E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বিশ্ব মেধা সম্পদ দিবস

উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতার বৈশ্বিক স্বীকৃতি

২০২৫ এপ্রিল ২৫ ১৮:১২:২৩
উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতার বৈশ্বিক স্বীকৃতি

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বিশ্বায়নের এই যুগে একটি দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হলো জ্ঞানভিত্তিক সম্পদ বা ‘মেধা সম্পদ’। প্রযুক্তি, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, ওষুধ বা এমনকি কৃষিক্ষেত্রেও আজ সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটছে। এই মেধা ও সৃজনশীলতাকে সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দিতে প্রতিবছর ২৬ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী পালিত হয় "বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস" বা "World Intellectual Property Day"।

এই দিবসটি মূলত মেধাসম্পদের গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা এবং সংশ্লিষ্ট অধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য উদযাপন করা হয়। এই প্রবন্ধে আমরা দিবসটির ইতিহাস, তাৎপর্য, মেধা সম্পদের বিভিন্ন ধরণ, এর প্রয়োজনীয়তা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ওপর আলোচনা করব।

মেধা সম্পদ কি?

মেধাসম্পদ (Intellectual Property বা IP) হলো মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তা, উদ্ভাবন বা সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের ফলাফল, যা আইনত সুরক্ষিত। মেধাসম্পদ বিভিন্নভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা যায়, যার মধ্যে রয়েছে—

পেটেন্ট (Patent): নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বা প্রক্রিয়ার স্বত্ব।

স্বত্বাধিকার (Copyright): সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, ছবি, সফটওয়্যার ইত্যাদির সৃষ্টিকারীর অধিকার।

ট্রেডমার্ক (Trademark): পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় বহনকারী চিহ্ন, নাম বা প্রতীক।

ডিজাইন স্বত্ব (Industrial Design): পণ্যের বাহ্যিক নকশা বা চেহারার স্বত্ব।

জিআই (GI – Geographical Indication): নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার ঐতিহ্যবাহী পণ্যের স্বীকৃতি।

মেধাসম্পদ আইনের মাধ্যমে এই সকল অধিকার রক্ষা করা হয় যাতে সৃষ্টিকারী ব্যক্তির শ্রম ও মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হয় এবং চুরি বা অননুমোদিত ব্যবহার রোধ করা যায়।

বিশ্ব মেধা সম্পদ দিবসের ইতিহাস

বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস পালনের উদ্যোগ নেয় বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থা (WIPO – World Intellectual Property Organization)। ২০০০ সালে এই দিবসটি প্রথমবারের মতো উদযাপন করা হয়। ১৯৭০ সালের ২৬ এপ্রিল WIPO-এর কনভেনশন কার্যকর হয়, আর সেই দিনটিকেই স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর ২৬ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করা হয়।

দিবসটির উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য

বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো—

উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতা উদযাপন করা।

মেধাসম্পদের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো।

উদ্যোক্তা, গবেষক ও শিল্পীদের উৎসাহিত করা।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে মেধাসম্পদের ভূমিকা তুলে ধরা।

মেধাসম্পদ চুরি, জালিয়াতি ও অবৈধ কপি প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি।

প্রতিবছর WIPO একটি নির্দিষ্ট থিম নির্ধারণ করে, যেমন: "Women and IP", "IP and SMEs", "Innovation – Improving Lives", ইত্যাদি। এই থিম অনুযায়ী নানা দেশের সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে।

মেধাসম্পদ ও বৈশ্বিক উন্নয়ন

আজকের পৃথিবীতে প্রযুক্তি ও জ্ঞানের গুরুত্ব এতটাই বেড়েছে যে, মেধাসম্পদকেই বলা হচ্ছে ‘নতুন যুগের পুঁজি’। যে দেশ যত বেশি উদ্ভাবনী এবং মেধাসম্পদ রক্ষায় সক্ষম, সে দেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে তত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ—

যুক্তরাষ্ট্র: প্রযুক্তি, সফটওয়্যার, বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিতে পেটেন্ট ও কপিরাইটের মাধ্যমে বিলিয়ন ডলারের বাজার তৈরি করেছে।

