সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতায় হাতছাড়া কোটি টাকার সম্পত্তি
স্টাফ রিপোর্টার : সরকারি কর্মকর্তাদের ক্রমাগত দ্বিমুখী অবস্থান ও দায়িত্বহীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাদের এমন অবস্থানের কারণে মূল্যবাদ সম্পত্তিও হারাচ্ছে সরকার। রাজধানীতে সরকারের মূল্যবান একটি সম্পত্তি রক্ষার প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এমনই চরম দায়িত্বহীনতা ও স্ববিরোধী অবস্থানের প্রমাণ মিলেছে।
ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল আদালতের মামলায় সরকার পক্ষ লড়েনি। রায় হয়েছে একতরফা। আবার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলেও তার খবর জানে না ঢাকা ডিসি অফিস, এমনকি গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রণালয়। আপিলে হাইকোর্টে হেরে যাওয়ার খবরও ছিল না এই দুই দফতরে। পরবর্তীতে একটি চিঠির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের এ বাড়িটির খোঁজ পড়ে। ডিসি অফিসের চিঠি পেয়ে নড়েচড়ে বসে পূর্ত মন্ত্রণালয়। দুই দফায় গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু দুটি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট নিয়েই বিতর্ক দেখা দেয়।
রাজধানীর মতিঝিলে ইত্তেফাক অফিসের কাছে ৩ আর কে মিশন রোডে ১৫ শতক জমি রয়েছে, মামলার কারণে যা বর্তমানে তর্কিত সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত। ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল মামলার রায়ের আলোকে নাসিম আশরাফুজ্জামান গং ২০১২ সালের জুলাই মাসে নামজারির জন্য ঢাকা ডিসির কাছে আবেদন করেন। এরপর ডিসি অফিস থেকে এই জমির বিষয়ে সূত্রাপুরের এসিল্যান্ডের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়। এসিল্যান্ড অফিসের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, জমিটি সরকারের পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত এবং এর মালিক গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। তবে ঢাকা সিটি জরিপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে একতরফা রায় ও ডিক্রি পেয়েছেন আবেদনকারী আশরাফুজ্জামান গং। আর এ জমির মূল মালিক ওয়াহেদুজ্জামান ওরফে খান্দু মিয়া। তবে তার নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যাওয়ায় ১৯৭২ সালের পিও-১৬ অনুযায়ী জমিটি সরকারের পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বলা হয়, সংশ্লিষ্ট জমিতে বর্তমানে ২৪ তলা বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। বিল্ডিং ফর ফিউচার লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণ করে আবেদনকারী নিজ দখলে রেখেছেন। তবে নামজারি করতে না পারায় সব ফ্ল্যাট তারা বিক্রি করতে পারেননি। এর আগে এ জমিটি ১৯৮১ সালে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক চিঠির মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে অবমুক্ত করা হয়েছে মর্মে একটি ছাড়পত্র উপস্থাপন করে আর এস রেকর্ডে ওয়ারিশগণের নামে জমিটি নামজারি করা হয়।
এদিকে এ বিষয়টি তুলে ধরে ২০১২ সালের ২ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ঢাকার ডিসি মোঃ মহিবুল হক পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দেন। তিনি সেখানে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে তিনটি বিষয়ে মতামত জানতে চান।
