সাইফুল ইসলাম


পঞ্চাশ বছর পরেও স্বাধীনতা বিরোধী রাজনীতি সমাজ ও দেশে টিকে থাকার সুযোগ পাওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জটিল হয়ে পড়েছে। তাই ঝেঁটিয়ে বিদায় করা দরকার মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঢুকে পড়া বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর তথ্য ও তত্ব। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে হবে একাত্তরে দাঁড়িয়ে, আর এতো দিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের উপরে পড়া ধুলিকে সরিয়ে দিতে হবে সচেতনভাবে। এজন্য প্রয়োজন একটি সামাজিক আন্দোলন। নতুন করে পাঠ করা দরকার মুক্তিযোদ্ধা, জনগণ, শহিদ পরিবার- এমনকি সে সময়ের ইতিহাস ভূগোল- সব কিছু। ‘পথের ধুলো থেকে’ সেই দেখার, অভিজ্ঞতার সার-সংকলন। ইতিমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও বিএলএফ মুক্তিযোদ্ধাদের সাদামাটা মূল্যায়ন দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে, এবার দেখা যাক এফএফ মু্িক্তযোদ্ধাদের কী কী উপাদান সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে লেখক সংগঠকদের। বলে নেওয়া ভালো যে, এ উদ্যোগ যে কোনও ভাবে হোক অব্যাহত থাকতে হবে এবং ধীরে ধীরে তা গভীর থেকে আরো গভীরতা ও সঠিকতায় পৌঁছতেই। এটা দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। না হলে যে পূর্ণতা পাবে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ।

২৫ মার্চ পাকসেনারা হামলা চালানোর পর বিপুল সংখ্যক বাঙালি তরুণ প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র পাওয়া উদ্দেশ্যে সীমান্ত পার হয়। প্রবাসী সরকার গঠণের পর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এই সব তরুণদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ৩০ এপ্রিল। মে মাসেন তৃতীয় সপ্তাহে প্রায় দুই হাজার যুবকের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। চার/পাঁচ সপ্তাহ মেয়াদী এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মান অবশ্য খুবই সাধারণ, মূলত শেখানো হতো সাধারণ হাল্কা অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবহার। পরে এ প্রশিক্ষণের সময় কমিয়ে আনা হয় মাত্র তিন সপ্তাহে। অনিয়মিত যুদ্ধে নিযুক্ত ছাত্র-তরুণদের এ বাহিনীর নামকরণ করা হয় গণবাহিনী, যদিও তারা মু্িক্তযোদ্ধা বা এফএফ নামে পরিচিতি পায়। জুন, জুলাই, আগস্টে প্রায় পনের হাজার এবং সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে মোট কুড়ি হাজার করে মোট ষাট হাজার এফএফকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে, এই সব তরুণদের প্রস্তুত করা হয় দেশের ভিতরে স্ব স্ব এলাকায় গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে আসলে কী ঘটেছে এই সব তরুণদের ভাগ্যে?

