রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : রান্নার সময় কড়াইতে শাক পুড়ে যাওয়ার অপরাধে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বৈচানা গ্রামের ষোড়শী এতিম খাদিজাকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার সাড়ে সাত বছরেও বিচার হয়নি। উপরন্তু হত্যাকারিরা এতই প্রভাবশালী যে তাদের হুমকিতে মুখ খুলতে সাহস পায়নি খাদিজার ছোট বোন প্রত্যক্ষদর্শী হাজিরা। ফলে ঢাকার খিলখেত থানায় মামলা সম্পর্কে কোন খবরই রাখেন না নিহতের পরিবার ও স্বজনরা।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার গয়েশপুর খাদিজাতুল কোবরা দাখিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী হাজিরা খাতুন জানায়, তার বাবার নাম মনিরুল ইসলাম, মা শিল্পী খাতুন। ২০১১ সালে বাবা মাকে তালাক দেন। অগত্য মায়ের হাত ধরে বড় বোন খাদিজা ওরফে ফুটুনী ও তাকে সদর উপজেলার বৈচানা গ্রামের নানা আব্দুর রউফ সরদারের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একই গ্রামের আফছার মল্লিক মামাদের অভাবের সংসারে থাকা ১৪ বছরের বড় বোন ও ও তাকে (৮) বাসায় কাজের জন্য ঢাকার খিলখেত থানাধীন ভাড়া বাসায় নিয়ে যান। শুধু পেটে ভাতে খেয়ে তারা দু’ বোন আফছার মল্লিকের বাসায় কাজ করেছে। পানের থেকে চুন খসলেই আফছারের স্ত্রী লিলি তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করতো। আফছারের ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়ে সোমার হাতেও কম মার খায়নি তারা দু'বোন।

শুক্রবার সকালে সরেজমিনে বৈচানা গ্রামে গেলে হাজিরা জানায়, ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খাদিজাকে শাক রান্না করতে বলেন গৃহকত্রী লিলি খাতুন। রান্নার একপর্যায়ে কড়ায় শাক পুড়ে যাচ্ছে এমন গন্ধ পেয়ে ছুঁটে এসে খাদিজাকে এলোপাতাড়ি মারপিট শুরু করেন লিলি খাতুন। মারপিটের একপর্যায়ে লাথি মেরে খাদিজাকে দোতলার সিঁড়ি থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়। গড়াতে গড়াতে নীচের তলার মেঝেতে পড়ে যাওয়ার পরপরই খাদিজা রক্তবমি শুরু করে। কিছুক্ষণ পর খাদিজার বেহুশ হয়ে পড়ায় তাকে সোমা দোতলায় ডেকে এনে ঘরের মধ্যে বসিয়ে রাখে। কিছুক্ষন পর খাদিজাকে পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে। বিপদ বুঝে আফছার ও তার পরিবারের সদস্যরা খাদিজা আত্মহত্যা করেছে মর্মে প্রচার দেয়। বিষয়টি নিয়ে মুখ খুললে তার পরিণতি হবে আপার মত বলে হুশিয়ারি দেওয়া হয়। একই গ্রামে বাড়ি হওয়ায় মামার বাড়ি ও স্বজনদের কাছে মুখ খুললে সেখান থেকে তুলে এনে হত্যার হুমকি দেন আফছার মল্লিক।

বৈচানা গ্রামের আবু সাঈদ জানান, ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর ভাগ্নি খাদিজা কোন ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে এমন কথা মোবাইলে জানিয়ে তার সঙ্গে ঢাকায় যাওয়ার কথা বলেন আফছার মল্লিকের মামাত ভাই তৎকালিন ভোমরা ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান। সাতক্ষীরা থেকে এসপি গোল্ডোনের একটি পরিবহনে তাকে নিয়ে খিলখেত নিয়ে যান আসাদুজ্জামান। আফছার মল্লিকের বাসায় যেয়ে ভাগ্নি খাদিজার মৃত্যুর বিষয় জানতে পারেন তিনি। ছোট ভাগ্নি হাজিরার সঙ্গে তাকে কোন কথা বলতে দেওয়া হয়নি। পরে চেয়ারম্যান ও আফছার মল্লিকের সঙ্গে খিলখেত থানায় নিয়ে গেলে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার কাছ থেকে কয়েকটি কাগজে সাক্ষর করিয়ে নেন।

