E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ফিরে দেখা: ১৯৯৬’র ১৩ মে

২০২৫ এপ্রিল ১৯ ১৭:২২:৩৫
ফিরে দেখা: ১৯৯৬’র ১৩ মে

রহিম আব্দুর রহিম


২ এপ্রিল বুধবার। জন্মস্থান জামালপুরের তারারভিটা থেকে সকাল ৯টায় রওনা হই টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি উপজেলার রামপুর গ্রামের উদ্দ্যেশে। এই গ্রামের আব্দুল মতিন ডালি, তিনি পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ। আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর বাড়িতে, সঙ্গে আমার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘ষড়ঋতু জগদল’ এর সদস্য রাশেদ রানা। এসএসসি পরীক্ষার্থী রাশেদ, আব্দুল মতিন ডালির সরাসরি শিক্ষার্থী। ছাতারকান্দি থেকে বাসে কালিহাতি, এখান থেকে সিএনজি করে বল্লাবাজার, এরপর ভ্যানে রামপুর।আঁকাবাঁকা পাঁকা রাস্তা, উঁচু-নিঁচু সবুজ ফসলের মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে ভ্যান। প্যাটলার একজন তাঁতি। তাঁত শিল্পের ভাটা পড়েছে। প্রতিমাসে প্রায় ৬০ হাজার টাকার কাম কাজ হলেও, এখন ৩০ হাজারও হয় না। তাই ভ্যানে পা রেখেছে তরুণ বয়সের এই তাঁতি। 

ভরদুপুরে পৌঁছে গেলাম রামপুরা বাজারে। অধ্যক্ষ আমাদের বাজার থেকে রিসিভ করলেন। নিয়ে গেলেন তাঁদের বাড়িতে। গ্রামবাসীর ভয়াবহ আতংক আর করুণ আর্তির কাহিনী শোনলাম অধ্যক্ষ আব্দুল মতিন ডালির মুখে। আমি তখন নৌবাহিনীর পতেঙ্গার ডকইর্য়াডে কর্মরত। ১৩ মে দিবাগত রাত দু'টোর দিকে খবর পেলাম টর্ণেডোর কবলে পড়ে আমার এক সহোদর বোনসহ ১২ জন নিকট আত্মীয় মারা গেছেন। ১৪ মে বিকালের দিকে পৌঁছালাম রামপুরা বাজারের প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে। চিকিৎসা ব্যস্ত সহোদর আর্মির তৎকালীন মেজর মোঃ আব্দুর রহিম এবং গ্রামের বেঁচে যাওয়া একদল তরুণ যুবকরা। মা’কে নেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ সিএমএইচ হাসপাতালে। জানতে পারি মায়ের দুই পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে, মাথার চামড়া উঠে গিয়ে খুলি বের হয়ে পড়েছে, বুকের সামনে প্রায় ছয় ইঞ্চি এবং পিঠে নয় ইঞ্চির মত কাটা পড়েছে।সে এক ভয়াবহ দৃশ্য! বাড়ির বাকী সবাই টাঙ্গাইল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঘটনার ১৫ দিন পর মাকে দেখার সুযোগ হয়।

সেদিন ছিল সোমবার, ১৩ মে ১৯৯৬ সালের পড়ন্ত বিকাল। ঘড়ির কাটায় ৪টা বেজে ১৭ মিনিট। গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের বেলুয়াগ্রাম পাশের যমুনা নদী থেকে শুরু হয় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় (টর্নেডো)। যেটি আলমনগর ইউনিয়ন হয়ে মির্জাপুর ইউনিয়নের পশ্চিম নুঠুরচর গ্রামে হানা দেয়। পুরো ঝড়ের সময়কাল ছিল মাত্র পাঁচ মিনিট। এরমধ্যে দুটো মিনিটের তান্ডবে গোপালপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ১৬টি গ্রাম নিশ্চিহৃ হয়ে যায়। নিহত হয় ১০৪ জন, আহত হয় প্রায় ৪ হাজার মানুষ। বিনষ্ট ২০০ একর জমির পাঁকা ধান। মারা যায় ১০ হাজার গৃহপালিত পশু পাখি। ওই দিনই কালিহাতী উপজেলার তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা রামপুর-কুকরাইল গ্রামে টর্নেডো আঘাত হানে। রামপুর ও কুকরাইল গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে একই পরিবারের ৭ জনসহ ১০৫ জন নিহত এবং চার শতাধিক মানুষ আহত হন। মৃত ৭৭ জনকে রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে গণকবরে একত্রে দাফন করা হয়। ধান কাটার মৌসুম, বাসাইলের মিরিকপুর গ্রামে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার ধান কাটা শ্রমিক সমবেত হয়েছিলেন। ঝড় থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা মিরিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেনডেমোক্রিটাসের, উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসা টর্নেডোর তান্ডবে ভবনটি দুমড়ে-মুষড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লে শ্রমিককরা সেখানেই চাপা পড়ে মারা যান।

