ফরিদপুরে বাড়ছে শব্দ ও বায়ু দূষণ!
ফরিদপুর প্রতিনিধি : বায়ু দূষণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রাণ হারায় ৭০ লাখ মানুষ। মেগাসিটিগুলোর মধ্যে ভারতের রাজধানী হিসেবে পরিচিত মুম্বাই রয়েছে ৪ নম্বরে। আর ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। বলতে গেলে দূষণের থাবায় দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে মানুষের একমাত্র আবাস এই পৃথিবী। শুধু বায়ু দূষণ নয়, শব্দ দূষণ, পানি দূষণ, নদী দূষণ, নানা সমস্যায় আক্রান্ত ফরিদপুরসহ সারাদেশ। ফরিদপুরের প্রাণ প্রবাহ কুমার নদ, পদ্মা নদীসহ সংশ্লিষ্ট নদীগুলো হনন, শোষণ আর দূষণে একাকার। প্রতিদিন ফরিদপুর শহরের শতাধিক ড্রেনের বর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূষণ হচ্ছে এ নদীগুলো। এমন কি? কোন কোন এলাকার আবাসিক বাসাবাড়ীর পয়ঃনিষ্কাশন সংযোগ স্থাপন করে দেওয়া হয়েছে ড্রেনের সঙ্গে। দূষণে মৃত প্রায় এ নদী রক্ষায় কার্যত কোন উদ্যোগ নেই। সরকার নদী রক্ষায় কঠোর আইন ও কমিশন গঠন করে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে নদী রক্ষায় পদক্ষেপ চলছে। অনেক জায়গায় কাজ শুরু হয়েছে। নদী থেকে উৎপত্তি অসংখ্য খাল বিপন্ন হয়েছে। জলাবদ্ধতা দূরকরণ ও পানির স্বাভাবিক প্রবাহ যেসব খাল-নালা দিয়ে স্বাভাবিক হতো সেইসব খাল-নালা দখল ও ভরাটের কারণে বিভিন্ন এলাকায় বেঁড়েছে জলাবদ্ধতা। ফরিদপুরেও এর প্রবণতা রয়েছে।
মানুষের হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, শিরপীড়া, অনিদ্রা, বদহজম, চর্ম রোগ ও পেপটিক আলসারে আক্রান্ত হবার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত এ দূষণ। শব্দ দূষণে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, বুদ্ধিমত্তা বাধাগ্রস্ত করে। গর্ভবতী মায়েদের জন্যেও এটা মারাত্মক ক্ষতিকর।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়ুমান যাচাইয়ের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ারভেজুয়াল একিউআই এর সূচক অনুযায়ী দূষণের মাত্রা উঠেছিল ৫০২-এ। স্বাভাবিকের তুলনায় ৬ গুণ দূষিত। বায়ু গ্রহণের প্রভাব ধোয়াশাচ্ছন্ন পরিস্থিতি। মানুষের স্বাভাবিক বায়ু গ্রহণ ক্ষমতা ৫০ একিউআই পরীক্ষা করে পাওয়া যায় ৪৭০ একিউআই। ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর এর মাত্রা ছিল ৪৩০ একিউআই পর্যন্ত। এয়ারভেজুয়ালের একিউআই সূচকে ঢাকার প্রতি ঘন মিটার বাতাসে সূক্ষè ধূলিকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি রয়েছে। ৩৭৯.৪ মাইক্রোগ্রাম এ আবহাওয়াকে বায়ু বিশেষজ্ঞরা দূর্যোগ পূর্ণ পরিস্থিতি বলে মনে করেন।
ফরিদপুরের বর্তমান সময়ে প্রতিনিয়ত অনিয়মতান্ত্রিক বালু, মাটি, যত্র-তত্র বহন করায় বায়ু দূষণ হচ্ছে। নদী থেকে মাটি, বালু অবৈধ উপায়ে উত্তোলন করায় সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশ বিপর্যস্থ হচ্ছে। প্রতিদিন শহরের মধ্য দিয়ে প্রায় ৫০০ ট্রাক বালু মাটি নিয়ে যাওয়া হয় উন্মুক্তভাবে। মানুষের দৃষ্টি এড়াতে এসব পরিবহন রাতের বেলায় চলাচল করে। বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। বায়ু দূষণের উৎস ধূলোবালি। বায়ু দূষণ বিপদজনক মাত্রায় যাওয়ার জন্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের দিল্লীতে গত বছর জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল।
প্রতিনিয়ত বিভিন্ন উপায়ে মাত্রাতিরিক্ত পরিবেশ দূষণের ফলে এর ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে সর্বমহল উদ্বিগ্ন। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ন, অপর্যাপ্ত আবর্জনা নিষ্কাশন ব্যবস্থা, কালো ধোঁয়া ও শব্দ দূষণ এর ফলে নগর জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেশের পরিবেশ অধিদপ্তর কালে ভদ্রে বিভিন্ন গাড়ির কালো ধোঁয়া পরীক্ষা করলেও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে একেবারে নির্বাক রয়েছে। মাঝেমধ্যে কর্মকান্ড পরিচালনা করলেও কার্যতঃ ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ছড়ানোর অপরাধে তেমন শাস্তি হয় না। শব্দ ও ধোঁয়া দূষণ মারাত্মক ভাবে বেড়ে গেছে।
ফরিদপুরের আনাচে কানাচে মটরযানের অতিরিক্ত সংখ্যা বাড়া ও হাইড্রোলিকসহ নানা পর্যায়ের হর্ন মানুষকে প্রতিদিন ক্ষতিগ্রস্থ করছে। শহরের রাস্তার অনুযায়ী মটরযানের সংখ্যা অনেক বেশী। এই নিয়ে কোন ব্যাপক পরিকল্পনা নেই। মানুষের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে এখনই এসব বিষয় নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী। এক মিটার দূরত্বে দু’জন মানুষের একটু উচ্চস্বরে কথাবার্তায় শব্দ উৎপন্ন হয় ৬০ ডেসিবল। যদি কেউ ক্রমাগত ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে থাকে তাহলে ২৫ বছরের মধ্যে তিনি বধির হতে পারেন। ৮শ ২৫ ডেসিবল মাত্রায় কেউ বাস করলে তার চোখ ও মস্তিষ্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নার্ভ সিস্টেম প্রতিক্রিয়ায় তিনি হৃদরোগ ও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারেন।
শব্দ নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক সীমারেখা বেঁধে দেওয়া হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার চিত্র অন্যরকম। এ দেশে শব্দ দূষণ আজ নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েঠেছ। বাংলাদেশে বিভিন্ন দূষণ মারাত্মক সমস্যা হিসেবে দেখা দিলেও জনগণের ও কর্তৃপক্ষের কাছে তেমন মাথা ব্যথা নেই। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, সদর হাসপাতাল ও থানা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন উল্লেখিত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। শব্দ ও ধোঁয়া দূষণ প্রতিরোধের যে আইন আছে তাও মেনে চলা হয় না।
ফরিদপুর পৌরসভার মধ্যে ও সংলগ্ন এলাকায় অসংখ্য ইটের ভাটা রয়েছে। সেখান থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ইট ভাটার সংলগ্ন এলাকাগুলো গাছপালা ও বাসাবাড়ীর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে আমরা কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। ফরিদপুরের সচেতন নাগরিক সমাজ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তা ব্যক্তিদের কাছে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জোড় দাবী জানিয়েছে।
(ডিসি/এসপি/জানুয়ারি ১৩, ২০২১)