E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

মহাকুম্ভ 

২০২৫ মার্চ ০৩ ১৭:২৯:০৭
মহাকুম্ভ 

শিতাংশু গুহ


১৯৭১ সালে বাংলাদেশে (সাবেক পূর্ব-পাকিস্তান) লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণভয়ে পায়ে হেটে দূর-দূরান্তে পালাতে দেখেছি। অর্ধ-শতাব্দি পর ২০২৫-এ প্রয়াগরাজে কোটি কোটি মানুষকে উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পদযাত্রায় ‘মহাকুম্ভ’ স্নানে যেতে দেখলাম। ১৯৭১ ও ২০২৫ দু’টো-র আমি অংশীদার, সাক্ষী। পার্থক্য হচ্ছে, ১৯৭১ ছিলো অনিচ্ছায়, জীবন বাঁচাতে। আর ২০২৫ স্বেচ্ছায়, জীবন উপভোগ করতে, অথবা জীবনের পরমার্থ খুঁজতে। একাত্তর আমার জীবনের ঊষায়, মহাকুম্ভ সন্ধ্যালগ্নে।

১৫ই ফেব্রুয়ারি শনিবার প্রয়োগরাজে পৌঁছি দুপুরের শুরুতে। হোটেল সিভিল লাইনে, অর্থাৎ শহরের প্রাণকেন্দ্রে। অন্য সময়ে হয়তো এসব হোটেলের ভাড়া ৩/৪ হাজার রুপি, মহাকুম্ভের মহাসমারোহে তা আট/দশগুন বেশি, প্রথম দিকে এতটা ছিলোনা, সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে দাম বেড়েছে, কারণ ‘নো-হোটেল’। হোটেল পাওয়াটাই ভাগ্যের বিষয় ছিলো, আমরা দু’রাত ছিলাম। অমৃত স্নান বা পুন্য স্নান, যাই হোক, করেছি। এসব আমার আলোচ্য নয়, ওয়েবে এর ছড়াছড়ি।

আমাদের হোটেল ছিলো রাস্তার ওপর, সারারাত মানুষের চলাচল, যানবাহনের ‘ভ্যা-ভু’, সরব কথাবার্তায় ঘুমানো দায় ছিলো। দেখেছি, লক্ষ লক্ষ মানুষ হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে কুম্ভের দিকে, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মহোৎসবে ধাবমান। দিনরাত-সকালসন্ধ্যা পূর্ণার্থীদের এ-কাফেলা ছিলো অবিরত, বিরামহীন, রাত ২টায় যা, ভোর বা সন্ধ্যায়ও তা-ই। এ এক অপূর্ব-দৃশ্য, কারো অভিযোগ নেই, কেউ খালি পায়, কেউ স্যান্ডেল বা কেট্স। কারো কারো মাথায় ছোট্ট পুটলি, কারো ব্যাকপ্যাক, বা স্যুটকেস।

গুগুল বলছে, প্রয়াগরাজের আয়তন ৫৪৮২ বর্গ-কিলোমিটার। জনসংখ্যা (২০১১ গণনা অনুযায়ী) প্রায় ৬০লক্ষ। বলা হচ্ছে, ৬৬৫ মিলিয়ন বা ৬৬কোটি ৫০লক্ষ পূর্ণার্থী মহাকুম্ভে গেছে। ভাবুন, ৬০ লক্ষ মানুষের একটি শহরে ৪৫দিনে ৬৬কোটি পুণ্যার্থীর পদচারণা হলে কি হতে পারে? ১৭কোটির বাংলাদেশে ৬৭কোটি মানুষ গেলে কি হতো? প্রয়াগরাজে কিন্তু কোন ছিনতাই হয়নি, ধর্ষণের কথা শোনা যায়নি, লুটপাট-রাহাজানি হয়নি। মানুষ রাস্তা-ঘাট-পার্কে ঘুমিয়েছে, কেউ ক্ষুধার্ত ছিলোনা, কেউ ঢিল মারেনি, সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

