পথের ধুলো থেকে : পর্ব-১১
‘কামারপাড়া ক্যাম্পে ভর্তি হওয়ার কয়েকদিন পরেই ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন কর্নেল এমএজি ওসমানী ও সিরাজুল আলম খান’
সাইফুল ইসলাম
জুন মাসে ভারতের দুটি ক্যাম্পে শুরু হয় বিএলএফেল প্রশিক্ষণ। প্রথম ব্যাচে ৪৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ হয় জুলাই মাসে। তারপরে দেশের ভিতরে ঢুকতে শুরু করে এই যোদ্ধারা। অথাৎ আগষ্ট মাসের প্রথম দিকে এরা দেশের ভিতরে ঢোকার সুযোগ পায়। তবে ‘মুুজিব বাহিনী প্রথাগত সেনাবাহিনী নয়। এটি একটি সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন। মুজিব বাহিনীর মূল রণকৌশল ছিল প্রথাগত যুদ্ধে না জড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের অনুকুলে জনযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেশকে মুক্ত করা।’ এর যোদ্ধা সংগ্রহের ব্যপারে বলা হয়, এরা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ থেকে রিক্রুট করা হবে। প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানেচ্ছু তরুণের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক ছাত্রলীগ কর্মী বিএলএফ প্রশিক্ষণ থেকে বাদ পড়েন। যেমন, বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে এর সদস্য সংগ্রহ শুরু হয়। এর মধ্যে কামারপাড়া ক্যাম্প থেকে প্রথম ব্যাচের সদস্য সংগ্রহ করা হয়্, অথচ এখানেই অবস্থানরত সিরাজগঞ্জ ছাত্রলীগ কর্মী খ ম আকতার হোসেন, ফজলুল মতিন মুক্তা, রেজাউল হক জিন্না প্রমুখ বাদ পড়েন। রিক্রুট হন- আব্দুল লতিফ মির্জা, মোজাম্মেল হোসেন মোজাম, আব্দুল সামাদ [তৎকালীন রাকসুর জিএস-বাড়ি বেড়া], ইসহাক আলী, গোলাম কিবরিয়া, আব্দুল আজিজ মির্জা, বিমল কুমার দাস, আমির হোসেন খান, আব্দুল আজিজ ব্যারিস্টার, লুৎফর রহমান দুদু, মঞ্জুরুল হক ভূঁইয়া, হাবিবুল্লাহ, আব্দুল বাকী মির্জা, ইফতেখার মবিন পান্না ও ফিরোজ ভুঁইয়া। দুটি তালিকা দেখলে সহজেই বোঝা যায় য়ে, রিক্রুট নীতিতে যেটা বলা হয়েছে, সেটা মানা হয়নি কৌশলে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রলীগ নেতা রিক্রুট থেকে বাদ পড়লেও ওই সময়ের গুরুত্বহীন অনেকেই বিএলএফ প্রশিক্ষণে সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু শেষে দিকে এসে যখন দেশের ভিতরে মুক্তিযুদ্ধটা জমে উঠেছে, তখন কলেজ পড়ুয়া যাকে পাওয়া গেছে, তাকেই বিএলএফের প্রশিক্ষণে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ তথ্য জানা যায় বিএলএফে প্রশিক্ষণ পাওয়া আব্দুল মোমিনের কাছে থেকে। লেখক-সংগঠকদের কাছে তিনি বলেন- তিনি আগে কখনোই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু মাইনকার চরের মরণটিলা ক্যাম্প থেকে তিনি বিএলএফ সদস্য হিসেবে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান।
যাইহোক, রিক্রুটের সময়েই প্রবাসী সরকারের সঙ্গে বিএলএফের চোর-পুলিশ খেলার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে কারো কারো কাছে। লেখক-সংগঠকের অনুলিখন করা বিএলএফ প্রথম ব্যাচের বীর মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ ভূঁইয়া তার স্মৃতিচারণে বলেন- ‘কামারপাড়া ক্যাম্পে ভর্তি হওয়ার কয়েকদিন পরেই ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন কর্নেল এমএজি ওসমানী ও সিরাজুল আলম খান। তারা আমাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। এদিকে সিরাজুল আলম খান কানে কানে কিছু একটা নির্দেশ দিয়ে যান সিরাজগঞ্জ ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আব্দুল লতিফ মির্জাকে। তিনি গোপনে রাজনৈতিক বিবেচনায় সিরাজগঞ্জ ছাত্রলীগের কর্মীদের একটি তালিকা করেন। গোপনীয়তা রক্ষা করে ক্যাম্প থেকে বের করে নিয়ে আসেন তালিকাভূক্তদের। একটি নির্দিষ্ট স্থানে মিলিত হই আমরা। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মোস্তফা মোহসীন মন্টু ও কামরুল ইসলাম খসরু। সঙ্গে ভারতীয় সেনাাবাহিনীর একটি লড়ি। সে লড়িতে তোলা হয় আমাদের।’ এ ঘটনা কিন্তু ওই সময়ে জানতে পারেন নি প্রবাসী সরকারের মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল এমএজি ওসমানী। মানে তাকে আড়াল করেই সিরাজুল আলম খান বিএলএফের সদস্য সংগ্রহ করেছেন।
