E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

বাঘায় আম বাগানের মধ্যে সাথী ফসল হিসেবে কিনোয়া চাষ

২০২২ এপ্রিল ২৭ ১৮:৫৪:১৭
বাঘায় আম বাগানের মধ্যে সাথী ফসল হিসেবে কিনোয়া চাষ

আবুল হাশেম, রাজশাহী : টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ০২ নং গোল হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা, টেকসই কৃষি উন্নয়ন ও মানসম্পন্ন পুষ্টির সরবরাহ সুনিশ্চিতকরণ। তাই, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের সরবরাহের পাশাপাশি নিরাপদ পুষ্টিকর খাবারের দিকে পুষ্টিবিদগণ গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবারের উৎস হিসেবে উদ্ভিদের কোন বিকল্প নাই। তেমনি একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের উৎস হচ্ছে কিনোয়া ফসল। আমের রাজধানী বলে খ্যাত বাঘায় আম বাগানের মাঝে সাথী ফসল হিসেবে কিনোয়া চাষ সবার নজর কেড়েছে।

কিনোয়া হচ্ছে একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। বাংলায় কিনোয়া কোরা, দানা, কান্তি নামেও মানুষের কাছে পরিচিত। কিনোয়া কাউনের মতো দেখতে। এটি উচ্চমান সম্পূর্ণ পুষ্টিকর খাদ্য ও ক্যালোরি যুক্ত দানাদার খাবার। ভাত, রুটির বিকল্প হিসেবে ইউরোপ, আমেরিকার, উত্তর আমেরিকা, চীন ও ভারতের মানুষ খায়।

এক ধরনের ফুলগাছের বীজ হল কিনোয়া। হোল গ্রেন কাউন্সিলের তথ্য অনুসারে, এটি হল গ্লুটেন ফ্রি হোল গ্রেন কার্বোহাইড্রেট। স্পষ্ট কথায় যাকে বলা যায় বন্ধু কার্বোহাইড্রেট। এতে যেমন কার্বন আছে, তেমনই প্রোটিনে ভরপুর। শস্য না হয়েও যেহেতু শস্যের মতোই কাজ করে, তাই অনেকেই একে সিউডো সিরিয়ালও বলে থাকেন। সাদা, লাল ও কালো— মূলত এই তিন ধরনের কিনোয়া পাওয়া যায়। সাদা কিনোয়া সহজপ্রাপ্য। লাল, সাদার তুলনায় কালো কিনোয়া বেশি মিষ্টি হয়।

কিনোয়া হলো হাই প্রোটিন সম্পন্ন খাবার। এটিকে সুপার ফুডও বলা হয়। কিনোয়াতে অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে এবং লাইসিন সমৃদ্ধ, যা সারা শরীরজুড়ে স্বাস্থ্যকর টিস্যু বৃদ্ধিকে সহায়তা করে। কিনোয়া আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন ই, পটাসিয়াম এবং ফাইবারের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। রান্না করা হলে এর দানাগুলো আকারে চারগুণ হয়ে যায়।
এ সকল পুষ্টিগুণের কারণে কিনোয়াকে সুপারফুড বলা হয়।

কিনোয়া কিন্তু খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত প্রাচীন। উৎপত্তিগত দিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় এই ফসলের নিদর্শন ও বর্ণনা পাওয়া যায় প্রাচীন ইনকা সভ্যতার সাক্ষী সব পুরাকীর্তি খুঁজতে গিয়ে। নৃতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, সেই সাত হাজার বছর আগেই দক্ষিণ আমেরিকার আন্দেস অঞ্চলে কিনোয়া ফলানো হতো। ইনকা ভাষায় একে কিনোয়া বা খাদ্যশস্যের জননী বলা হতো। একে পবিত্রও মনে করা হতো। এর কারণ, ইনকা যোদ্ধারা অমিত শক্তির অধিকারী হতেন কিনোয়া খেয়ে, এমনটাই বিশ্বাস ছিল প্রাচীন ইনকাদের মধ্যে। পরবর্তী সময়ে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা কিনোয়ার পুষ্টিগুণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রীতিমতো অবাক হয়ে গেছেন। আধুনিক যুগে এই সুপারফুডের প্রচলন এতটাই সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় মনে করা হয় যে ২০১৩ সালটিকে আন্তর্জাতিক কিনোয়া বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল জাতিসংঘের পক্ষ থেকে।

কিনোয়া হচ্ছে একমাত্র উদ্ভিজ্জ প্রোটিন উৎস, যাতে ৯ ধরনের এসেনশিয়াল অ্যামিনো অ্যাসিড উপস্থিত আছে। বিশেষত লাইসিন নামের অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিড আর কোনো উদ্ভিজ্জ আমিষ খাদ্য থেকে সেভাবে পাওয়া যায় না।

শিশুদের পক্ষে এই দানাশস্যটি অত্যন্ত পুষ্টিকর। কিনোয়া দানাশস্য যেমন স্বাদে খেতে ভালো তেমনই পুষ্টিকর। মূলত পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে এই দানাশস্যের ফলন দেখার মতন। এশিয়া মহাদেশেরও অন্যান্য দেশেও এখন এই বিশেষ্য দানাশস্যের চাষ হচ্ছে।