কবি বলেছেন, ‘কিসের নেশায়, কিসের আশায় ঘুরছে ওরা দিগন্তরে—’? ‘১৪৪ বছরের মহাকুম্ভ-ওয়ানসে এ লাইফ টাইম এচিভমেন্ট’। ‘পুন্য কামাই’ সাইড লাইনে রাখলেও এমন দৃশ্য সামনে থেকে দেখা বা এর অংশীদার হওয়া সবার ভাগ্যে জোটে না-সেই অর্থে যাঁরা কুম্ভে গেছেন তাঁরা ভাগ্যবান। স্ত্রী আলপনা’র ইচ্ছাপূরণে আমার কুম্ভে যাওয়া, রবি ঠাকুরের কবিতা একটু পাল্টে দিয়ে বলা যায়, ‘সতীর পুণ্যে পতির পুন্য–’! পাপ-পুণ্যের হিসাব নয়, মূলত: এ বিস্ময়কর ঘটনার অংশীদারিত্বই মুখ্য। মহাকুম্ভ ২০২৫ ইতিহাসের সর্ববৃহৎ জনসমাবেশের সাক্ষী হলো গোটা বিশ্ব। ৪হাজার হেক্টর জুড়ে কুম্ভনগরী, ১২কিলোমিটার স্নানঘাট, ৬৭ হাজার ষ্ট্রীট লাইটে আলোকিত হয়ে ওঠে কুম্ভনগরী।

আলাপচারিতায় জানা যায়, উত্তর-দক্ষিণ ভারতের মানুষ বেশি কুম্ভে গেছেন, গ্রামের পর গ্রাম সবাই মিলে সপরিবারে পুণ্যস্নানে গেছেন। ভাবা যায়, ভারতের অর্ধেক মানুষ বা আমেরিকার জনসংখ্যার দ্বিগুন এতে অংশ নিয়েছেন। এ মহামিলন যজ্ঞ সার্থক। বাংলাদেশের মানুষ ইচ্ছে থাকলেও ভিসা সমস্যার কারণে আসতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আমার চোখে পড়েনি। দিল্লিতে এক দাদাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ‘বাঙ্গালী বাবুদের এসবে তেমন আস্থা নেই’? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বা এবিপি আনন্দের ‘বিরূপ’ মন্তব্যে সেটি অবশ্য বোঝা যায়?

সঙ্গমে নেমে আমি অবাক হই, জল এত স্বচ্ছ কেন? কোটি কোটি মানুষ যেখানে স্নান করছে সেখানে ঘোলা জল থাকার কথা, কিন্তু না, জল স্বচ্ছ ছিলো, অন্তত: ঘোলা ছিলোনা। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে বুঝেছি, স্বচ্ছ জলরাশির কারণ হচ্ছে, ‘স্রোতধারা’। গঙ্গায় স্রোত বহমান ছিলো, যা সকল ময়লা বয়ে নিয়ে যায়। যাঁরা বলেছেন, ব্যাকটেরিয়া কিলবিল করেছে, তাঁদের বলা যায় কিছু ব্যাকটেরিয়া থাকা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু অতটা নেতিবাচক ভাবাটা ঠিক নয়? যাঁরা সুইমিং পুলে সাঁতার কাটেন, তাঁরা সাঁতার শেষে উঠে পুনরায় বিশুদ্ধ জলে স্নান করেন, মানুষ কিন্তু কুম্ভে স্নান করে উঠে আবার বিশুদ্ধ জলে স্নান করেনি, আমরাও করিনি।

কুম্ভমেলার মহাত্মা বর্ণনা আমার লক্ষ্য নয়, ওটি ইন্টারনেটে আছে, আমি শুধু যা দেখেছি, তা বলছি। মহাকুম্ভে আমি বড়লোকের জন্যে কোন পৃথক ঘাট দেখিনি, ব্রাহ্মণের জন্যেও নয়, নারী-পুরুষের জন্যেও ভিন্ন ভিন্ন ঘাট দেখিনি। আমি দেখেছি ধনী-দরিদ্র-জাতপাত-নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবাই একসাথে স্নান করছে। উচ্চ-নিন্ম দেখিনি। ভেজাকাপড়ে নারীর শরীর দেখার নিমিত্ত কারো ‘অসুন্দর’ দৃষ্টি আমার চোখে পড়েনি। কেউ মারামারি করেনি, বোমা মারেনি, বা কেউ না-খেয়ে ছিলো তা শুনিনি, কারো স্যান্ডেল চুরি যায়নি। দেখেছি এক মহাযজ্ঞ, হিন্দুদের এক মহা-মিলনমেলা।

মহাকুম্ভে ৫০জন পুণ্যার্থী মারা গেছেন, খুবই দু:খজনক, ১ জনও মারা যাওয়া উচিত ছিলোনা। ৬৬কোটি মানুষের মধ্যে পঞ্চাশ জনের স্বর্গপ্রাপ্তি দু:খজনক হলেও কুম্ভমেলার সার্বিক ব্যবস্থাপনার চমৎকারিত্ব নষ্ট হয়ে যায়না। এ সময়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এতবড় সমাবেশে এতটা সুশৃঙ্খলতার কৃতিত্ব রাজ্য সরকারের সাথে সাথে কোটি কোটি পুণ্যার্থীর। এমন শান্তিপূর্ণ, বিশাল জনসমাবেশ পৃথিবীর অন্য কোন দেশ এতটা দক্ষতার সাথে এমনটা করতে পারতো কিনা আমি সন্দিহান। আসলে বিশ্বে এতবড় সমাবেশের কোন নজির নেই?

মেলায় পূজারী বা পান্ডাদের উৎপাত ছিলোনা। কেউ কেউ যে ফুল-বেলপাতা বা নারকেল দিয়ে পূজা দেননি তা নয়, দিয়েছেন, ‘গঙ্গা মাইয়া’র’ পূজা অনেকেই দিয়েছেন, তবে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে এপূজার দৃশ্যপট ভিন্ন। ছোট ছোট সাঁঝিতে ফুল অনেকেই ভাসিয়েছেন গঙ্গায়, যা ভেসে ভেসে যমুনায় এসে অপূর্ব রঙ্গীন দৃশ্যের সৃষ্টি করে। অর্ধ-ছোলা নারকেল ভেসে যাওয়া সবাই দেখেছে, আমি দেখেছি মাঝিরা সেই নারকেল তুলে পরিষ্কার করে নৌকায় রেখে দিতে, হয়তো বাড়ী নিয়ে যাবে অথবা বিক্রি করে দু’টি পয়সা রোজগার করবে। আমার তখন নারকেল খেতে ইচ্ছে করেছিলো, কিন্ত সংকোচে তা বলা হয়নি।

আমরা দশ কিলোমিটার হাঁটিনি, অনেকেই হেঁটেছেন, অনেকে আরো বেশি হেঁটেছেন। মেলায় যেতে আসতে আমরা সাকুল্যে ৪/৫ কিলোমিটার হেঁটেছি, অনেকটা সন্ধ্যা-ভ্রমণের মত। মেলার সান্ধ্যকালীন সৌন্দর্য্য অপূর্ব। মেলায় বহুরকমের যানবাহনের মধ্যে একটি হচ্ছে মোটর সাইকেল, এটি বেশ জনপ্রিয় ছিলো, কারণ এটি ভীড়ের ফাঁকেফুঁকে দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। কুম্ভে এদের রোজগার বেশ ভাল ছিলো বলেই মনে হয়। আমরা ৬/৭ কিলোমিটার মোটর সাইকেলে পাড়ি দেই; চালক/আমি, পেছনে আমায় জাপ্টে ধরে আমার পত্নী। সে এক নুতন অভিজ্ঞতা, অবশ্য কিছুটা বিপজ্জ্বনক।

এত লোকের মাঝে মহাকুম্ভে আমাদের কি কষ্ট হয়েছিলো? মোটেও না। একজন বললেন, ‘ভক্তের বোঝা ভগবান বয়’। বললাম, তা হয়তো, তবে ‘ডলার’ কিছুটা বয়েছে তা বলা যায়। ডলার-টা ভগবানের দেয়া ধরলে, বোঝাটা পরোক্ষভাবে তিনিই বয়েছেন তা বলা বাহুল্য। কথা হচ্ছে, মহাকুম্ভ মেলার তেমন সমালোচনার সুযোগ নেই। যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। এটি গৌরবের ইতিহাস। অর্থনৈতিকভাবে এ মেলায় সরকার, স্থানীয় জনগণ, ব্যবসা-বাণিজ্য ভালোই হয়েছে, সবাই লাভবান। পুণ্যার্থীরা পুন্য কামাই করেছেন, অনেকে জীবনে এক নুতন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ভাগ্যবান। সবাই যখন খুশি, তখন অযথা সমালোচনা বাদ দিয়ে আপনিও খুশি হন’না কেন?

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

৩১ মার্চ ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test