E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

ভারতের কাছে বাংলাদেশ পানির অধিকার চায়, দয়া নয়

২০২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮ ১৭:৩৪:০৬
ভারতের কাছে বাংলাদেশ পানির অধিকার চায়, দয়া নয়

মীর আব্দুল আলীম


বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এর ভূপ্রকৃতি, কৃষি, পরিবেশ এবং জনজীবন বহুলাংশে নির্ভর করে নদীগুলোর উপর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশের পানি আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, অভিন্ন নদীগুলোর পানি যৌক্তিক ও ন্যায্য ভিত্তিতে বণ্টনের কথা থাকলেও বাস্তবে তা ঘটছে না। ভারত তার কূটনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটে ঠেলে দিচ্ছে।

পানির জন্য লড়াই: বাংলাদেশের বাস্তবতা

বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত। কিন্তু এসব নদীর পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ভারত তার প্রভাব খাটিয়ে অধিকাংশ সময় একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে। ফলে বর্ষাকালে যখন অতিরিক্ত পানি আসে, তখন বাংলাদেশে বন্যা হয়, আর শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে ভয়াবহ খরা দেখা দেয়। এতে বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্যসম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও জনজীবন মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

ফারাক্কা ব্যারাজ এর অন্যতম বড় উদাহরণ। গঙ্গা নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে ভারত ১৯৭৫ সালে এই ব্যারাজ চালু করে, যার ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানির প্রবাহ কমে যায়। এর ফলে পদ্মা নদী সংকুচিত হয়েছে, কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে এবং পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে তিস্তা, ধরলা, মহানন্দা, দুধকুমারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীর পানিও ভারত একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।

তিস্তা চুক্তির প্রতীক্ষা: কবে পাবে বাংলাদেশ ন্যায্যতা?

তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য জীবনরেখা। কিন্তু ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে এই অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহ পানিসঙ্কট দেখা দেয়। ২০১১ সালে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছিল, কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ চুক্তির বিরোধিতা করায় কেন্দ্রীয় সরকার এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

বাংলাদেশ বারবার কূটনৈতিকভাবে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে, কিন্তু প্রতিবারই আশ্বাসের বাণী ছাড়া আর কিছুই মেলেনি। প্রশ্ন হলো, আমরা আর কতদিন আশ্বাসের রাজনীতি সহ্য করব? তিস্তা চুক্তি না হওয়ার পেছনে ভারতের কৌশলগত পরিকল্পনাই কি দায়ী?

আন্তর্জাতিক আইন ও বাংলাদেশের দাবি

আন্তর্জাতিকভাবে পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট আইন ও চুক্তি রয়েছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ আইন অনুযায়ী, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা নিশ্চিত করা জরুরি। তাছাড়া ১৯৯৭ সালের UN Convention on the Law of the Non-Navigational Uses of International Watercourses অনুযায়ী, কোনো দেশ অভিন্ন নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করতে পারে না।

কিন্তু ভারত এই নীতিমালা অনুসরণ করছে না। ফলে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত পানি সংকটে ভুগছে। আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করা দরকার। বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক ফোরামে আরও সোচ্চার হয় এবং কূটনৈতিক চাপে ভারতকে বাধ্য করতে পারে, তবে হয়তো সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।

পানির অভাবে বাংলাদেশের ভয়াবহ ক্ষতি

বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা মূলত নদীর পানির উপর নির্ভরশীল। দেশের প্রধান খাদ্য উৎপাদনকারী অঞ্চলসমূহে যখন পানির অভাব হয়, তখন কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয় নেমে আসে। বিশেষ করে বোরো মৌসুমে সেচের জন্য তিস্তা ও অন্যান্য নদীর পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভারত যখন একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে, তখন বাংলাদেশের কৃষকরা বিকল্প পানির উৎসের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে বাধ্য হয়।

শুধু কৃষিই নয়, পরিবেশের ওপরও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মতো প্রধান নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার ফলে নদীভাঙন তীব্রতর হচ্ছে। এতে হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হচ্ছে এবং জীবিকা হারাচ্ছে।

ভারতের প্রতি বাংলাদেশের কূটনৈতিক বার্তা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। কিন্তু প্রকৃত বন্ধু কখনো একতরফাভাবে অন্যের ক্ষতি করতে পারে না। ভারত যদি প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের বন্ধু হতে চায়, তাহলে ন্যায্যতার ভিত্তিতে পানি বণ্টন করতে হবে।

বাংলাদেশ চায় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। বাংলাদেশের সরকার সবসময় কূটনৈতিক পথে এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ভারতের উচিত হবে এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা।

সম্ভাব্য সমাধান কী?

১. তিস্তা চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন: ভারতকে অবশ্যই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করতে হবে।

২. আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা: জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশকে এর ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য আরও সক্রিয় হতে হবে।

৩. দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পর্যালোচনা: ফারাক্কা চুক্তিসহ অন্যান্য পানি চুক্তিগুলোর পুনঃমূল্যায়ন করা জরুরি।

৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, যাতে সরকার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রাখে।

পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া বাংলাদেশের অধিকার। ভারতকে অবশ্যই বন্ধুত্বের স্বার্থে এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে বাংলাদেশের পানির ন্যায্য হিস্যা ফিরিয়ে দিতে হবে। নতুবা ভবিষ্যতে এই সংকট আরও তীব্রতর হবে, যা শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং পুরো অঞ্চলের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। সময় এসেছে বাংলাদেশের দাবি আরও জোরালোভাবে উপস্থাপনের। ভারতকে বোঝাতে হবে যে, পানি কোনো রাজনৈতিক হাতিয়ার নয়, বরং এটি মানবতার মৌলিক অধিকার।

লেখক :সাংবাদিক সমাজ গবেষক, মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test