‘বাড়িতে কেউ আছেন বাবা, আজ নাকি আপনার জন্মদিন এই উপহারগুলো আপনার জন্য’
মানিক সরকার মানিক, রংপুর : নগরীর আলমনগর রবার্টসনগঞ্জ এলাকা। ভাঙ্গাচোরা টিন আর বেড়ার দু’টি ছাউনি ঘর। চতুর্দিকে সুপারী গাছের পাতাযুক্ত ডালপালা আর খানিকটা নীল রঙের ছেড়া পলিথিন দিয়ে কোন রকমে বাড়িটিকে আড়াল-আবডাল করে রাখার চেষ্টা। বাড়ির ভেতর সুনসান নীরবতা। ওই নীরবতা আর আবডাল ঠেলেই একটি সাদা রংয়ের বাজারের ব্যাগ হাতে কয়েকজন তরুণ-যুবকের হাক ডাক; বাড়িতে কেউ আছেন ? এ সময় ছেঁড়া গামছায় কষ্ট ভারাক্রান্ত হৃদয়ের ঘাম মুঁছতে মুঁছতে এগিয়ে এলেন দাঁড়িওয়ালা মাঝ বয়সি এক ভদ্রলোক। আচমকা তরুণ-যুবকদের দেখে অনেকটাই হতবিহ্বল তিনি। কিছু বলে ওঠার আগেই যুবকদের প্রশ্ন, ‘আজ নাকি আপনার জন্মদিন বাবা ? তাই আপনার জন্য ছোট্রো একটি উপহার পাঠালাম’।- ইতি আপনার সন্তান। ব্যাগের বাম সাইডে ইংরেজিতে লেখা ‘ইউ ফর দ্যাম’। ভদ্রলোকতো বিস্মিত। বললেন, ‘নাতো বাবা, আমি গরীব মানুষ, আমার জন্মদিন যে কবে আমি নিজেও জানি না’। যুবকরা বললেন, ‘আমরা শুনেছি, আজই আপনার জন্মদিন। তাইতো এই উপহার। এগুলো রাখেন এই দু:সময়ে কাজে লাগবে’।
না, আসলেই আজ ওই ভদ্রলোকের জন্মদিন ছিল না, এটি হচ্ছে ওই তরুণ-যুবকদের নীরব নিভৃতে মানবিকতা এবং মানব সেবার বিনয়ী এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইউ ফর দ্যাম। এদেরই কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, শুধু এই করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলাই নয়।
শীত, বন্যা, খরা হ্যারিক্যান সুনামিসহ দেশের বিভিন্ন দুর্যোগের সময়ই নীরবে নিভৃতে কাজ করেছে তারা। এরা রংপুর মহানগরীর বেশ কয়েকটি স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী। এদের দলে রয়েছে এখন ২৮জন। দলটির নাম দিয়েছে ইউ ফর দ্যাম। অর্থাৎ তোমাদের জন্য আমরা। তাদের কেউই নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে চায় না, চায় মানুষ বাচাঁতে, মানুষের সেবা করে যেতে। এদেরই ক’জন জানালো, সহসাই একজন মানুষকে চাল, ডাল, তেল, নুন নিয়ে তার বাসায় যাবো, তখন তিনি যদি বিব্রতবোধ করেন, কিংবা না নিয়ে ফিরিয়ে দেন।
তখন আমরাও বিব্রত হব। এজন্যই তাদের এ কৌশল। দেশে করোনা ভাইরাস আসার শুরু থেকেই তারা নিজেরাই নিজেদের যার যতটুকু সামর্থ্য তাই দিয়ে প্রথমে মাস্ক বিতরণ, নগরময় জীবানুমুক্ত পানি ছিটানো, মাইকিং করে অসচেতন মানুষকে সচেতন করতে কাজ করেছে। কিন্তু সরকার এখন মানুষের জীবন রক্ষার্থে সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে সরকারীভাবে দরিদ্র মানুষের জোটাবার যথেষ্ট চেষ্টা চালালেও সেই সেবা সবাই পাচ্ছেন না।
তাই তারা নিজ উদ্যোগে একেবাবে বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় গিয়ে খুঁজে খুঁজে তাঁদের হাতে কথিত এই জন্মদিনের উপহারের নামে খাদ্য সামগ্রি তুলে দিচ্ছেন এবং তাদের মোবাইল নম্বর দিয়ে বলে আসছেন, এই খাবার শেষ হলে কিংবা আবার প্রয়োজন হলে মোবাইলে তাদের জানাতে। তাদের দেয়া খাদ্য সামগ্রির মধ্যে রয়েছে, ৫ কেজি চাল, ২ কেজি মসুরের ডাল, ১ কেজি চিনি, আটা, লবন, তেল, আটা, দুই ধরণের সাবান এমনকি মশা মারা কয়েলও।
জানা গেল, গত ৯ এপ্রিল থেকে তারা এই উপহার সামগ্রি বিতরণ শুরু করেন এবং এখন পর্যন্ত অর্ধশত পরিবারের মাঝে বিতরণ শেষ করেছে। এখন পর্যন্ত তারা নিজেরাই এই ব্যয়ভার বহন করলেও বর্তমানে তাদের জন্য এ কাজ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাই কেউ যদি তাদের এই মানবিক কর্মে সাড়া দেয়, তবে তা তারা সানন্দেই গ্রহণ করবে। তবে এজন্য তারা তাদের নাম পরিচয় দিতে চাইছেন না, চাইছে সংগঠনের দুই সংগঠকের সঙ্গেই কথা বলতে। এদের এজনের নম্বর ০১৭৭৩৫৭৫৩৫৯, অপরজন ০১৭৬১০৭০১৭০।
বৈশ্বিক এ পরিস্থিতিতে শুধুই যে, রংপুরের‘উই ফর দ্যাম’ কাজ করে যাচ্ছে, তা কিন্তু মোটেই নয়। তবে সামান্য এই তরুণ-যুবকদের ক্ষুদ্র এ প্রয়াসকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। স্যালুট ইউ ফর দ্যামকে। কারণ, এরাই পারে দেশের বিত্তবান ও শিল্পপতিদের চোখ খুলে দিতে। হতে পারে অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্তও। একই সঙ্গে ‘মানুষ মানুষের জন্য’ ভুপেন হাজারিকার সেই উপদেশ বাণীটিকে বিশ্বজুড়ে যারা কাজে লাগাচ্ছেন স্যালুট তাদের প্রতিও। ভয় নয়, সচতেন হোন, ঘরে থাকুন। একমাত্র সচেতনতাই বাঁচিয়ে রাখবে আপনাকে।
(এমএস/এসপি/এপ্রিল ১১, ২০২০)