E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস: সংস্কারের অগ্রগতি নাকি স্থবিরতা

২০২৫ ফেব্রুয়ারি ১৩ ১৭:২১:১৩
অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস: সংস্কারের অগ্রগতি নাকি স্থবিরতা

মীর আব্দুল আলীম


ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন অন্তর্বর্তী সরকার গত ছয় মাসে একাধিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের রেখে যাওয়া বিধ্বস্ত অর্থনীতি, দলীয়করণে জর্জরিত প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সামাল দিতে গিয়ে সরকারকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে জনগণের প্রত্যাশা ওসরকারের কার্যক্রমের মধ্যে এক ধরনের ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। তবে, সেক্টরভিত্তিক সংস্কার কার্যক্রম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ এবং নির্বাচন নিয়ে সরকারের ঘোষণা ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে।নিম্নেকয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোকে ছয় মাসের বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো-প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ব্যবধান: আশা-নিরাশায় জনগণ ছাত্র-জনতারপ্রত্যাশা ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি কার্যকর রূপান্তর ঘটাবে, যেখানে ফ্যাসিবাদী শাসনের ক্ষতগুলো মেরামত করে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের পথ তৈরি হবে। কিন্তু ছয় মাসের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে, বাস্তবতা অনেকাংশেই ভিন্ন। প্রত্যাশা ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে, কিন্তু বাস্তবতা হলো—বাজার এখনো অস্থিতিশীল। চাল, ডাল, তেল, শাকসবজির দাম কিছুটা কমলেও ভোগ্যপণ্য ও আমদানি নির্ভর জিনিসপত্রের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় এখনও চরম কষ্টদায়ক। 

অপরদিকে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তার বাস্তবায়ন অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। যদিও কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে সরানো হয়েছে, কিন্তু প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এখনো আগের সরকারের অনুগত ব্যক্তিরা বহাল তবিয়তে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, যা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সংস্কার কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনো বহাল পতিত সরকারের আমলারা। ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় দলীয় অনুগত ব্যক্তিদের দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছিল। নতুন সরকার এদের সরিয়ে দিয়ে নিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, প্রশাসনিক কাঠামো, গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি বিচার বিভাগের বিভিন্নস্তরে এখনো আগের সরকারের অনুগত কর্মকর্তারা বহাল রয়েছেন। এর ফলে সংস্কার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেরি হচ্ছে বা সিদ্ধান্তগুলো পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সরকার সংস্কারের ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গতি আসেনি, যার কারণেজনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।

সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন ইতিবাচক : অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাধিক সেক্টরভিত্তিক সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যা বিভিন্ন খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতা চিহ্নিত করে সমাধান দিতে কাজ করছে। প্রশাসন, অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা এবং রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে কমিশনগুলোর সুপারিশ ইতিবাচক। প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান চালানো, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর দুর্নীতি রোধ, রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়ন স্বচ্ছ করা এবং আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন না হলে তা শুধুই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।

দাবি আদায়ে ১৭০টি আন্দোলন : গতছয় মাসে সরকারকে ১৭০টির বেশি আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। শ্রমিক, শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক সংগঠন, শিক্ষক ও পেশাজীবী সংগঠন বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করেছে। সবচেয়ে আলোচিত ছিল—গণহত্যা বিচার, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, শিক্ষা সংস্কার এবংশ্রমিক অধিকার রক্ষার আন্দোলন। আন্দোলনের ফলে কিছু দাবি মেনে নেওয়া হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার নীরব থেকেছে বা দমননীতি গ্রহণ করেছে। এতে করে জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।

সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ: সাবেকফ্যাসিবাদী সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে জনরোষ ছিল, তা কিছুটা হলেও বদলেছে। তবে সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যু। আন্তর্জাতিক মহলে ইউনূসের ইমেজ ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করছে, কিন্তু জনগণের মধ্যে এর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। জনগণ মনে করছে, পুরনো ক্ষমতাসীনদের দায়ভার এখন ইউনূসের ওপর চাপানো হচ্ছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে সরকারের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

আলোচনায় শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দল: বাংলাদেশেররাজনৈতিক অঙ্গনে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রায় প্রতিটি বড় পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলশিক্ষার্থীরা। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আলোচনা সামনে এসেছে। প্রশ্ন হলো, এই দল আদৌ টেকসই হবে কি না? এই দল ডঃ ইউনুস সরকারের ভাবমূর্তিতে কোন প্রভাব ফেলবে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আদর্শিক স্বচ্ছতা, নেতৃত্বের যোগ্যতা এবং রাজনৈতিক পরিপক্বতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তারা যদি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে পারে, তবে এটি একটি নতুন ধারার সূচনা হতে পারে। তবে, অতীত অভিজ্ঞতা বলে—বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ছায়াতলে না গেলে বা প্রশাসনিক দমননীতির শিকার হলে এ ধরনের উদ্যোগ টিকে থাকাকঠিন।

গণহত্যা বিচারের চ্যালেঞ্জ: ফ্যাসিবাদীশাসনের সময় সংঘটিত গণহত্যার বিচার নিয়ে ব্যাপক প্রত্যাশা থাকলেও এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সরকার বিচারের কথা বললেও এখনো তদন্তের গতি ধীর। গণহত্যার সঙ্গে জড়িত অনেক ব্যক্তি প্রভাবশালী মহলের ছত্রছিায়ায় থাকায় বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলও বিষয়টি নজরে রেখেছে, যা সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারে।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থা: সংকটের মধ্যে টিকে থাকার লড়াই অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, ঋণের বোঝা ও মূল্যস্ফীতি। সরকার অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রকাশ করলেও সংকট কাটানোর জন্য কার্যকর নীতিমালা এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি।বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলোর শর্তের কারণে কিছু ক্ষেত্রে সরকার নীতিনির্ধারণী স্বাধীনতা হারাচ্ছে। তবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় রোধ এবংউৎপাদন খাতকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।

আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি: স্থিতিশীলতা না ফিরে আসলে অনিশ্চয়তা বাড়বে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। ছয় মাসের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভূমি দস্যুতা, রাজনৈতিক সহিংসতা ও পুলিশের হয়রানি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। সংবিধান সম্মতভাবে ক্ষমতাহস্তান্তর না হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শেষ কথা: অন্তর্র্বতী সরকারের ছয় মাসের পারফরম্যান্স মিশ্র। কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও মূল সমস্যাগুলো এখনও অমীমাংসিত। জনগণের প্রত্যাশা ছিল দুর্নীতিমুক্ত, কার্যকর প্রশাসন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি এখনো জটিল। যদি সরকার সংস্কার প্রক্রিয়াকে দ্রুততর না করে, তবে জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়বে এবং নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এখনো সময় আছে—সরকার যদি প্রতিশ্রুত সংস্কারগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে, তবে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।।

লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

১১ মার্চ ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test