E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

রমজানের আগে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

২০২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯ ১৬:৪৬:০০
রমজানের আগে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


রমজান মাস মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি পবিত্র মাস। এ মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা সিয়াম সাধনা করেন এবং সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেন। এই সময়ে ইবাদত-বন্দেগি ও আত্মসংযমের পাশাপাশি মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ ও ব্যবহার করে। তবে রমজান মাস আসলেই বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি পরিচিত ও দীর্ঘদিনের সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান এবং বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি শুধু ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করে না, বরং সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।

রমজানের গুরুত্ব এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি

রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে চিনি, আটা, চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, ছোলা, খেজুর, মাংস, দুধ, ও ডিমের মতো পণ্যের চাহিদা রমজান মাসে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। ইফতার ও সেহরির জন্য বিশেষ খাদ্যতালিকা তৈরি হয়, যা এই চাহিদা বাড়ার অন্যতম কারণ।

তবে এই বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন। এর ফলে পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত জরুরি হয়ে ওঠে।

বাজার নিয়ন্ত্রণে সমস্যার কারণ

রমজান মাসে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রধান কারণ হলো:

১. অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি: অনেক ব্যবসায়ী রমজানের আগে পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। এর ফলে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কমে যায় এবং মূল্য বেড়ে যায়।

২. দুর্বল বাজার নজরদারি: বাজার তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর অনেক সময় সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়। এ কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে।

৩. সরবরাহ চেইনের দুর্বলতা: নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা কার্যকর না হলে বাজারে পণ্য পৌঁছাতে বিলম্ব হয়। ফলে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।

৪. সচেতনতার অভাব: ক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতার অভাবও মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অনেক সময় ভোক্তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কিনে মজুত করেন, যা চাহিদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।

বাজার নিয়ন্ত্রণে করণীয়

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একাধিক পদক্ষেপ নিতে হবে। নিচে এর কিছু কার্যকর সমাধান আলোচনা করা হলো:

১. বাজার তদারকি জোরদার করা: বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মনিটরিং একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এর মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি চিহ্নিত করা সম্ভব। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়মিত বাজার পরিদর্শন এবং অবৈধ মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

২. পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা: সরবরাহ চেইন শক্তিশালী করতে হবে। উৎপাদক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও কার্যকর হওয়া উচিত। প্রয়োজনে সরকার সরাসরি আমদানি করে বাজারে পণ্য সরবরাহ করতে পারে।

৩. মূল্য নির্ধারণ ও প্রচারণা: সরকারি সংস্থা থেকে প্রতিটি পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে তা প্রচার করতে হবে। দোকানদারদের এই মূল্য মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে।

৪. মজুতদারির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা: অসাধু ব্যবসায়ীরা রমজানকে ঘিরে পণ্য মজুত করে সংকট সৃষ্টি করেন। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান কার্যকর করা প্রয়োজন।

৫. ক্রেতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি: ভোক্তাদের মিতব্যয়ী হতে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্য কিনতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং স্থানীয় কমিউনিটির মাধ্যমে এই বার্তা প্রচার করা যেতে পারে।

৬. টিসিবির কার্যক্রম বৃদ্ধি: ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর মাধ্যমে সুলভ মূল্যে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করতে হবে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এই কার্যক্রম অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে।

৭. স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা: স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং সমস্যার সমাধান করতে এগিয়ে আসতে হবে।

রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণের ইতিবাচক প্রভাব

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করা যায়। এটি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। বাজার নিয়ন্ত্রিত থাকলে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অটুট থাকে এবং তারা সুষ্ঠুভাবে রমজানের ইবাদত করতে পারে।

বাজারে স্থিতিশীলতা থাকলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য বজায় থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে নিশ্চিত করে।

পরিশেষে বলতে চাই, রমজান মাসে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ কেবল একটি অর্থনৈতিক প্রয়োজন নয়, এটি একটি নৈতিক দায়িত্বও। অসাধু ব্যবসায়ীদের হাত থেকে সাধারণ জনগণকে সুরক্ষা দিতে সরকার, প্রশাসন এবং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পাশাপাশি ভোক্তাদের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল ব্যবহারের মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব। রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করতে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এই উদ্যোগই কেবল ন্যায্য বাজার নিশ্চিত করতে পারে এবং সকলের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল রমজান নিশ্চিত করবে।

লেখক : সংগঠক,কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test