এরপর হাসপাতালের মর্গে রাখা খাদিজার লাশ সনাক্ত করেন তিনি। এরপর একটি এম্বুলেন্সে করে খাদিজার লাশ সাতক্ষীরায় আনার সময় নবীননগরে আসার পর ছোট ভাগ্নি হাজিরাকে না নিয়ে তিনি যাবেন না বলায় বিষয়টি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মোবাইল ফোনে আফছার মল্লিককে অবহিত করেন। একপর্যায়ে আফছার মল্লিকের গাড়িতে করে চালক কিরণ নবীননগরে আনার পরপরই হাজিরাকে এম্বুলেন্সে তুলে তারা সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কফিনসহ খাদিজার লাশ নামিয়ে দিয়ে চলে যান এম্বুলেন্স চালক ও চেয়ারম্যান। পারিবারিক কবরস্থানে খাদিজার লাশ দাফন করা হয়। এরপর থেকে কোন দিনও হাজিরার খোঁজ নেয়নি আফছার মল্লিকের পরিবার। আসেননি মিলাদেও।

এ প্রতিবেদককে সুরতহাল প্রতিবেদন দেখিয়ে খাদিজার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল মর্মে জানান আবু সাঈদ। ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে খাদিজাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় পুলিশ বাদি হয়ে খিলখেত থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। মামলায় আফছার মল্লিক কয়েক মাস জেল খাটার পর জামিনে মুক্তি পান। পরে প্রভাব খাটিয়ে চার্জশীটে নিজের নাম বাদ দেওয়ান আফছার।

ভাগ্নির মৃত্যু নিয়ে নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিতে যেয়ে ভোমরা বন্দরের হ্যাণ্ডেলিং শ্রমিক ইরুনিয়নের সদস্য আবু সাঈদ বলেন, খাদিজার মৃত্যুর কয়েক মাস পর শোক সহ্য করতে না পেরে মারা যান বোন শিল্পী। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা কোন দিনও তাদের খোঁজ নেননি। সাত বছর সাত মাস পেরিয়ে গেলে সাক্ষীর জন্য পাননি আদালতের কোন নোটিশও।

মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তার দাবি তারা যেন এতিম ভাগ্নিটির হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করেন। আবু সাঈদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার বৃদ্ধা মা মাজেদা খাতুন ও ভাই মোঃ অলিউল ইসলাম।

স্থানীয়রা জানান, ১৯৮২ সালে পশুসম্পদ বিভাগে চাকুরি পান আফছার মল্লিক। পদোন্নতি পেয়ে আফছার মল্লিক সেআটর কিপার ও তার স্ত্রী লিলি খাতুন ঢাকার ফার্ম গেটে পশু সম্পদ বিভাগে চাকুরির সুবাদে অনিয়ম ও দূর্ণীতির মাধ্যমে বহু টাকার মালিক বনে যান। জয়েন্ট স্টক কোম্পানীতে নিজের চাকুরির কথা গোপন রেখে হয়ে যান ফ্যালকন হোমস এর মালিক। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারির মধ্যে দুদক তদন্ত করে সাড়ে ছয় কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের সত্যতা পাওয়ায় খুলনার সহকারি পরিচালক আমিনুর রহমান বাদি হয়ে মামলা করেন। ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি খুলনার সোনাডাঙা থানায় আরো একটি দূণীতির মামলা হয়। জেল খেটে চাকুরি হারাতে হয় আফছারকে। এরপরও তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না।

এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনে কথা বলা সম্ভব হয়নি ভোমরা ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামানের সঙ্গে।

এ ব্যাপারে আফছার মল্লিক তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ তার প্রতিপক্ষের অপপ্রচার বলে দাবি করে বলেন, কাজের মেয়ে খাদিজা হত্যা মামলায় তিনি জেলে ছিলেন। তবে পরে তিনি মামলা থেকে অব্যহতি পেয়েছেন। খাদিজা পড়ে যেয়ে মারা যায় বলে দাবি করেন তিনি।

(আরকে/এসপি/জুন ২৫, ২০২১)