E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ফিরে দেখা: শৈশবের বৈশাখ           

২০২৫ এপ্রিল ১৩ ১৭:৩৩:২৯
ফিরে দেখা: শৈশবের বৈশাখ           

রহিম আব্দুর রহিম


আমরা তখন খুবই ছোট। গাঁও গেরামের শিশু-কিশোররা দল বেঁধে চলাফেরা করতাম। ফাঁকা জায়গা, নদীর পাড়, গাছের নিচে ছিলো আড্ডাস্থল। ঋতু চক্রের কিছুই বুঝতাম না। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে স্কুল ফেরা, নদীতে লাফ-ঝাঁপ সাঁতার কাটা, সেকি মজা! এই বৃষ্টিভেজা দিন শেষ হতে না হতেই বিলে ঝিলে শাপলার সমাহার। তাল গাছে পাঁকা তাল, শূভ্র সকালে হিন্দুদের দুর্গোৎসবের কাশর ঘন্টায় আমাদের শৈশব কাটতো। ঠোঁট ফাটা রোদে বসে পিঠা-পুলির আসরের কাহিনী কে না জানে? 

ঘরে ঘরে ভাঁপা, চিঁতই, পাঁটিসাপটা, পুলি-পিঠাসহ নানা রকমের পিঠা। মিলতো খেজুরের রস। ক্ষেত খামারে কপি, বেগুন, পালং, মটরশুঁটি। বিল হাওরে কৈ মাগুর, সিং মাছের মাতামাতিতে কে না মেতেছি। রাতের পল্লীতে যাত্রাপালার বৈরাগী রাগের বাদ্যযন্ত্রের সুর শোনেছি, দেখেছি যাত্রাপালা, গ্রামের নেটোরদলের আলোমতি, রূপবান, সাগরভাসার মত পালার অভিনয়, নাচগানের আসর জমজমাট ছিলো। নদীর ধারে কাশফুলের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! আহ্, আস্তে আস্তে গাছের পাতা ঝরার পালা, নতুন পাতায় পল্লবীর সবুজরূপে কোকিলের কুহুতান ভেসে আসতো কানে। প্রচন্ড রোদ, ভেপসা গরম চৈত্রের আগমন।

চলছে চৈত্র, ফসলের ফাঁকা মাঠে আমার ঘুড়ি উড়াতাম, রাখালরা মাঠে গরু চড়ানো শেষে যখন ঘরে ফিরতো, তখন আমরা তাদের সাথে মিশে যেতাম, পিছু নিতাম গরুর পালের, এক হাতে ঘুড়ি, অন্য হাতে রাখালের কাছ থেকে ধার করা পাজুন (গরু তাড়ানোর লাঠি) নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। ধুলোমাখা সারা শরীর, এই অবস্থায় মায়েরা বাড়িতে ঢুকতে দিতো না, আর এই ঢুকতে না দেওয়াকে ইস্যু করে নদীর অল্প পানিতে সন্ধায় নামতাম গোসল করতে। রাতের বেলায় গোসল! এই নিয়ে মায়ের পিটুনি, এখন গা শিউরে ওঠে! হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে হৈ-হল্লোর, ঘরের কেউ মশাল, কেউ পাট খড়িতে কেউ আবার খড়ের ভুতিতে আগুন দিয়ে ধোঁয়া জ্বালিয়ে বাইরে আসছে, সারা গ্রাম ঘুরে বিশাল কৃষি মাঠের ফাঁকায় অসংখ মশালের সমারোহ, কারণ আজই নাকি সারাবছরের দুঃখ, কষ্ট, রোগ-ব্যাধি, আপদ বিপদ তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ, সকাল হলেই বছরের প্রথমদিন বৈশাখ মাস। এই দিন কারো সাথে ঝগড়া-ঝাটি করা যাবে না, কারো কাছ থেকে কোন কিছু বাকী-বকরাও নেওয়া যাবে না। এই দিন যা করবো, তা সারা বছরই আমাদের পিছু নেবে। তাই মায়েরা আমাদের ভালো কিছু করতে বলতেন।