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া: বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক পণ্যে পেটেন্টের বিশাল ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে।

চীন: বিগত এক দশকে সবচেয়ে বেশি পেটেন্ট আবেদনকারী দেশ হিসেবে উঠে এসেছে, যা তাদের উদ্ভাবনী প্রবণতা ও অর্থনৈতিক শক্তির ইঙ্গিত দেয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশেও মেধাসম্পদের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। সরকার ২০০৩ সালে "মেধাসম্পদ অধিদপ্তর" গঠন করে এবং পরবর্তীতে একে পূর্ণাঙ্গ "পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর" (DPDT) হিসেবে রূপান্তর করে। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে কয়েকটি পণ্যের জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) স্বীকৃতি লাভ করা হয়েছে, যেমন:

* জামদানি * খিরসাপাত আম (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) * রাজশাহীর সিল্ক * শিতলপাটি (সিলেট) * নকশিকাঁথা (রংপুর) * চুয়াডাঙ্গার মিষ্টি এসব GI পণ্যের মাধ্যমে স্থানীয় ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম হয়েছে। পাশাপাশি দেশীয় উদ্যোক্তারা যাতে আন্তর্জাতিক পেটেন্ট বা কপিরাইট নিতে পারেন, সেজন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সহায়তা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ মেধাসম্পদ ব্যবস্থায় এখনো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন—

সচেতনতার অভাব: সাধারণ জনগণ, উদ্যোক্তা, এমনকি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও মেধাসম্পদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই।

আইনি জটিলতা: মেধাসম্পদের সুরক্ষা ও মামলা পরিচালনায় সময় ও অর্থ ব্যয়বহুল।

প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) খাতে বিনিয়োগ কম হওয়ায় উদ্ভাবনের হার কম।

জাল পণ্য: বাজারে অবাধে নকল পণ্য ছড়িয়ে পড়ছে, যা আসল উদ্ভাবকদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

সম্ভাবনা ও করণীয়

বাংলাদেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বিপুল, যাদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন—

মেধাসম্পদ বিষয়ে শিক্ষা: স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাসম্পদ সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা।

সহজ পেটেন্ট আবেদন প্রক্রিয়া: অনলাইনভিত্তিক সহজ ও স্বল্পমূল্যের পেটেন্ট ও কপিরাইট নথিভুক্তির ব্যবস্থা।

স্টার্টআপ সহায়তা: তরুণ উদ্ভাবকদের জন্য ইনকিউবেটর, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও কর অবকাশ সুবিধা।

মেধা সম্পদ আদালত: দ্রুত বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য বিশেষায়িত আদালত প্রতিষ্ঠা।

নারী ও মেধা সম্পদ

২০২৩ সালের WIPO-এর থিম ছিল “Women and IP: Accelerating Innovation and Creativity”। নারীদের উদ্ভাবনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করাও এই দিবসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। নারীরা যেন পেটেন্ট, কপিরাইট ও ডিজাইন স্বত্বের মাধ্যমে তাদের সৃজনশীলতা সুরক্ষিত রাখতে পারেন, সেজন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়ছে, বিশেষত হস্তশিল্প, ফ্যাশন ডিজাইন ও ফুড প্রসেসিং সেক্টরে। এই নারীদের মেধাসম্পদ রক্ষা ও স্বীকৃতিতে প্রয়োজন বিশেষ সহায়তা ও প্রশিক্ষণ।

পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্ব মেধা সম্পদ দিবস উদ্ভাবন, সৃষ্টিশীলতা এবং জ্ঞানের মর্যাদা দেওয়ার একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য মেধা ও সৃজনশীলতার সুরক্ষা অপরিহার্য।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ—যেখানে দেশীয় জ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার মাধ্যমে অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করা সম্ভব। এজন্য মেধা সম্পদকে কেবল আইনি প্রক্রিয়া হিসেবে না দেখে, বরং জাতিগত সম্পদ হিসেবে দেখার মানসিকতা গড়ে তোলা জরুরি।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test