দেশের প্রথম হাইটেক ডেইরি ফার্ম রংপুরে
মানিক সরকার মানিক, বদরগঞ্জ ঘুরে এসে : শীত প্রধান সুদূঢ় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকে আকাশ পথে উড়াল দিয়ে আসা ২২৫টি অষ্ট্রেলিয়ান গাভী মাত্র ক’দিনেই এখন এ দেশীয় আবহাওয়ায় মিলেমিশে একাত্ব হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশ ও আবহাওয়া যেন বিন্দুমাত্র স্পর্শ করছে না তাদের, এমনকি বিন্দুমাত্র অনুভবও করছে তারা যে, কোত্থেকে কোথায় এখন অবস্থান তাদের। নিয়মমাফিক খাওয়া থাকা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়া, কিংবা খানিকটা আরাম আয়েস আর বিনোদনেরও কোন ঘাটতি নেই এদেশীয় অতিথি এ গাভীগুলোর। যেন রংপুরের এই প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদই অষ্ট্রেলিয়ার সেই মাতৃভূমি তাদের। আর তাদের ভালমন্দ দেখাশোনা সর্বপরি সার্বক্ষণিক আরাম আয়েসের বিষয়গুলো অভিভাবক হিসেবে তদারকি করছেন নেদারল্যান্ড থেকে আসা অভিজ্ঞ ডেইরি খামার বিশেষজ্ঞ ফ্রাঙ্ক বাইজো। তিনিই যেন তাদের পিতামাতা। তার সংস্পর্শেই যেন কাটছে তাদের নতুন জীবন।
বলছিলাম, বাংলাদেশের রংপুরের অতিথি হয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা গর্ভবতী ২২৫টি অস্ট্রেলিয়ান গাভীর বর্তমান জীবনচিত্রের কথা। এ যেন এক রাজ অতিথিই তারা। এদের নিয়েই এককালের চির মঙ্গা পীড়িত রংপুরের বদরগঞ্জের প্রত্যন্ত এক গ্রামে বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির হাইটেক ডেইরি ফার্ম প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে দেশের অন্যতম এগ্রোবেজড্ প্রতিষ্ঠান ইয়ন বায়ো সায়েন্স লি.।
আয়োজকদের মতে, আগামীতে এই খামারকে এশিয়ার সর্ববৃহৎ গবাদি খামার হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েই কাজ শুরু করেছেন তারা। এখানকার প্রতিটি গরুই বর্তমানে গর্ভবতী এবং আগামী তিনমাস পর বাছুর প্রসব করলে প্রাথমিকভাবে প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার লিটার দুধ দেবে তারা। আর আগামী ৫ বছর পরে প্রতিদিন যার পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ লিটারে।
প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোমিন উদ দৌলা জানান, এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা গেছে, এটি দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ, বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় মাত্র ২৫ ভাগ দুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। প্রতিবছর উৎপাদিত ঘাটতি জনিত কারণে দেশের কষ্টার্জিত মুদ্রা বৈদেশিক কাজে ব্যয় করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে বিপুল পরিমাণ দুধ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এদেশে অধিক দুধ উৎপাদনের প্রধান অন্তরায় উন্নত ও অধিক উৎপাদনশীল জাতের গবাদি প্রাণির অভাব। বাংলাদেশের আবহাওয়া জনিত কারণে বছরে প্রায় ৬ মাস উন্নত জাতের পিওর ব্রীড গবাদি পশু যেমন হলস্টিন ফ্রিজিয়ান গাভী পালন করা একটি বড় অন্তরায়।
এই অন্তরায় এবং সীমাবদ্ধতা উতরাতেই ইয়ন বায়ো সায়েন্স দীর্ঘ ৫ বছর এ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা, পর্যালোচনা, উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ যেমন আমেরিকা, তুরস্কসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, ইরান, মিশর, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশের খামার পরিদর্শণের মাধ্যমে লব্ধ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। শুধু তাই নয়, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, সুইডেন ও জার্মান থেকে আসা