কিনোয়ায় আমাদের দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সব খনিজ খাদ্য উপাদান আছে খুব ভালো পরিমাণে। এক কাপ রান্না করা কিনোয়ায় আছে দৈনিক চাহিদার ৫৮ শতাংশ ম্যাঙ্গানিজ, ৩৯ শতাংশ ম্যাগনেশিয়াম, ১৯ শতাংশ ফোলেট, ১৫ শতাংশ আয়রন ও ৯ শতাংশ পটাশিয়াম। এ ছাড়াও কিনোয়া ফাইটোনিউট্রিয়েন্টসে ভরপুর।

এতে আছে কোয়েরসেটিন (Quercetin) ও ক্যাম্পফেরল (Kaempferol) নামের এ দুই ধরনের অত্যন্ত উপকারী অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট বা ফ্ল্যাভেনয়েড।

বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গবেষণাপত্রে প্রমাণ মিলেছে, এই ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট দুটি খুবই কার্যকর প্রদাহবিরোধী বা অ্যান্টি–ইনফ্ল্যামেটরি ভূমিকা রাখতে পারে। এদের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতাও উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তাই মহামারির এই ভয়াবহ সময়ে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম গড়তে কিনোয়া ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।

বিভিন্ন ভেটেরিনারি গবেষণায় ক্যানসার প্রতিরোধেও আশা জাগানিয়া ফল দিচ্ছে কিনোয়া। তাই মানবদেহের ক্যানসার গবেষণায়ও কিনোয়াকে এগিতে রাখা হচ্ছে।

কিনোয়া প্রায় সব রকমের মাটিতে চাষ করা যায়। তবে বেলে দোঁআশ মাটি সবচেয়ে বেশি ভালো। পানি দাঁড়িয়ে থাকে না এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মাটি বেলে-দোআঁশ যুক্ত মাটি। শীতের সময় আবহাওয়া কিনোয়া ফসল চাষের উপযোগী থাকে।

কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার কামরুল ইসলাম বলেন, অগ্রহায়ণ বা নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি কিয়ানোর বীজ বপন করা হয়। কিয়ানোর বীজ ছিটিয়ে অথবা সারিতে বপন করা যায়। বিঘা প্রতি ১.২৫-১.৫ কেজি বীজ লাগে। সারি থেকে সারি ২৫-৩০ সেমি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬-৮ সেমি। ( ২৫-৩০ x ৬-৮ সেমি) অনুসরণ করতে হয়।
চারা গজিয়ে গেলে ২-৩ সপ্তাহের ভেতর সারিতে চারার দূরত্ব ৬-৮ সেমি অনুযায়ী বাদবাকি চারা উঠিয়ে নিতে হবে।
কিনোয়া চাষে রাসায়নিক সার প্রয়োগ না করা ভালো। কিনোয়া খরা সহ্য করেও বেঁচে থাকতে পারে। তবে গরমকালে যদি খরা দেখা দেয় তাহলে ১-২ টি সেচের ব্যবস্থা করলে ফলন ভালো হয়। আগাছা দেখা দিলে জমিতে, তাহলে সেই জমি নিড়ানি দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে। বীজ বপণ থেকে পরিপক্কতা পর্যন্ত ১০০-১১০ দিনের মত লাগে। সাধারণত মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে কিনোয়া সংগ্রহ করা যায়। বিঘা প্রতি ৪-৫ মণ ফলন পাওয়া যায়।

বাঘা উপজেলার মনিগ্রাম ইউনিয়নের কৃষক মোঃ ফারুক হোসেন জানান, উপজেলা কৃষি অফিসের সহযোগিতায় প্রথমবারের মত ১৫ কাঠা জমিতে কিনোয়া আবাদ করেন। তার মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৩১৭০ টাকার মত। বপণের ৮৯ দিন পর কিনোয়া কাটতে পেরেছি এবং ১১০ কেজি ফলন পেয়েছি। ডিসেম্বর মাসের ২৬ তারিখ কিনোয়া লাগিয়ে মার্চ মাসের ২৫ তারিখ কর্তন করেছি। বাজার যদি বিক্রয় করতে পারা যায়, তাহলে প্রায় ৮০-৯০ হাজার টাকার বীজ বিক্রয় হবে বলে আশা করছি।

উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, বাঘায় শস্য নিবিড়তা বাড়াতে আমরা আন্তঃমিশ্র ফসলের দিকে জোর দিচ্ছি। তারই ধারাবাহিকতায় ছোট আম বাগানের মাঝে আমরা কিনোয়া চাষ করি। কৃষকের উৎপাদিত বীজ উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে সংরক্ষিত করা হবে এবং আগামী বছর কিনোয়া সম্প্রসারণে আরো অধিক সংখ্যক কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বিনামূল্যে বীজ প্রদান করা হবে। বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার তরূণদের আধুনিক কৃষি কাজের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হতে উৎসাহিত করতে উউপজেলা কৃষি অফিসারের কার্যালয় থেকে বিশেষ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হচ্ছে।

(এএইচ/এসপি/এপ্রিল ২৭, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test