E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

স্বাধীনতার ৫৪ বছরে দেশের স্বাস্থ্য সেবার সফলতা ও ব্যর্থতা

২০২৫ এপ্রিল ০৬ ১৭:২২:৫৮
স্বাধীনতার ৫৪ বছরে দেশের স্বাস্থ্য সেবার সফলতা ও ব্যর্থতা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৪৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এই দিনটি স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উদযাপিত হয়ে আসছে। ২০২৫ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে দেশের স্বাস্থ্যখাত অনেক অগ্রগতি অর্জন করলেও কিছু ব্যর্থতা এখনো দৃশ্যমান। এই প্রবন্ধে আমরা স্বাধীনতার পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, সাফল্য, চ্যালেঞ্জ এবং ব্যর্থতাগুলোর বিশ্লেষণ করব।

স্বাস্থ্যখাতের শুরু: একটি ইতিহাস

স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত এক দেশ। সেই সময় দেশের স্বাস্থ্যখাত ছিল প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায়। মাত্র ৬০০০-এর মতো ডাক্তার, অপ্রতুল হাসপাতাল, ঔষধ ও জনবল সংকটে ছিল গোটা দেশ। সরকার তখনই একটি পরিকল্পিত স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্যসেবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

স্বাস্থ্যখাতের সাফল্য

১. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা: স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ সরকার ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নীতির আলোকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন শুরু করে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকার প্রায় ১৮,০০০ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করে, যা প্রান্তিক জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করে তোলে। বর্তমানে প্রায় ১৪,০০০ ক্লিনিক সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

২. শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস: বাংলাদেশ শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। ১৯৯০ সালে প্রতি হাজারে নবজাতকের মৃত্যুহার ছিল ৯৭, যা ২০২৩ সালে কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫-এ। মাতৃমৃত্যু হারও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এসব অর্জনের পেছনে টিকাদান কর্মসূচি, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ও সচেতনতামূলক প্রচার ভূমিকা রেখেছে।

৩. টিকাদান কর্মসূচি: ১৯৭৯ সালে বিসিজি ও ডিপিটি টিকার মাধ্যমে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে একে বিস্তৃত করে "Expanded Program on Immunization (EPI)" চালু করা হয়। বর্তমানে প্রায় ৯০%-এর বেশি শিশু জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আসছে।

৪. এনজিও ও বেসরকারি খাতের অবদান: ব্র্যাক, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ অনেক বেসরকারি সংস্থা দেশের স্বাস্থ্যখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ব্র্যাক-এর স্বাস্থ্যসেবার মডেল উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনুসরণীয় হিসেবে বিবেচিত হয়।

৫. পরিবার পরিকল্পনা: বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সফল দেশ। জন্মহার হ্রাস, সচেতনতা বৃদ্ধি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কারণে এই খাতে অগ্রগতি লক্ষণীয়।

৬. ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা: বর্তমানে সরকার স্বাস্থ্যখাতে ডিজিটালাইজেশনের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ই-হেলথ, টেলিমেডিসিন, হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম চালুর ফলে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজতর হয়েছে।

৭. কোভিড-১৯ মহামারিতে দ্রুত প্রতিক্রিয়া: ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত সীমিত সম্পদের মধ্যে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়। ভ্যাকসিন সংগ্রহ, টিকাদান কার্যক্রম, আইসোলেশন ও কন্টাক্ট ট্রেসিং ব্যবস্থার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।

স্বাস্থ্যখাতের চ্যালেঞ্জ ও ব্যর্থতা

১. স্বাস্থ্য বাজেটের ঘাটতি: জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ এখনো জিডিপির মাত্র ১%-এরও নিচে, যেখানে WHO-এর সুপারিশ হলো কমপক্ষে ৫%। ফলে পরিকাঠামো, জনবল ও ওষুধের ঘাটতি একটি বড় সমস্যা।

২. চিকিৎসা সেবার বৈষম্য: শহর ও গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার মান ও প্রাপ্যতায় ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। শহরের বড় হাসপাতালে আধুনিক সেবা থাকলেও, গ্রামে এখনো ডাক্তার সংকট এবং অবকাঠামো দুর্বলতা বিদ্যমান।

৩. মানসম্মত চিকিৎসা অভাব: দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের মান প্রশ্নবিদ্ধ। পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও কমিশন ভিত্তিক ওষুধ বিক্রিও স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মানে প্রভাব ফেলে।

৪. মানসিক স্বাস্থ্য উপেক্ষিত: স্বাধীনতার ৫৪ বছরের বেশি সময় পরেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ শুরু হয়নি পর্যাপ্ত হারে। মানসিক রোগ চিকিৎসার পরিকাঠামো ও জনবল অত্যন্ত সীমিত।

৫. বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার বেহাল অবস্থা: অনেক বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল রোগীর সঙ্গে প্রতারণা, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা, ব্যয়বহুল সেবা প্রদান করে থাকে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কার্যকারিতা দুর্বল হওয়ায় এই খাত প্রায় অনিয়ন্ত্রিত।

৬. চিকিৎসক ও নার্স সংকট: WHO অনুযায়ী প্রতি ১০,০০০ জনে ২৩ জন স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজন, কিন্তু বাংলাদেশে রয়েছে মাত্র ৯-১১ জন। বিশেষ করে দক্ষ নার্স ও প্যারামেডিকের সংখ্যা অত্যন্ত কম।