ঢাকা ডিসির এই চিঠি পাওয়ার সাত মাস পর গত বছর ২৮ মার্চ এ বিষয়ে পূর্ত মন্ত্রণালয়ে একটি নতুন ফাইল খোলা হয়। পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে সংশ্লিষ্ট জমিটি অবমুক্ত করা সংক্রান্ত চিঠির সত্যতা যাচাইয়ে মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন আইন কর্মকর্তা ও বর্তমানে আইন উপদেষ্টা (যুগ্ম সচিব) শাহ মোঃ আবু রায়হান আলবেরুনীকে প্রধান করে ২১ এপ্রিল এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। চার দিন পর তদন্ত কর্মকর্তা ২৫ এপ্রিল সচিবের কাছে রিপোর্ট প্রদান করেন। দুই পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টে তিনি মতামত হিসেবে শেষ প্যারায় উল্লেখ করেন, ১৯৮১ সালে যে চিঠি দিয়ে বাড়িটি বেগম লুৎফুন্নেছা ও উত্তরাধিকারীদের অনুকূলে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল তা সঠিক। অথচ তিনি নিজেই তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন, সংশ্লিষ্ট বাড়ির নথিটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া চিঠিতে স্বাক্ষরকারী তৎকালীন শাখা কর্মকর্তা বাবুল চক্রবর্তীর বক্তব্যও নেয়া হয়নি।
এদিকে এই তদন্ত প্রতিবেদন ও ফাইলের বিভিন্ন নোট পড়ার পর তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান গত বছর ২৪ জুন ফাইলের ২৯নং অনুচ্ছেদে লেখেন, একই ফাইলে একাধিক অনুচ্ছেদে পরস্পরবিরোধী মতামত/অভিমত রয়েছে। এ অবস্থায় অনুচ্ছেদ ১২ অনুযায়ী গঠিত কমিটির মতামতসহ পেশ করুন। দ্বিতীয় তদন্ত কমিটির রিপোর্টের বিষয়ে ফাইলের ৫২নং অনুচ্ছেদে যুগ্মসচিব আকবর হোসেন লেখেন, কমিটি যাচিত বিষয়ে সুস্পষ্ট রিপোর্ট দেয়নি। বরং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র, বিধিবিধান ও আইনগত দিক পরীক্ষা করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাড়িটি অবমুক্তির সময় (১৯৮১ সাল) পরিত্যক্ত বাড়ি অবমুক্তির বিষয়ে যে রিভিউ কমিটি ছিল বলে তদন্ত প্রতিবেদনে এবং সংশ্লিষ্ট নোটশিটে উল্লেখ আছে সেই রিভিউ কমিটির এখতিয়ার, উপসচিব সচিব পর্যায়ে অবমুক্তির সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত এখতিয়ার ইত্যাদি দিক পর্যালোচনা করে তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণের ওপর মতামত দেয়ার জন্য এ মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টাকে অনুরোধ করা যেতে পারে। এদিকে ৫৮ অনুচ্ছেদে আইন উপদেষ্টা শাহ মোঃ আবু রায়হান আলবেরুনী তার মতামতে বলেন, নালিশা জমিভূমি পরিত্যক্ত হিসেবে গত সিটি জরিপে ভ্রমাÍকভাবে রেকর্ড হয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আলোচ্য সম্পত্তিতে গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কোনো স্বত্ব/স্বার্থ নেই। বরং নালিশা সম্পত্তির বিষয়ে অনাপত্তি প্রদান করা হলে সরকারি বিভিন্ন প্রকার কর আদায়ে সরকার লাভবান হবে। এক্ষণে আবেদনকারীদের অনুকূলে নামজারি প্রদানে জেলা প্রশাসক, ঢাকাকে বলা যেতে পারে। এরপর ৫৯ অনুচ্ছেদে যুগ্মসচিব আকবর হোসেন লেখেন, বিজ্ঞ আইন উপদেষ্টার মতামত দেখলাম। তবে মতামতটি ৫২নং নোটানুচ্ছেদে যাচিত বিষয়ের উপর নয় এবং মালিকানার স্বত্ব বিষয়ক। বিষয়টি আমাদের বিবেচ্য নয়। অনুগ্রহপূর্বক ৫২নং নোটানুচ্ছেদের উপর মতামত দেয়ার অনুরোধ করা হল।
ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা মামলার রায় হয় ২০১১ সালের ২৩ নভেম্বর। এতে একতরফাভাবে রায় হয়েছে। অর্থাৎ এ মামলায় সরকার পক্ষে কেউ লড়েনি। এসব মামলায় সরকার পক্ষে জিপি মামলা ফেস করে থাকেন। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত জিপি তা করেননি। অথচ এ বিষয়ে ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট জিপি অ্যাডভোকেট ফকির দেলোয়ার হোসেন ঢাকার ডিসিকে দেয়া মতামতে জানিয়েছেন, আবেদিত সম্পত্তিতে সরকারের কোনো প্রকার স্বত্ব নেই।
(ওএস/এটি/এপ্রিল ১৩, ২০১৪)