সচেতনতা বাড়াতে ৬৪ জেলায় যাচ্ছে ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’
‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ স্লোগানে চার ভ্রমণকন্যা সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জানান দিচ্ছেন নিজেদের স্বাধীনতার সত্তা। তবে স্কুটি ছেড়ে তারা এবার নৌকায় চড়লেন। ঘুরে বেড়ালেন রাজশাহীর পদ্মার চরে। সচেতনতা বাড়ালেন ভারতীয় সীমান্ত লাগোয়া দুর্গম চরের একটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
চার ভ্রমণকন্যা হলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসক সাকিয়া হক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মানসী সাহা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সিলভি রহমান ও ফারসি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শামসুন্নাহার সুমা। ভ্রমণদলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ-ভ্রমণকন্যা’র প্রতিষ্ঠাতা সাকিয়া হক।
রবিবার তারা রাজশাহীর চর খিদিরপুরে অবস্থিত ‘আলোর পাঠশালা’ স্কুলে যান। রাজশাহী মহানগরীতে স্কুটি রেখে সকাল সকাল তারা পৌঁছান নদীর পাড়ে। সকাল ৯টায় রাজশাহী শহরের বালুঘাট থেকে মাঝি মহিদুল ইসলাম মূল নদীতে যাওয়ার আগে ছোট একটা শাখা নদী পার করে দেন ভ্রমণকন্যাদের। সেখান থেকে তারা পায়ে হেঁটে যান মূল নদীর পাড়ে। এরপর মাঝি নাসিমের বড় নৌকায় চড়ে রওনা হলেন চরখিদিরপুরের উদ্দেশ্যে।
পথে বিকল হলো নৌকা। সেই ফাঁকে ভ্রমণকন্যারা অতিথি পাখিদের দেখে একটু আনন্দ-বিনোদনও করে নিলেন। এরই মধ্যে মাঝির প্রচেষ্টায় নৌকাটি আবার সচল হলো। যাত্রা আবার শুরু। চরখিদিরপুরের একপাশে নদী, তিনপাশে ভারত। যাত্রাপথের কিছু অংশ ভারতের ওপর দিয়ে যেতে হয়।
তখন ভ্রমণকন্যা ডা. মানসী সাহা বলেন, ‘দেশের ৬৪ জেলার পাশাপাশি অন্য একটি দেশও ভ্রমণ করা হয়ে গেল।’ বেলা ১১টায় তারা পৌঁছান আলোর পাঠশালায়। এভাবেই ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ-ভ্রমণকন্যা’-সংগঠনের সপ্তম পাঠের ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ পর্বে তারা রাজশাহীর দুর্গম চর ঘুরে গেলেন।
ভ্রমণদলের সাকিয়া হক জানান, ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ-ভ্রমণকন্যা’ নামের ফেসবুক গ্রুপে এখন ২৭ হাজার মেয়ে যুক্ত আছেন। তারা এখন দেশের ৬৪ জেলা ঘুরে ঘুরে নারীর সচেতনতা, আত্মরক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস এবং পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন। রাজশাহী তাদের যাত্রার ৪৬তম জেলা। ১২ জানুয়ারি ভ্রমণের এই ধাপ শুরু হয়। বিসিএস পরীক্ষা শুরু হওয়ায় এর পরবর্তী ধাপ আগামী ১ এপ্রিল থেকে শুরু হবে।
সাকিয়া হক ও মানসী সাহা স্কুল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত সব সময় একসঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন। আগে থেকেই তারা ঘুরতে পছন্দ করতেন। প্রথমদিকে তারা বাইরে যেতে চাইলে পরিবার থেকে জানতে চাইত, কতজন যাবে? যখন কেউ যেত না, তখন তাদেরও যেতে দেওয়া হতো না। এতে তাদের মন খারাপ হতো। তখন তারা সিদ্ধান্ত নেন, মেয়েদের ভ্রমণবিষয়ক একটি সংগঠন করা যায় কি না। এরপরই মানসী সাহা ও সাকিয়া হক ফেসবুকের মাধ্যমে সংগঠনটি দাঁড় করান। শুরুর দিকে সংগঠনকে সহায়তা করতে কর্ণফুলী গ্রুপ তাদের দুটি মোটরসাইকেল কিনে দেয়। প্রথমদিকে নিজেদের টাকায় তেল খরচ চালাতে হলেও সপ্তমধাপে এসে ভ্রমণকন্যারা পাশে পান স্কয়ার গ্রুপকে।
তারা জানান, প্রথমদিকে তাদের গতি কম থাকায় অনেকের নানারকম মন্তব্য কানে আসত। তারা সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর প্রতিবাদ করতেন। এখন তাদের চলার গতি বেড়ে যাওয়ায় কেউ মন্তব্য করলেও শুনতে পান না। এখন সামনাসামনি কেউ মন্তব্যও করেন না। তারা জানান, পরিবার ছেড়ে অনেকদিন বাইরে থাকায় মনটা খারাপ করে। বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে। প্রথমদিকে বাবা-মাও ভয় পেতেন। এখন তারা তাদের সাফল্যের কথা শুনে আর বাইরে যেতে দেওয়ার ভয়টা কেটে গেছে।
ভ্রমণদলের সঙ্গে রাজশাহী থেকে যোগ দেন তানজিলা তাসাবা ও রিয়াজুল জান্নাত। তারা বলেন, গ্রুপে তাদের রাজশাহী আসার কথা শুনে দেখা করতে এসেছেন। তাদের এই সামান্য ভ্রমণসঙ্গী হতে পেরে তারা নিজেদের ধন্য মনে করছেন। তারা জানান, এই ভ্রমণকন্যাদের সঙ্গে তারা এর আগেও সুন্দরবনসহ আরও দুই জায়গায় ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ভ্রমণে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছিল, ভালো লেগেছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগ দিতে ঢাকায় যেতে হয়। রাজশাহীতে এ রকম কোনো সংগঠন থাকলে তাদের জন্য ভালো হতো। তারাও ঘুরতে পারতেন।
আলোর পাঠশালায় জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গলা মেলান ভ্রমণকন্যারাও। এরপর একে একে তারা নারীর সচেতনতা, আত্মরক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস, পরিবেশ সচেতনতা, সড়ক নিরাপত্তা, বাল্যবিবাহ, পর্যটন-সম্ভাবনা, খাদ্য-পুষ্টি, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, বয়ঃসন্ধিকালীন নানা সমস্যা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, বিপদে নারীর আত্মরক্ষার জন্য করণীয়সহ বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন এবং শিক্ষার্থীদের কাছে এসব নিয়ে জানতে চান। যারা যারা সঠিক উত্তর দেয়, তাদের পুরস্কারস্বরূপ চাবির রিং দেওয়া হয়।
এরপর তারা রাজশাহী শহরের উদ্দেশে ফের নৌকায় করে রওনা হন। শীতের মিষ্টি রোদে নৌকার পাটাতনে বসে ঢেউয়ের সঙ্গে দুলতে দুলতে চলে আসেন শহরের পাঠানপাড়া মুক্তমঞ্চ ঘাটে। তাদের পরবর্তী গন্তব্য পুঠিয়া রাজবাড়ী হয়ে নাটোর। এভাবেই রাজশাহী ছেড়ে গেলেন ভ্রমণকন্যারা।
সপ্তম পাঠের মাধ্যমে তাদের দেশের ৫০টি জেলা ভ্রমণ সম্পন্ন হবে। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ভ্রমণকন্যারা এই পাঠ শেষ করবেন।
(ওএস/অ/জানুয়ারি ২৯,২০১৯)