কামারপাড়া ক্যাম্প থেকে রিক্রুট করা ১৫ জনকে নিয়ে যাওয়া হয় বিএলএফের ইয়থ ক্যাম্প পাঙ্গায়। সেখানে বিএলএফের চার নেতার সঙ্গেই এদের আলোচনা হয়। এ সময় তাদের আদর্শ সম্পর্কে বলা হয়, মুজিবের আদর্শ স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে মুজিবের আদর্শ প্রতিষ্ঠাই বিএলএফের লক্ষ্য। পরে এই ১৫ জনকে নিয়ে বসেন বিএলএফের অন্যতম প্রধান সিরাজুল আলম খান এবং তার সহকারি মনিরুল ইসলাম মার্শাল মনি। এবারের বৈঠকে আলোচনা হয় পাবনা জেলার যুদ্ধের কৌশল নিয়ে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে আব্দুল লতিফ মির্জাকে দেশের ভিতরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফিরোজ ভূঁইয়া সহ বিএলএফ প্রথম ব্যাচের আরো কয়েক জনের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, লতিফ মির্জা দেশের ভিতরে ঢুকে বিভিন্ন ইউনিয়নের সঙ্গে যোগায়োগ [বিমল কুমার দাসের ভাষায় পোষ্ট অফিস] এবং বিএলএফ সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয়-ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া বিএলএফ সদস্যরা সেখানে আশ্রয় নিয়ে তাদের সংগঠন গড়ে তুলবেন। সুনির্দিষ্ট এসব দায়িত্ব নিয়ে দেশের ভিতরে চলে আসেন আব্দুল লতিফ মির্জা। অন্য ১৪ জনকে পাঠানো হয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প দেরাদুনে।
দেরাদুনের চাকতারায় অন্যান্য জেলার সঙ্গীদের নিয়ে শুরু হয় ৪৫ দিনের প্রশিক্ষণ। অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষকেরা। পাশাপাশি অস্ত্র প্রশিক্ষণের ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ। ফিরোজ ভূঁইয়ার ভাষ্য অনূযায়ী রাজনৈতিক প্রশিক্ষণে বলা হয়- ‘বিএলএফ রাজনৈতিক যোদ্ধা। এ যুদ্ধ চলতে পারে ৫/৭ বছর ধরে। এ সময়ের মধ্যে জনসংগঠন গড়ে তুলতে হবে। প্রথমে গ্রাম কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি এবং ধারাবাহিক ভাবে থানা কমিটি, মহুকুমা কমিটি। এসব কাঠামো গড়ে তুলতে হবে জনগণ দ্বারা। জনগণের উপর নির্ভর করে যুদ্ধ করতে হবে। গ্রামীণ কাঠামোর কথা বলতে গিয়ে নেতারা কখনো কখনো সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণচীনের ‘সোভিয়েত’ ‘কমিউন’এর উদাহরণ দিতেন। তারা আরো বলতেন, এসব কাটামো গড়ে তুলতে পারলেই আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলার স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছেন, সেই সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব।’
অন্যান্য জেলার বিএলএফ সদস্যদের সঙ্গে সিরাজগঞ্জের ১৪ জনের ৪৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ হয়। এদের মধ্যে মঞ্জুরুল হক ভূঁইয়া ও গোলাম কিবরিয়াকে রেখে দেওয়া হয় বিশেষ কিছু কাজের জন্য। বাকী ১২ জনকে দেশের ভিতরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এদের দেশের ভিতরে পাঠানো সহজ ছিল না। কারণ, বিএলএফের প্রশিক্ষণের খবর তখন পর্যন্ত জানতো না প্রবাসী সরকার এমনকি ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফও। প্রবাসী সরকারের মুক্তিফৌজ ও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিএলএফ সদস্যদের দেশের পাঠানো প্রয়োজন। এজন্য গড়ে তোলা হয় আলাদা যোগাযোগ ব্যবস্থা। উত্তর বঙের কয়েকটি জেলায় ওই কাজে নিয়ুক্ত ছিলেন বগুড়ার মমতাজ উদ্দিন মাস্টার। তিনি দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে। মমতাজ মাসন্টার ছাত্রজীবন শেষে যুক্ত হন গ্রামের একটি স্কুলে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধে। তিনি এই বিএলএফ সদস্যদের পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে। অন্য জেলার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সিরাজগঞ্জের বিএলএফ সদস্যদের তুলে দেওয়া হয় সেই মমতাজ মাস্টারের হাতে। [অক্টোবর পর্যন্ত মমতাজ মাস্টার বিএলএফের গাইড হিসেবে দেশের ভিতরের খবর বিএলএফ হেড কোয়ার্টারে এবং জয়পুরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জের বিএলএফ সদস্যদের ভিতরে আনা নেওয়া করেন। অক্টোবরে তিনি পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে শহিদ হন। সে মাসে সিরাজগঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য গাইড হিসেবে নিযুক্ত হন আজিজুল হক বকুল ও আমিনা বেগম মিনা।]
যাইহোক, আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে মমতাজ মাস্টার কাজীপুরের কোনও এক গ্রামে বিএলএফের ১২ সদস্যকে পৌঁছে দিয়ে চলে যান। কিন্তু তারা পড়ে যান অথৈ সাগরে। কারণ, তাদের অগ্রগামী হিসেবে আব্দুল লতিফ মির্জাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছিল, তা করা হয়নি। বিএলএফ সদস্য স ম আব্দুর ওয়াহাবের কাছে জানা যায়, তিনি ভারত থেকে এসে কাজটি শুরু করেন। দেশের ভিতরে থাকা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তৈরি করছিলেন যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং আশ্রয়স্থল্। এ সময়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে পলাশডাঙ্গার। তিনি সেখানে গিয়ে পলাশডাঙ্গার পরিচালক নির্বাচিত হন এবং পলাশডাঙ্গাকে গড়ে তোলার কাজেই মনোযোগ দেন। ফলে বিএলএফ নির্দেশিত পথে আর হাঁটা হয়নি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ মির্জার।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, আহ্বায়ক- সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।