E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

সাংবাদিক আশফাকের বাসার গৃহকর্মীরা কেন বারবার লাফ দেয়?

২০২৪ ফেব্রুয়ারি ১১ ১৯:০৪:৪৪
সাংবাদিক আশফাকের বাসার গৃহকর্মীরা কেন বারবার লাফ দেয়?

স্টাফ রিপোর্টার : ছয় মাস আগেও সাত বছরের এক শিশু গৃহকর্মী বাসা থেকে লাফ দিয়েছিল। রক্তাক্ত জখম হলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় ফেরদৌসি নামের সেই শিশুটি। সে ঘটনায় মামলাও হয়েছিল। ছয় মাস পেরোতে না পেরোতেই আবারও এক শিশু গৃহকর্মী একই বাসা থেকে লাফ দেয়। এবার আর ভাগ্য সহায় হয়নি। আট তলা থেকে লাফ দিয়ে এক তলার গ্যারেজের ছাদের ওপর পড়ে ১৫ বছর বয়সী প্রীতি উড়ান। হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

ছয় মাসের ব্যবধানে পরপর দুই শিশু গৃহকর্মীর সঙ্গে একই ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক আশফাকুল হকের বাসার ভেতরে কী এমন ঘটনার অবতারণা হয় যে শিশু গৃহকর্মীরা আট তলা থেকে লাফ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে? বাসায় কি তাদের শারীরিক, মানসিক কিংবা যৌন নির্যাতন করা হয়? নাকি শিশুদের ফেলে দেওয়া হচ্ছে?

অবশ্য প্রীতি উড়ানের বাবার অভিযোগ, অভাবের কারণে দুই বছর আগে মিন্টু নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে সাংবাদিক আশফাকুল হকের বাসায় ছোট মেয়েকে গৃহকর্মীর কাজে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আশফাকুল হকের পরিবার দুই বছরেও মেয়েকে তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। মাসে দুই-একবার গৃহকর্তার মোবাইলে যোগাযোগ করে কথা বলিয়ে দিতো তারা।

মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে মোহাম্মদপুরের শাজাহান রোডের ওই বাসার নিচতলার গ্যারেজের ওপর থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় প্রীতি উড়ানকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যান বাসার কেয়ারটেকার। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। ওই ভবনের অষ্টম তলার একটি ফ্ল্যাটে সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসা।

এই ঘটনায় নিহত প্রীতি উড়ানের বাবা লুকেশ ওড়ান বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা (নম্বর ৩৭) দায়ের করেছেন। মামলায় সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারকে আসামি করা হয়েছে। বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে তাদের আদালতে সোপর্দ করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি শেষে আশফাকুল হক ও তানিয়াকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।

অবহেলাজনিত কাজের দ্বারা মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগ

আলোচিত এই ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় যে মামলা হয়েছে, তাতে দণ্ডবিধির ৩০৪-ক ধারায় অবহেলাজনিত কাজের দ্বারা মৃত্যু ঘটনানোর অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার এজাহারে লুকেশ ওড়ান বলেছেন, ‘আটককৃত ব্যক্তিরা (আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার) অবহেলাজনিতভাবে বাসার জানালায় নিরাপত্তা বেস্টনী না দিয়ে অরক্ষিত অবস্থায় রাখার কারণে ওই জানালার ফাঁক দিয়ে আমার মেয়ে প্রীতি উড়ান পড়ে গিয়ে গুরুতর রক্তাক্ত জখম হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।’