লেখক-সংগঠকদের কাছে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিচারণ করেন। এসব স্মৃতিচারণ সিরাজগঞ্জের স্থানীয় পত্রিকা এবং পরে ‘১০ মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধস্মৃতি’ শিরোনামে বই আকারে প্রকাশিত হতে থাকে। বেহুলা বাঙলা প্রকাশণ থেকে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয় এর প্রথম ও দ্বিতীয় খ-, তৃতীয় খ- প্রকাশের পথে। এই সব গ্রন্থে প্রকাশিত বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ নূরনবীর স্মৃতিচারণ অনুযায়ী, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে ৬ তরুণ পালিয়ে বের হন জুলাইয়ের শেষ দিকে। নানা পথঘাট পেরিয়ে ভারত চলে যান এবং ভারতের নদীয়া জেলার কেচুয়াডাঙ্গা ইয়থ ক্যাম্পে ভর্তি হন। ১৫ আগষ্ট ইয়থ ক্যাম্পে থেকে তাদের রিক্রুট করে নিয়ে যাওয়া হয় মূল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। ওই ক্যাম্পে তাদের ৪০ দিন প্রশিক্ষণ শেষে টিম গড়া হয়, কমান্ডার নিযুক্ত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রাকসু সদস্য কুয়াত-ইল ইসলাম। তাঁর বাড়ি একই এলাকার হলেও তিনি গ্রুপে অন্তর্ভূক্তদের সাথে পরিচিত ছিলেন না। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের গ্রুপকে নিয়ে আসা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তের মেদিনিপুর ক্যাম্পে। বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ নূরনবী জানান, ‘সেখানে ভারতীয় সেনাদের নিয়ন্ত্রণে আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হলো ভারতীয় ডিফেন্সে। আমরা নিয়মিত সীমান্ত পাহারা দিতে লাগলাম, পাশাপাশি রাতে সীমান্ত পার হয়ে পেছন দিক থেকে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালাতাম।’ এক মাসেরও বেশি সময় তাদের যুদ্ধ করতে হয় এখানেই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন বানুর বাড়ি সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে। তিনি জুন মাসের প্রথমেই চলে যান কুড়িগ্রামের রৌমারী ইয়থ ক্যাম্পে। ওই মাসেই তিনি চলে যান দার্জিলিংয়ের মুর্তিনালা মুজিব ক্যাম্পে। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন বানু বলেন, ‘আমাদের ধারণা ছিল, প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্র, গোলাবারুদ দিয়ে আমাদের পাঠানো হবে নিজ এলাকায়। কিন্তু তা পাঠানো হলো না, আমাদের পাঠানো হলো রংপুরের হাতিবান্ধা সীমান্ত এলাকায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার পর আমাদের এলাকায় ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়। কারণ, সীমান্ত এলাকা থেকে তখন পাকিস্তানিরা যুদ্ধের চাপে কেন্দ্রের দিকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছিল। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত এলাকায় থাকার প্রয়োজন ছিল না। এজন্য বিএসএফের ব্যবস্থাপনায় আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় মাইনকার চরে।’ সেখান থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন বানুরা নিজ এলাকায় চলে আসেন, ততদিন তার এলাকা মুক্ত হয়ে গেছে প্রায়। একই গ্রুপের বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, তাদের দেশের ফেরার সময় ভারত কতৃপক্ষ তাদের অস্ত্র রেখে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিবাদের মুখে তা সম্ভব হয়নি।

কিন্তু কোনও কোনও এফএফ গ্রুপ কিভাবে দেশের ভিতরে যুদ্ধ করার সুযোগ পেলো? এরও চমকপ্রদ খবর পাওয়া যাচ্ছে সাধারণ এফএফ মুক্তিযোদ্ধার বিভিন্ন জনের স্মৃতিচারণে। যেমন এফএফ ভূক্ত বীর মু্ক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ নুরনবী তার গ্রুপের সঙ্গে সেপ্টেম্বরে নিজ এলাকায় আসার সুযোগের ব্যপারে বলেন, ‘আমাদের প্রশিক্ষণ গেরিলা যুদ্ধের, কিন্তু আমাদের লাগানো হলো নিয়মিত যুদ্ধে, অথচ এ যুদ্ধে আমরা সত্যি অনভিজ্ঞ। ফলে এ যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রায়ই এফএফ যোদ্ধাদের প্রাণ হারাতে হতো। আমরা এফএফদের দিয়ে সীমান্ত যুদ্ধ করানোর ব্যাপারে সমালোচনা শুরু করি। কখনো যুদ্ধে যেতে অস্বীকারও করতে শুরু করি। একদিন আমাদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। আমার ধারণা, কতৃপক্ষ বুঝতে পারেন, আমরা সবাই স্কুল-কলেজের ছাত্র এবং ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমাদের এই সমালোচনা একদিন বিদ্রোহে রূপ নিতে পারে, তাই দ্রুত আমাদের দেশের ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের সীমান্ত ছেড়ে দেশের ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’