ঘূর্ণিঝড়ে পুরো টাঙ্গাইলে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২৩ জন, আহত প্রায় ৩০ হাজার। ধ্বংস হয় ৮৫ হাজার ঘরবাড়ি, ৮৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১৭টি মসজিদ ও ১৪টি মন্দির। তবে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ২৩৭ জন। ওই দিনের স্বজন হারানো, তৎকালীন আর্মির মেজার বর্তমান অবসর প্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল (সার্জিক্যাল স্পেশালিষ্ট) ডাক্তার মোঃ আব্দুর রহিম এর সাথে কথা হয়েছে তাঁর গ্রামের বাড়িতে। তাঁর বর্ণনায় ওইসময় তিনি তখন ময়মনসিংহ ক্যান্টমেন্টের সিএমএইচ কর্মরত। প্রস্তুতি চলছিল টর্নেডোয় আহতদের চিকিৎসা দিতে গোপালপুর যেতে হবে। এরমধ্যে তাঁর খালাতো ভাই জোয়াহের ক্যান্টমেন্ট গেটে খবর পৌঁছায় টর্নেডোর ভয়াবহ তাণ্ডবে তাঁর এক বোনসহ মারা গেছেন অনেকেই, তাঁর মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর্মিদের আইন অনুযায়ী রিলেভার ছাড়া আর্মির কোন ডাক্তারের ছুটি হয় না। অথচ তাঁর কমান্ডিং অফিসার তাঁকে সরাসরি ছুটি দেওয়ায়, তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর কোন আত্মীয়ের মৃত্য ঘটেছে। তাই তিনি ময়মনসিংহ ক্যান্টমেন্ট থেকে বের হবার পথে জমি কেনার জন্য গচ্ছিত ৫০ হাজার টাকা পকেট উঠান। ময়মনসিংহ ক্যান্টমেন্ট থেকে আর্মির একটি গাড়িতে করে তাঁকে ঘাটাইল ক্যান্টমেন্টে নিয়ে আসে। এই ক্যান্টমেন্টের চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু মেডিক্যাল উপকরণ প্যাকেটজাত করে হাতে দেন। ঘাটাইল ক্যান্টমেন্টের একটি গাড়িতে করে তাঁকে পৌঁছে দেয় তাঁর এলাকায়।

সময় বাদ মাগরিব। নিশ্চিহ্ন এলাকা। অন্ধকার, সে তাঁর এক ক্লাসমেইড শুকুরুজ্জামানকে পেয়ে যান রামপুর বাজারে। সেখানেই দেখতে পান, প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন এক পল্লী চিকিৎসক। এই চিকিৎসক তাঁর পরিচয় জানতে পেরে, জানান, 'আপনার মাকে চিকিৎসার জন্য একটি ট্রাকে করে টাঙ্গাইলে পাঠিয়েছি। বেঁচে আছে কি না জানি না।' এরপর কি হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'মা বেঁচে থাকলে ফিরে পাবো, এমনটা মনে গেঁথে নিলাম, মনে জাগলো আমি সৈনিক, আমি যোদ্ধা, আবেগের এখানে স্থান নেই। আমি রাতে ঘুমালাম শুকুরুজ্জামানের বাড়িতে। সকালে বাড়ি আঙ্গিনায় গিয়ে দেখি নিশ্চিহ্ন মাতৃস্থানের ভয়াবহ দৃশ্য! প্রায় ২০০ গজ দূরে পড়ে আছে আমার বোনের মৃতদেহ, যা একটি গামছা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন গ্রামবাসী। আমি গ্রামে এসেছি, এ খবর পেয়ে শতশত আহত লোকজন বাড়িতে আসছেন, শুরু করলাম চিকিৎসা দেওয়া, চিকিৎসা উপকরণ শেষ হওয়ায় পরের দিন চলে গেলাম ঢাকায়। বাড়ি যাবার সময় পকেটে যে টাকা নিয়ে ছিলাম তা দিয়ে চিকিৎসা উপকরণ কিনে নিলাম, চলছে চিকিৎসা সেবা, এর মাঝেই এক ব্যক্তি গামছায় বেঁধে অনেকগুলো টাকা আমার কাছে পৌঁছে দেন। লোকটার নামধাম জানার প্রয়োজন আছে বলে তখন মনে করি নি। টানা ১৫ দিন চিকিৎসা সেবা দেবার পর কিছু টাকা গচ্ছিত ছিল, যা যৌথ একাউন্টে এখনও জমা আছে। তবে টাকার পরিমান মনে নেই। মনে আছে, ১৫ দিন পর যখন কর্মস্থলে ফিরছিলাম, তখন এলাকার শত মানুষের অশ্রুসজল বিদায় আমাকে আমার সকল স্বজন হারানোর ব্যথা ভুলিয়ে দিয়েছিল। আমি ভূষিত হয়েছি মহাসম্মানে। যে সম্মান আমাকে শিক্ষা দেয়, মানুষের নিস্বার্থ সেবাদানকারীর কোন মৃত্যু নেই, দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, সৈনিকরা কখন মরে না। মরে তখন, যখন এরা দল মতের তোষামোদি করে, মানুষ, প্রাণ এবং প্রাণির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।'

লেখক : কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সাহিত্যিক।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test