্ত্রীসভা গঠনে বিলম্ব হচ্ছে।
অপরদিকে আই সিস নামক আন্তর্জাতিক ইসলামী জঙ্গী সংগঠন তালেবানদের সশস্ত্র বিরোধিতায় নেমেছে-তেমনই আবার পাঞ্চশিরা প্রদেশ তালেবানদের বশ্যতা স্বীকার না করে তালেবানদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র রড়াই সুরু করেছে। লাখে লাখে নারী পুরুষ শিশু তাদের মাতৃভূমি আফগানিস্তান ছেড়ে বিদেশ পালাচ্ছে। অপরপক্ষে রাশিয়া, চীন, ভারত ও আমেরিকা তাদেরকে স্বীকৃতি দেবে বলে মনে হয়।
লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।