আরো চমকপ্রদ খবর পাওয়া যায় এফএফ ভূক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাব হোসেনের স্মৃতিচারণে। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের পাঠানো হয় কর্নেল তাহেরের অধীন ১১ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার মহেন্দ্রগঞ্জে। আমার জন্য বরাদ্দ করা হয় এলএমজি, আমার সহকারী করা হয় মাধবকে। ওই [গ্রুপের] একশ’ জন থেকে ৬০ জনকে বাছাই করা হয়। আমাদের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় অবরুদ্ধ এলাকায় যাওয়ার জন্য। কারণ, আমরা গেরিলা যোদ্ধা, দেশের ভিতরেই আমাদের যুদ্ধ করার কথা। আমরা দেশের ভিতরে [জামালপুর] কামালপুর এসে একটি স্কুলঘরে আশ্রয় নিই। সম্ভবত এলাকার কোনও স্বাধীনতা বিরোধী আমাদের আশ্রয় নেওয়ার খবর জেনে তা জানিয়ে দেন পাকিস্তান সেনাদের। পরদিনই আমাদের ওপর এসে হামলা চালায় পাকিস্তানিরা। কোনও গুলি ছোঁড়ার সুযোগই পাইনা আমরা।’ এই মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপটি তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং ফিরে আসে মহেন্দ্রগঞ্জে। সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের হাতে থাকা অস্ত্র কেড়ে নেয় এবং যেকোনও ডিউটি থেকে নিস্ক্রিয় করেন। পরিস্থিতি অনুধাবন করে ভীত মুক্তিযোদ্ধারা ওই ক্যাম্প থেকে পালিয়ে চলে আস মরণটিলায়। এরপর, সিরাজগঞ্জের এমপি সৈয়দ হায়দায় আলী তাদের নিয়ে যান ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক কর্নেল নুরুজ্জামানের কাছে। মুক্তিযোদ্ধারা কর্নেল নুরুজ্জামানের কাছে সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ করার কথা অস্বীকার করে তারা তাদের নিজ এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। জনাব আলতাব হোসেন বলেন, ‘তিনি [কর্নেল নুরুজ্জামান] তখন সামরিক ম্যাপ বের করেন। সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন ব্রিজ, বিশেষ করে রেলব্রিজ গুলো দেখান। বলেন, এই রেল ব্রিজগুলো সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ধ্বংস করতে পারলে তার প্রভাব পড়বে সারাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। আমরা প্রতিশ্রুতি দেই, এসব ব্রিজ ধ্বংস করবো। এ প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরই তিনি আমাদের দেশের ভিতরে পাঠাতে রাজী হন।’ উল্লেখ্য, সিরাজগঞ্জ ৭ নম্বর সেক্টরভূক্ত এলাকা। যাইহোক, লেখক-সংগঠকদের অনুসন্ধান মতে, এফএফএর নুরুননবী ও আলতাবদের গ্রুপই প্রথম সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে পা রাখতে সক্ষম হয়, সেটাও সম্ভব হয় সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে। তারপরে আসে এফএফের অন্যান্য গ্রুপ।

২১ নভেম্বর সীমান্ত এলাকায় নিয়োজিত থাকা বিভিন্ন ফোর্স এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয় বাংলাদেশ সেনা বাহিনী। সেদিনই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয় যৌথ বাহিনী। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্ব। ফলে যুদ্ধের চাপ কমে আসায় সীমান্ত এলাকায় এফএফ সদস্যদের প্রয়োজনীয়তাও কমে যায়। তখন সীমান্ত এলাকা থেকে ছাড় দিয়ে এফএফ সদস্যদের দেশের ভিতরে পাঠানো শুরু হয়। কিন্তু গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা এফএফ মুক্তিযোদ্ধাদের পঞ্চাশ ভাগ নিজ এলাকায় পা-ই রাখতে পারেনি বলে মনে হতে থাকে লেখক-সংগঠকদের।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, আহ্বায়ক- সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।