মানিক সরকার মানিক, রংপুর : ‘আমাদের অবস্থা বেশ স্বচ্ছল ছিল-আমরা পরম সুখে খাইয়া পরিয়া গা-ভরা গহনায় সাজিয়া থাকিতাম। আমাদের এ নিবিড় অরণ্যবেষ্টিত বাড়ীর তুলনা কোথায় ? সাড়ে তিনশত বিঘা লা-খেরাজ জমির মাঝখানে কেবল আমাদের এই সুবৃহৎ বাটী। বাড়ীর চতুর্দ্দিকে ঘোর বন, তাহাতে বাঘ, শূকর, শৃগাল-সবই আছে......’ বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদুত মহীয়সী বেগম রোকেয়া তাঁর লেখা মতিচুর গ্রন্থে ‘নার্স নেলী’ শিরোনামে তাঁর পিতৃবাড়ি সম্পর্কে এ ভাবেই বর্ণনা দিয়েছিলেন। তার সেই বর্ণনা আজ কেবল স্বপ্ন মাত্র। এসবও আজ বিলীণ হয়েছে। সাড়ে তিন শত বিঘা জমির উপর থাকা রোকেয়ার বাড়ির আজ আর কিছুই নেই। মানুষরূপী কাক শকুনেরা নামে বেনামে করে নিয়েছে তাঁর পৈত্রিক ভিটার অনেকটাই। 

বাস্তুভিটা, পৈত্রিক পুকুর, হাওয়াখানা, বাগান, পারিবারিক মসজিদসহ এসব সম্পত্তি উদ্ধারে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকা সত্বেও উদ্ধার এবং সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেই। শুধুমাত্র ৪০ শতক জমির উপর যেখানে রোকেয়ার আতুর ঘর ছিল সেটি সংরক্ষণ ছাড়া নেই কিছুই। এদিকে আতুর ঘরের সেই শেষ ধ্বংসাবশেষ স্মৃতি চিহ্নও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে বিলীণ হতে চলেছে। দাবি উঠেছে এসব জমি উদ্ধার এবং শেষ স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা করে সেখানে রোকেয়া এস্টেট গড়ে তোলার।

জানা যায়, নামে বেনামে অনেকেই এসব জমি গিলে খেলেও সবশেষ ৫২ একর ৪৬ শতক জমি ছিল রোকেয়ার নামে। জানা গেছে, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ে সংবিধানের ২৩ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র জনগণের সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং জাতীয় ভাষা সাহিত্য ও শিল্পকলা সমূহে এমন পরিকোষন ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন যাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখার ও অংশগ্রহণ করার সুযোগ লাভ করে’।

এছাড়া ২৪ ধারায় বলা আছে, ‘বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন বা তাৎপর্য মন্ডিত স্মৃতি নিদর্শন বস্তু বা স্থানসমূহকে বিকৃতি বিনাশ বা অপসারণ হতে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করবে’। কিন্তু বেগম রোকেয়ার স্মৃতি বা তাঁর বাস্তুভিটা রক্ষায় এখনও কোন ব্যবস্থা বা অবদানই রাখেনি সরকার। রোকেয়া যে ঘরে জন্মেছিলেন, সেই আতুর ঘরের শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মত সামান্য একটি প্রাচীল বিদ্যমান ছিল। ওই প্রাচীলটিও হতে পারত একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। কিন্তু সেটিও আজ আর নেই। ওই স্থানটিও ভেঙ্গে ফেলে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে অতিথিশালা। অথচ ওই অতিথিশালার ভেতরের অংশেই সংরক্ষণ করা যেত ওই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি।

পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, তার বাস্তুভিটা রক্ষা এবং তা সংরক্ষণের উদেশ্যে ২০১২ সালের মার্চ মাসে একটি মানবাধিবার সংস্থার পক্ষে মঞ্জুর মোরশেদ নামের এক আইনজীবী স্বরাষ্ট্র ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব, রংপুরের ডিআইজি এবং জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে বিবাদী করে হাইকোটে রীট করলে সে সময়ই হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ শুনানী শেষে বেগম রোকেয়ার সকল পৈত্রিক সম্পত্তি কোথায় কী অবস্থায় আছে তা জানতে চেয়ে ৪ সপ্তাহের মধ্যে রংপুরের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন। ওই আদেশ পাবার পর জেলা প্রশাসন বিষয়টির খোঁজ খবর করে ২৫ একর জমি বেহাত হয়ে থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন বলে আদালতকে জানিয়েছেন। বর্তমানে তা আদালতে শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে।

তিনি জানান, শুনানী শেষে আদেশের পরই তার ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন তিনি।

এসব বিষয় জানতে চাইলে রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান জানান, বিষয়গুলো আদালতে বিচারাধীন। সে সময়ই তারা হাইকোর্টকে অবহিত করেছেন। এখন আইনী প্রক্রিয়ায় আছে। আইনী প্রক্রিয়া শেষ হলেই সেসব উদ্ধার করা হবে।

(এম/এসপি/ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯)