বিচার বিভাগীয় কমিশনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার তালিকা প্রণয়ন করুন : আবীর আহাদ
স্টাফ রিপোর্টার : অর্থের লালসা, আত্মীয়প্রীতি ও দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার ও রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দিয়ে বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় 'মুক্তিযুদ্ধ'কে চরমভাবে বিতর্কিত করার কার্যক্রমে যারা জড়িত তারা জঘন্যতম রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজটি করছেন । এদের খুঁজে বের করা মোটেই কঠিন নয় । দরকার সরকারের সদিচ্ছা । এ লক্ষ্যে বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন করাই শ্রেয় বলে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান লেখক গবেষক আবীর আহাদ অভিমত ব্যক্ত করেছেন ।
আজ এক বিবৃতিতে উপরোক্ত মন্তব্য করে আবীর আহাদ বলেন, চলতি মুক্তিযোদ্ধা তালিকা এবং গত বছরের রাজাকার তালিকা প্রকাশ নিয়ে সারা দেশে যে তুমুল ধুম্রজাল ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে, এসবের বিরুদ্ধে বহুদিন পূর্ব থেকেই আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে বাদপ্রতিবাদ করে আসছি । আমরা আশা করেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী দল আওয়ামী লীগ সরকার অন্ততঃ তাদের অতীত অবদানের আমাদের কথাগুলো একটু পর্যালোচনা করে দেখবেন । আমরা এও বলে আসছি যে, বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ তথা মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না । উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাই ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে । সেইসঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারেরও বদনাম হচ্ছে ।
তিনি বলেন, আমরা বলে আসছি, ৭২ সালের বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে কোনো অবস্থাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ১ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি হবে না । অথচ বঙ্গবন্ধুর সেই সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞায় ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে ইতোমধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ৮০/৮৫ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ! এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়া হয়েছে ! আর এ-গোঁজামিলের তালিকার পশ্চাতে বিশাল অর্থ, আত্মীয়প্রীতি ও রাজনৈতিক সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে । এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকে নতুন প্রজন্মের কাছে বিতর্কিত করার মহলবিশেষের চক্রান্তও কাজ করছে ।
আবীর আহাদ বলেন, গতবারের রাজাকার তালিকা প্রকাশের মধ্যেও ঐ একই অর্থ, আত্মীয়প্রীতি ও রাজনৈতিক সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে বলে প্রতীয়মান হয় । দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল, প্রজাতন্ত্রের প্রশাসন ও আর্থিক খাতসমূহে রাজাকার চেতনার লোকদের রমরমা অবস্থান । রাজাকার তালিকার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঢোকানোর পাশাপাশি রাজাকার খাতায় প্রকৃত রাজাকারদের নাম প্রকাশ না-করার মাধ্যমে দেশের ভেতর একটি বিশৃংখল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা গেলে সরকার হয়তো এই বিশৃংখলা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য রাজাকার তালিকা প্রকাশ স্থগিত করে দেবে----এ-লক্ষ্যে হয়তো পর্দার অন্তরালে লুক্কায়িত রাজাকার চেতনার লোকজন এ-ধরনের জগাখিচুড়িপনা তালিকা প্রণয়ন করে থাকতে পারে । এর মধ্য দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধকেও বিতর্কিত করার চক্রান্ত করছে ।
আবীল আহাদ আত্মপ্রত্যয়ের সাথে একটি তদন্ত কমিশনের রূপরেখা দিয়ে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন করা মোটেও দুরূহ নয় । বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাকে সামনে রেখে যদি একটি উচ্চপর্যায়ের বিচারবিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা তদন্ত কমিশন গঠন করে, একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি/সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, সাবসেক্টর কমান্ডার, চাকরিরত সেনা-নৌ-বিমান-পুলিশ বাহিনীর একজন করে উচ্চপর্যায়ের সদস্য সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিশন এবং উপজেলাভিত্তিক একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ/ জেলা জজের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকালীন সুপরিচিত দু'জন থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, সেনাবাহিনীর চাকরিরত মেজর পদমর্যাদার সেনা নৌ বিমান RAB পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে প্রতি উপজেলায় একটি করে মুক্তিযোদ্ধা তদন্ত কমিশন গঠন করে, মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন অস্ত্র প্রদর্শনার্থে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই করা হলে সেই যাচাই বাছাই কমিশনের সামনে নৈতিকভাবে দুর্বল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হাজিরই হবে না । তদন্তকালীন ভুয়া প্রমাণিত হলে তাৎক্ষনিক রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আওতায় কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে । উপজেলা তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর বিচার-বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিশন মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রস্তুত করে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবেন । মহামান্য রাষ্ট্রপতি অত:পর মুক্তিযোদ্ধা তালিকার চূড়ান্ত আইনীভিত্তি প্রদানের জন্য জাতীয় সংসদে পেশ করবেন । এভাবেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকার চূড়ান্ত অবসান ঘটাতে হবে ।
তিনি বলেন, একই ধরনের আরেকটি বিচার বিভাগীয় রাজাকার যাচাই বাছাই কমিশন গঠন করে উপজেলাভিত্তিক রাজাকার আলবদর আলশামস আলমুজাহিদ ও শান্তি কমিটির সরকারি মহাফেজখানা থেকে প্রাপ্ত তালিকাসহ প্রতি ইউনিয়নের একজন সুপরিচিত মুক্তিযোদ্ধা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট থেকে রাজাকারের তালিকা সংগ্রহ করতে হবে । ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা ও চেয়ারম্যান মিথ্যা তথ্য দিলে তাদের কঠোর শাস্তির বিধানে বিচারের ব্যবস্থা থাকবে । রাজাকার তালিকাও জাতীয় সংসদের মাধ্যমে আইনীভিত্তি দিয়ে চূড়ান্ত অবসান ঘটাতে হবে ।
এমনকি দু'টো তদন্ত কমিশন একই সময়ে পাশাপাশি অবস্থানে থেকেও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে । মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন নিয়ে ইতিমধ্যেই দীর্ঘ পঞ্চাশটি বছর অতিবাহিত হয়েছে । এ-প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন না-হয় আরো কিছু সময় ব্যয় হলো----সেটা নিশ্চয়ই জাতীয় স্বার্থে সবাই মেনে নেবে । তবে আমার বদ্ধমূল ধারণা, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এ-দু'টি প্রকল্প বাস্তবায়ন ছ'মাসের মধ্যেই সম্পন্ন করা অবশ্যই সম্ভব ।
পরিশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবীর আহাদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হবে । বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও চেতনা বাস্তবায়নের জন্য রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, শিল্প ও বাণিজ্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় প্রভৃতি অঙ্গন থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতারবিরোধী উচ্ছেদ করতে হবে । এভাবেই বঙ্গবন্ধু ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ।
(এ/এসপি/মে ২৯, ২০২১)