অপরদিকে বাড়ি বাড়ি ঘরদুয়ার মোছামুছির কাজ, ব্যবসায়ীদের হালখাতা, সবচেয়ে বেশি মজা হতো প্রতিবেশী হিন্দু বাড়ির মাসি, পিসিদের হাতের চিড়া, মুড়ির নাড়ু, সুস্বাদু পায়েস খাবারে। এতো গেলো পাড়া প্রতিবেশির প্রতিদিনে সম্প্রীতির কাজ। নববর্ষের সবচেয়ে ঐতিহাসিক বিষয়টি হচ্ছে, ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্ষেত্র বৈশাখ জুড়ে বসা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাজারো মেলা।আজ এখানে তো, কাল ওখানে। মেলায় ঘোড়ার দৌঁড়, ষাড়ের লড়াই, মইদৌঁড় হতো। চলতো লাঠি খেলা। রাতের মেলায় যাত্রাপালা, কবি, জারি, গম্ভীরা, গাজীর গান হতো। চলতো পুতল নাচ, নাগরদোলা, প্রদর্শিত হতো সার্কাস। ওই সময়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিলো বায়স্কোপ। কোন কোন মেলায় আয়োজন হতো ১৬শ মিটার দৌঁড়। যে সময় সারা বাংলাদেশে ১৬টি ডিস্ট্রিক্ট, ঠিক সময় আমরা তিনজন আমি, বন্ধু আন্টু (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক) ছাতারকান্দি-ধনবাড়ি, তোলা (বর্তমান ব্যাংকার) পোড়াবাড়ি মধুপুর। আমরা তিনজন এই প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করার জন্য চষে বেড়াতাম জামালপুর, মধুপুর, ধনবাড়ি, সরিষাবাড়ি, মুক্তাগাছা, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত মেলাগুলোতে।

এই প্রতিযোগিতা অংশ গ্রহণ করে আমি প্রথম হতাম, তোলা দ্বিতীয় এবং আন্টু তৃতীয় হতো। কখনও এই রেজাল্ট পরিবর্তন হলে, তাতে আন্টু দ্বিতীয় এবং তোলা তৃতীয় হতো, আমার রেজাল্ট প্রথমই থাকতো। উল্লেখ্য, ওই সময় (৮০ দশকে)র জাতীয় মাধ্যমিক স্কুল অ্যাথলেট্রিক্স প্রতিযোগিতায় আমি দু-দুবারের ময়মনসিংহ জেলায় চ্যাম্পিয়ন রানার ছিলাম। ছিল সার্টিফিকেট, ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় যা নষ্ট হয়েছে। যা বলছিলাম, আমাদের শৈশবকালের প্রকৃতির পরিবর্তনই বলে দিতো ঋতুর আসা যাওয়া। তবে বৈশাখ যে আমাদের চিরচেনা অসাম্প্রদায়িক মহোৎসব এটা বুঝতে পেরেছি শৈশবকালেই।

এই উৎসব জাত-পাত, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিস্টার্ন কারো একার নয়, এই উৎসব দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রাণ, মন, অন্তর এবং জীবন সম্পৃক্ত মহোৎসব। যা কোনকালেই ক্ষয়ে যাবার নয়, ধ্বংস হবার নয়। তবে এর আচার-আচরণ, গতি প্রকৃতি অত্যাধুনিক জগতের সাথে তাল মিলিয়ে পরিমার্জন হতেই পারে, তবে তা পরিবর্তন হতে পারে না। নববর্ষের বৈশাখে প্রত্যাশা এবং কামনা, সবার জীবনে ফিরে আসুক প্রাণান্ত শৈশব, মানবতার বারতা, সম্প্রীতির হারানো উপাখ্যান এবং মাটি মানুষের পবিত্র সানিধ্য।

কলামিস্ট: নাট্যকার ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

১৫ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test