মাঈনুল ইসলাম নাসিম : দক্ষিণ গোলোর্ধে এখন শীতের মৌসুম। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সে তুষারপাত না হলেও ৭ থেকে ১৪ ডিগ্রীর মধ্যে উঠানামা করছে তাপমাত্রা। শীতের আমেজে এবার যোগ হয়েছে যথারীতি হাই ভোল্টেজ ফুটবল টেম্পারেচার। ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত গোটা গ্লোব যখন বারবার উপভোগ করছে ‘মেসি ম্যাজিক’, তখন সেই লিওনেল মেসির দেশ আর্জেন্টিনাই আজ আমাদের ডেস্টিনেশান, যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন ২৫০ জন বাংলাদেশি।

আয়তনে বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ১৯ গুণ বড় হলেও আর্জেন্টিনার জনসংখ্যা বাংলাদেশের ৪ ভাগের ১ ভাগ। মাত্র ৪ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই বিশাল দেশটিও বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশিদের কাছে ব্যবহৃত হয়েছে মেক্সিকো হয়ে বৈধ-অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে। এ অবধি কম করে হলেও হাজার পাঁচেক বাংলাদেশি আর্জেন্টিনা হয়ে পাড়ি জমিয়েছেন তাদের স্বপ্নের দেশে। পাসপোর্ট ম্যানেজ করে কেউ কেউ উড়ে চলে গেছেন ইউরোপে, এমনও হয়েছে বিগত দিনে।

আড়াইশ বাংলাদেশির মাঝে বুয়েনস আয়ার্সে বসবাস করেন প্রায় দেড়শ’। বাকি শ’খানেক আছেন রাজধানীর বাইরে সাগর পাড়ের বিভিন্ন শহরে-নগরে, যেখানে লক্ষ লক্ষ পর্যটকের ভিড় লেগে থাকে গ্রীষ্মে। বাইরে যারা আছেন কাগজপত্রের দিক দিয়ে তারা প্রায় সবাই পুরোপুরি বৈধই শুধু নন, ভারত সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা কাপড়চোপড় ও অন্যান্য পন্যের রমরমা ব্যবসা তাদের। রাজধানীর স্বদেশী লোকজনের সাথে তারা তেমন যোগাযোগ রাখেন না বললেই চলে। আর্জেন্টাইন সমুদ্র সৈকতে লাখ লাখ ডলারের বানিজ্য আছে বেশ ক’জন বাংলাদেশির।

বুয়েনস আয়ার্সের বাংলাদেশিরাও ঐ একই ধরণের বা আইটেমের ব্যবসার সাথে জড়িত, তবে সাগর পাড়ের মতো ততোটা বিগ ভলিউমে নয়। বৈধতা পাবার পর লাইসেন্স সহ দোকান নিয়ে যারা ব্যবসা করছেন, শীত মৌসুম তথা এপ্রিল থেকে আগস্ট অফ সিজনে গড়পড়তায় তাদের ৩ থেকে ৪ হাজার ইউএস ডলার প্রফিট হয়। গরমের সময় হট বিজনেস। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ গ্রীষ্মের ভরা মৌসুমে বুয়েনস আয়ার্সের বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার ডলারও ক্যাশ করে থাকেন।

রাজধানীর পুরনো বাংলাদেশিদের মধ্যে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার শাহ আলম এবং মাদারীপুরের রোকন সিকদার উভয়ের রয়েছে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের ব্যবসা। মাদারিপুরের অপর প্রবীণ বাংলাদেশি বেলায়েত হোসেন এবং বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন পটুয়াখালীর মেহেদী হাসানের মতো লাইসেন্সধারীদের ব্যবসা দোকান নিয়ে বৈধভাবে। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আর্জেন্টিনার সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যের প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে ভারতীয় পন্যের উপরই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হচ্ছে এখানকার বাংলাদেশি ব্যবসায়িদের। এতে করে বাংলাদেশিদের ব্যবসা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।

আর্জেন্টিনার রাজধানীতে যারা এখনো পুরোপুরি বৈধ হতে পারেননি বা লাইসেন্সসহ দোকান নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ পাননি, তারাও কিন্তু বসে নেই। মেক্সিকোর মতো এখানেও তারা ডাউনটাউনের পাইকারি বাজার থেকে মালামাল কিনে দূর-দূরান্তে তা বহন করে নিয়ে বিক্রি করছেন। কে কত বেশি পরিশ্রম করতে পারেন, এই থিওরিতে ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ি হিসেবে লাইসেন্স-দোকান ছাড়াই মাসান্তে তাদের পকেটে আসছে ১ থেকে ৩ হাজার ডলার।