৭. রেফারেল ব্যবস্থার দুর্বলতা: বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় রেফারেল ব্যবস্থা দুর্বল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সেবা কেন্দ্রগুলো রোগীকে সঠিক সময়ে তৃতীয় পর্যায়ের হাসপাতালে পাঠাতে ব্যর্থ হয়, ফলে রোগীর জীবনহানির ঝুঁকি বাড়ে।

ভবিষ্যৎ করণীয়

১. স্বাস্থ্য বাজেট বাড়ানো: স্বাস্থ্যখাতে জাতীয় বাজেটের বরাদ্দ ধীরে ধীরে ৫%-এ উন্নীত করা দরকার।

২. গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ: কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা হাসপাতালের পরিকাঠামো ও জনবল বৃদ্ধি করতে হবে।

৩. জনস্বাস্থ্য শিক্ষার প্রসার: স্বাস্থ্য বিষয়ে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রম চালু করা প্রয়োজন।

৪. মানসিক স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্তি: মানসিক স্বাস্থ্যকে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে প্রাধান্য দিতে হবে এবং উপযুক্ত জনবল গড়ে তুলতে হবে।

৫. স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি দমন: ওষুধ শিল্প, চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক ও স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ক্রয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

আজীবন সুস্থ থাকতে ঘরোয়া পরামর্শ

মানুষকে কিছু নিয়মের মধ্যেই চলতে হবে। কিছু অভ্যাস রপ্ত করতে হবে আর কিছু অভ্যাস করতে হবে পরিত্যাগ।

* সকালে ঘুম থেকে উঠে ৪ গ্লাস পানি পান করুন। এরপর বাথরুমে যান এবং এসে আবারও এক গ্লাস পানি পান করুন। সারাদিনে ৮ থেকে ১০ গ্লাস বাড়তি পানি পান করুন। এটি হাইড্রোথেরাপি বা পানি চিকিৎসা । এই চিকিৎসা প্রায় ৩৬ ধরণের রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। শরীর সুস্থ থাকবে।

* সকালে ঘুম থেকে উঠে দুধ ছাড়া খুব হালকা এক কাপ চা পান করুন। চা কখনোই অতিরিক্ত গরম খাবেন না। আপনার ওজন বেশি হলে চিনি খাবেন না। এটি আড়াই হাজার বছর আগের একটি চাইনিজ হারবাল মেডিসিন। চায়ে রয়েছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, যা ক্যান্সার রোধে কাজ করে। তবে এক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাত হয়নি এমন চা খাওয়া অপেক্ষাকৃত ভালো।

* ভিটামিন সি হচ্ছে খাবারের বৈপ্লবিক প্রাণ। এর গুণাগুণ অনেক। দৈনিক এক হাজার মিলিগ্রাম ভিটামিন খেলে মানুষ চির তরুণ থাকে। ভিটামিন সি যুক্ত তাজা ফলমূল প্রতিদিন খেতে হবে। এটি ক্যান্সারও রোধ করে। আমলকি, লেবু, টমেটো, কমলা, পেয়ারা এবং যেকোনো ধরণের টক ফলে ভিটামিন সি থাকে।

* ধূমপানসহ সব ধরণের নেশাজাতীয় অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।

* রেডমিট খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। গরু, মহিষ, খাসি, ভেড়ার মাংস যতটা সম্ভব কম খেতে হবে। প্রয়োজনে একদমই না খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

* ফার্মের মুরগির মাংস না খাওয়াই ভালো। চর্বিহীন বাচ্চা মুরগির মাংস খেতে হবে।

* আধা- সেদ্ধ শাক সবজি ও তরকারি প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে। ভাত বা রুটি খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে।

* ভাজা খাবার একদমই খাবেন না। অতিরিক্ত তেল, চর্বি, ঘি, মাখনযুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না।

* রান্নায় বেশি মসলা ব্যবহার করবেন না। মসলার ভেষজ গুণ পেতে পানিতে ফুটিয়ে সেই পানি পান করতে পারেন।

* লেটুস পাতা, পুদিনা পাতা, টমেটোর সালাদ বানিয়ে খাবেন প্রতিদিন।

* সকালে খালি পেটে এক চামচ মধু খেতে পারেন।

* সামুদ্রিক মাছ মহাঔষধ। খাবারের তালিকায় বেশি করে সামুদ্রিক মাছ রাখুন।

* মাছের কাটা বা মাংসের হাড় চিবিয়ে খাবেন না। এতে পাকস্থলিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

* সূর্যমুখী ফুলের বীজ হচ্ছে হার্টের ভেষজ ওষুধ। রান্নায় সূর্যমূখী তেল ব্যবহার করুন। এটি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

* প্রতিদিন অল্প পরিমাণে হলেও টকদই খাওয়ার অভ্যাস করুন।

পরিশেষে বলতে চাই, স্বাধীনতার ৫৪ বছরে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাতে অনেক দূর এগিয়েছে, বিশেষ করে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যে। তবে এখনো চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—যেমন জনবল সংকট, বাজেট ঘাটতি ও বৈষম্যপূর্ণ সেবা। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রেক্ষাপটে এই চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণের এখনই সময়। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা’ এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজ, বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদেরও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

লেখক : সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

১৩ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

Website Security Test