ডেইরি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমেই ইয়ন গ্রুপ দেশে দুধ উৎপাদনে অবদান রাখতে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয় করে এই হাইটেক ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ডেইরি ফার্ম স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। কর্তৃপক্ষ জানান, এই খামারে শুধু দুধ নয়, এর মাধ্যমে মাংস, চামড়া, জৈব সার এবং বিদ্যুত উৎপাদনে দেশে আমিশের চাহিদা আংশিকভাবে মেটানোর পাশাপাশি জাতীয় আয় স্থানীয়দের কর্মসংস্থান ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গরুগুলো রাখার জন্য সুইডেনের ডি লেভেলের নকশা অনুযায়ি উন্নত প্রযুক্তির বিশাল শেডের নিচে পৃথক পূথক ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি দুগ্ধ দোহনের জন্য সয়ংক্রিয় মিল্কিং পারলার স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় ৫০০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই খামারে শুধু গরুই না, স্থাপন করা হয়েছে গোচারণ ভূমি। তাদের যাতে বাইরের খাবার খাওয়াতে না হয়, সে জন্য ‘আলফা আলফা হে’ নামীয় কানাডা এবং সুইডেন থেকে আমদানি করা হয়েছে এক বিশেষ ধরণের ঘাষ ও ভুট্রার। এছাড়া ২৫০ একর জমিতে তা আবাদের প্রক্রিয়াও শেষ হয়েছে। সাধারণত স্থানীয় জাতের গরুর বর্জ্য অপসারণের যে গতানুগতিক সিস্টেম রয়েছে, এখানে তা নেই।
বর্জ্য অপসারণের জন্য স্ক্রাপার মেশিন আমদানি করে তা দিয়ে সাথে সাথেই সেই বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ জানান, মশা মাছি এবং আশপাশের গরু থেকে যাতে রোগ জীবানু না ছড়ায় এবং আমদানিকৃত এই গরুগুলো যাতে কোন ধরণের রোগে আক্রান্ত না হয় সেজন্য প্রায় দুই মাস আগে আশপাশের গ্রামগুলোর প্রায় দুই হাজার গরুকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে।
জানা যায়, ভবিষ্যতে এর আশপাশের গ্রামগুলোর প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র খামারিদেরকে স্বল্প মূল্যে বাছুর সরবরাহ করার পাশাপাশি সার্বিক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য, বিভিন্ন পরামর্শ ও চিকিৎসাসেবা দেয়া হবে এবং পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকে উৎপাদিত দুধ সংগ্রহ করার মাধ্যমে বাজারজাত করা হবে। এতে করে তারাও আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
উল্লেখ্য, গত ১২ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকে একটি কার্গো বিমানযোগে এই ২২৫টি অস্ট্রেলিয়ান গরু প্রথমে ঢাকায় এবং পরবর্তীতে ট্রাকযোগে রংপুরের এই খামারে নিয়ে আসা হয়। কর্তৃপক্ষের আশা স্থানীয় এই খামার থেকে উৎপাদিত দুধ দিয়ে প্রচলিত সব ধরণের দুগ্ধ পণ্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্য সম্মতভাবে উৎপাদন ও বাজারজাত করা হবে এবং দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানীর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গরুগুলোর দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত নেদারল্যান্ডসের ডেইরি বিশেষজ্ঞ এবং ফার্মের পরিচালক ফ্রাঙ্ক বাইজো জানান, অস্ট্রেলিয়া শীত প্রধান দেশ। সেখানকার আবহাওয়ার কথা বিবেচনা করে আমরা শীত মৌসুমে গাভীগুলো এনেছি। গ্রীষ্মকালে এদের শেডে কৃত্রিম কুয়াশা ও তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার ব্যবস্থা নেয়া আছে। যাতে গরমে গাভীগুলো অসুস্থ না হয়।
তিনি জানান, তার সার্বিক তদারকিতে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার এই অতিথিরা এখানকার আবহাওয়া এবং পরিবেশে একাত্ম হয়ে গেছে এবং যে লক্ষ্য নিয়ে এই খামারের প্রতিষ্ঠা তা-ও পুরণ হবে বলেই বিশ্বাস তার।
(এম/এসপি/নভেম্বর ২০, ২০১৯)