মামলার এজাহারে লুকেশ ওড়ান আরও বলেন, ‘আমি ও আমার স্ত্রী খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারি যে, আমার মেয়ে প্রীতি উড়ান সকাল ৮টার দিকে বাসায় কাজ করার সময় ড্রয়িং স্পেসের জানালায় কোনও নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় থাই গ্লাসের ফাঁকা দিয়ে নিচে পার্কিংয়ের ছাদের ওপর পরে গিয়ে গুরুতর রক্তাক্ত জখম হয়ে মারা গিয়েছে। ওই বাসায় গৃহ পরিচারিকার কাজ করা অবস্থায় গত বছরের ৪ আগস্ট ফেরদৌসি নামে আরেক গৃহকর্মী একইভাবে জানালার নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় থাই গ্লাসের ফাঁকা দিয়ে নিচে পড়ে গিয়ে রক্তাক্ত জখম হলে বাসার মালিকের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা হয়। আমরা বুঝতে পারি যে বাসার লোকজনসহ বাসার মালিকের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে বাসার জানালার নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে।’

মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভুঁইয়া বলেন, ‘একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিকারণে অবহেলাজনিত মৃত্যু ঘটানোর ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে। আমরা পোস্টমর্টেমের জন্য অপেক্ষা করছি। এছাড়া তদন্ত চলছে, তদন্তে যদি সরাসরি হত্যার অভিযোগের প্রমাণ বা অন্য কিছু পাওয়া যায়, তাহলে সে অনুযায়ী আইনি প্রক্রিয়া চালানো হবে।’

এক মিনিট ঝুলে ছিল প্রীতি!

মামলার এজাহারে নিহত প্রীতির বাবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে পড়ে গিয়ে মারা যাওয়ার কথা বললেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পড়ে যাওয়ার আগে এক থেকে দেড় মিনিট জানালার গ্রিল ধরে ঝুলে ছিল প্রীতি। বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিন শাজাহান রোডের ওই বাসায় গেলে দেখা যায়, ভবনের সামনে পুলিশি নিরাপত্তা মোতায়েন করা হয়েছে। অনুমতি ছাড়া সাংবাদিকদের কাউকে বাসার ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, ঘটনার সময় তারা কেউ দায়িত্বরত অবস্থায় ছিলেন না। এজন্য ঘটনার কীভাবে ঘটেছে তা বলতে পারেননি।

তবে প্রত্যক্ষদর্শী পাশের ১/২ নম্বর ভবনের নিরাপত্তাকর্মী আনাস জানান, ‘আমি এসে দেখি মেয়েটি ঝুলছে। আমি নিচে আসার পর ঠিক এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে মেয়েটি ওই ভবন থেকে নিচে পড়ে যায়। মেয়েটা পড়ার পর অনেক লোকজন ভিড় করেছে। তবে কেউ মেয়েটাকে ধরছিল না। পরে আমি ও একজন নিউজপেপার বিক্রেতা মেয়েটিকে রিকশায় উঠিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই।’

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের একজন বাসিন্দা রিকশাচালক জাবেদ হোসেন বলেন, ‘আমি সবসময় ওই আশেপাশের কয়েকটি ভবনে যাত্রীদের নিয়ে চলাচল করি। মঙ্গলাবার (৬ জানুয়ারি) সকাল ৮টার দিকে আমি রিকশা নিয়ে ওই ভবনের দক্ষিণ পাশেই যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এই সময় হঠাৎ দেখি ভবনের কয়েক তলার ওপরে বারান্দায় ছোট একটি মেয়ে দুই হাত ওপর দিয়ে ঝুলতেছে। আমি দেখে দ্রুত ভবনের নিরাপত্তা কর্মীকে বিষয়টি জানাই। কিন্তু তারা প্রথমে দরজা খুলতে চায়নি। যখন ওপর থেকে মেয়েটা পড়ে যায়, পাশের ভবনের নিরাপত্তাকর্মী আনাসসহ আরও কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান।’

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আশফাকুলের বাসার ড্রয়িং রুমের জানালাই লোহার কোনও গ্রিল নেই। থাই গ্লাস দিয়ে জানালা আটকানো থাকে। জানালার বাইরের দিকে ফুলের টব রাখার জন্য লোহার গ্রিলের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, ওই গ্রিল ধরে প্রীতি ঝুলে ছিল।