আর্জেন্টাইন পাসপোর্ট হাতে নেবার সময় বাংলাদেশি পাসপোর্ট সারেন্ডার করতে হয়না। দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ এদেশে। আর্জেন্টিনা-বাংলাদেশ ডুয়েল সিটিজেনশিপ এমন প্রায় ২৫ জন আর্জেন্টাইন-বাংলাদেশির বসবাস রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সে। আরো ২৫ জনের মতো আছেন পারমানেন্ট রেসিডেন্ট কার্ডধারী। বাকি প্রায় ১০০ জন যারা আইনগতভাবে অবৈধ নন, কিন্তু লিগ্যাল স্ট্যাটাসের দিক থেকে তারা ঝুলে আছেন রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে।

গত ২০ বছরের রেকর্ড অনুযায়ি মাত্র ৮ থেকে ১০ জন ছাড়া আর্জেন্টিনায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের সবাই পুরোপুরি বৈধ হয়েছেন চুক্তিভিত্তিক বিবাহ তথা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের মাধ্যমে। নিয়মিত বা ঢালাও ইমিগ্রেশনের কোন সুযোগ নেই। সর্বশেষ ২০০৪ সালে সাধারণ ক্ষমার আওতায় অবৈধদের বৈধ করে নিয়েছিল দেশটির সরকার। ১০ বছর আগেকার ঐ সময় পর্যন্ত রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেও বাংলাদেশিরা সফল হতো, কিন্তু ইদানিং প্রশাসনের সচেতনতায় বাংলাদেশিদের কেস টিকে না বললেই চলে।

আর্জেন্টিনায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের অর্থের কোন কমতি না থাকলেও বিশেষ করে রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সের বাংলাদেশিদের মাঝে ঐক্যের দারুণ অভাব। পুরনো যারা আছেন তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক রেষারেষি ও আভ্যন্তরিণ ঈর্ষার জের ধরে আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি কোন সভা সমিতি সংগঠন। বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো পালনের জন্যও কোন এসোসিয়েশন না থাকায় ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর তারিখে খোলা মাঠে গিয়ে শুধু ক্রিকেট বা ফুটবল খেলেই কাটাতে হয় অপেক্ষাকৃত নবীন বাংলাদেশিদের।

আর্জেন্টিনার মাটিতে বিগত দিনে ৪ জন বাংলাদেশির মৃত্যুবরণের তথ্য হাতে আসে এই প্রতিবেদকের। কারো লাশ দেশে পাঠানো হয়নি। না ফেরার দেশে চলে যাওয়া ৪ জনের মধ্যে ৩ জনকে বুয়েনস আয়ার্সের ইসলামী কবরস্থানে দাফন করা হয়। আর রাজধানীতেই বিশেষ চুল্লীতে দাহ করা হয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী অপর বাংলাদেশিকে। সৌদি বাদশাহর অনুদানে তৈরী বিশাল মসজিদ রয়েছে আর্জেন্টিনার রাজধানীতে।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোতে সাম্প্রতিক বছরে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রয়োজন থাকা সত্বেও বুয়েনস আয়ার্সে আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি বাংলাদেশ মিশন। সুদূর কানাডার অটোয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে দেখা হয় আর্জেন্টিনা। অথচ দেশটির বিশাল আইটি সেক্টরে উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। ভারত থেকে বছর জুড়ে দলে দলে আইটি’র লোকজন আসে এখানে তাদের মেধাকে কাজে লাগাতে। ব্রাজিলের মতো আর্জেন্টিনাতেও সম্ভব বাংলাদেশি গার্মেন্টসের বাজার সুনিশ্চিত করা। বাংলাদেশে তৈরী হস্তশিল্পও ভালো বাজার করে নিতে পারে সুনিশ্চিতভাবে।

পৃথিবীর সর্বদক্ষিনের পাতাগোনিয়া অঞ্চলের কথা না বললেই নয়। দক্ষিণ আর্জেন্টিনা ও চিলির বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে রয়েছে স্পেনিশ ও ইতালিয়ান মালিকানাধীন বহু ফিশিং কোম্পানি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে দিন-রাত সাগরে ধরা হয় হাজার হাজার টন মাছ, যা রপ্তানি হয়ে থাকে ইউরোপে। ফিশারম্যান তথা জেলে হিসেবে যারা কাজ করছেন তাদের বেশির ভাগই ইন্দোনেশিয়ান। মাসান্তে এখানকার জেলেদের আয় ৫ থেকে ৬ হাজার ইউএস ডলার। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি ফিশারম্যানদের ব্যাপক সুনাম থাকায় আর্জেন্টাইন পাতাগোনিয়ার মৎস জগতেও খুলতে পারে বাংলাদেশের শ্রমবাজার।
(এএস/জুলাই ০২, ২০১৪)