শরীরে দাগ

আলোচিত এই ঘটনায় নিহত প্রীতির সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই সাদিয়া। সুরতহাল প্রতিবেদনে নিহত প্রীতির শরীরে নতুন ও পুরাতন কিছু দাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে জখমের দাগগুলো পড়ে যাওয়ার কারণে নাকি আগে থেকেই ছিল তা নির্ণয় করা যায়নি।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে মেয়েটির নিম্নাংশে কোনও কাপড় ছিল না উল্লেখ করা হলেও সুরতহাল প্রস্তুতকারী এসআই সাদিয়া জানান, মেয়েটির পড়নে একটি সাদা স্কিনটাইট পাজামা ছিল। প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলমতও পাওয়া যায়নি। তবে শরীরে যেসব দাগ বা ক্ষত পাওয়া গেছে সুরতহালে উল্লেখ করা হয়েছে।

এসআই সাদিয়া জানান, পড়ে গিয়ে বডির অবস্থা এমন হয়েছে যে সাধারণভাবে এসব দাগ আলাদা করে নির্ণয় করা কঠিন। ময়নাতদন্তে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

শারীরিক-মানসিক নির্যাতন?

সাংবাদিক আশফাকুল হকের বাসায় পরপর একই ধরনের দুটি ঘটনা ঘটার পর প্রশ্ন উঠেছে, বাসায় গৃহকর্মীদের শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা হতো কি না? তা না হলে ছয় মাসের ব্যবধানে দুই শিশু গৃহকর্মী জানালা দিয়ে লাফ দেওয়া বা পালানোর চেষ্টা করবে কেন? আর সৈয়দ আশফাকুল হকের মতো ‘সমাজসচেতন’ ব্যক্তি কেন একটি ঘটনার পর সতর্ক হলেন না?

মামলার এজাহারে অবশ্য নিহত প্রীতির বাবা অভিযোগ করেছেন, গত দুই বছর ধরে প্রীতিকে তাদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। মাসে একবার-দুবার গৃহকর্তার মোবাইল ফোনে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, বারবার একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়। ওই বাসায় কেউ না কেউ গৃহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা শারীরিক- মানসিক নির্যাতন করতেন বলে তারা ধারণা করছেন। একারণে গৃহকর্মীরা বাসায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। বাসা থেকে পালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এছাড়া কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভুঁইয়া বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার গৃহকর্মীর নিচে পড়া সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করার চেষ্টা চলছে।

নিহত প্রীতির চাচা লগেন উড়াং জানান, ওই বাসায় তসু নামে আরেকটি মেয়ে কাজ করতো। ওই মেয়েটি তাদের জানিয়েছে, বাসায় কাজকর্মে ভুলত্রুটি হলে বাসার ম্যাডাম তাদের মারধর করতো।

আগের মামলায় বাদীর সঙ্গে আপস

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছয় মাস আগে একই বাসা থেকে ফেরদৌসি পড়ে আহত হওয়ার ঘটনায় শিশুটির মা জোছনা বেগম মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। ওই মামলাতেও সৈয়দ আশফাকুল হক, তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার ও আসমা আক্তার শিল্পী নামে এক নারীকে আসামি করা হয়েছিল। আসমা আক্তার ওই শিশুকে সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় কাজে নিয়োজিত করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিল।

সেসময় পুলিশ সূত্র জানায়, শিশুটি বাসায় কাজ করতে না চাইলেও তাকে বাসায় আটকে রেখে কাজ করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শিশুটি ড্রয়িং রুমের থাই গ্লাস খুলে পালিয়ে যাওয়ার জন্য লাফিয়ে পড়ে। ওই ঘটনায় শিশু আইনের ৭০ ধারায় শিশুকে হেফাজতে রেখে ব্যক্তিগত কাজে নিয়োজিত করে নির্যাতন ও অবহেলায় সংগঠিত শিশুর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতির ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।

মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভুঁইয়া জানান, মামলার আসামিরা বাদীর সঙ্গে আদালতে আপস করেছিল। পরে তদন্ত কর্মকর্তা সেই আপসনামার ভিত্তিতে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

(ওএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

১৪ নভেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test