E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

সভ্য উন্নত দেশে হোমলেস মানুষ!

২০২৪ নভেম্বর ২১ ১৯:২৬:৪৪
সভ্য উন্নত দেশে হোমলেস মানুষ!

আবদুল হামিদ মাহবুব


আছি উন্নত বিশ্বের শীর্ষদেশ যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া রাজ্যের শহর ফিলাডেলফিয়া’তে। ছেলে নাজমুস সায়াদাত ইফাত ও বৌমা সৈয়দা আদিবা হুদা মুমু'র সাথে কিছুদিন কাটানোর জন্য আমাদের এই আসা। দিনগুলো আনন্দেই কাটছে। বাংলাদেশ থেকে আমরা এসেছি চারজন। আমি, আমার স্ত্রী লতিফা নিলুফার পাপড়ি বিয়াই এস কে হুদা কচি ও বিয়াইন আফরোজা হুদা মিনু।

আমাদের বৌমা ফিলাডেলফিয়ার এমাথা ওমাথা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। উবার, বাস, সাবওয়ে, ট্রলি, ট্রেনে আমরা ঘুরছি। মাইলের পর মাইল পাঁয়ে হাঁটছি। আমার ছেলে আমাদেরে খুব একটা সময় দিতে পারছে না। তার টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টের দায়িত্ব পালন, আবার রিসার্সের কাজের প্রচন্ড চাপ। তারপরও যখনই সময় পাচ্ছে সঙ্গ দিচ্ছে। সে সঙ্গ দিলে আমার হাতের ব্যাগ-টেগ সব তার হাতে নিয়ে নেয়। এতে আমার কেমন খালি খালি লাগে। বিদেশে বেড়াতে এসেছি। হাতে কাঁধে ব্যাগ না থাকলে তো নিজেকে পর্যটক মনে হয়না। আমি একটু ভাব নিয়ে ঘুরতে চাই, কিন্তু ছেলেটি সেটা করতে দেয় না!

আসার পর ইতোমধ্যে ১১-১২দিন চলেও গেছে। এখানে ওখানে যেতে যেতে এইদেশের মানুষের চলাচল, আচার আচরণ দেখছি। আমাদের বাঙালি কয়েক পরিবারের দাওয়াত খেয়েছি। অনেক বন্ধু স্বজন যোগাযোগ করছেন। সবারই কথা তাদেরকে যেনো সময় দিই। তিন সাপ্তারও কম সময় থাকবো। সেকারণে ইচ্ছা থাকলেও এবারে বন্ধু স্বজনদেও সময় দিতে পারবো না।

ফিলাডেলফিয়া সিটি হল এই শহরের এক্কেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। এই হল দেখাতে বৌমা নিয়ে গেলো। কয়েক’শ বছরের পুরোনো ভবন। এই ভবনকে কেন্দ্রে রেখেই নাকি চারপাশে এই শহর গড়ে উঠছে! ভবন ও ভবনের বাইরে অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তির মূর্তি রয়েছে। সাথে লেখা আছে তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।

বিশাল আয়তনের ভবনটি ঘুরে দেখে আমরা একটি কফি শপে গেলাম। ঢোকার মুখে তিন চারজন নানা বয়সী সাদা চামড়ার লোক দেখলাম। তাদের আচরণ দেখে আমার খটকা লাগলো। বৌমাকে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। সে তাড়া দিলো দ্রুত ওখান থেকে সরতে। আমরা কফি শপে ঢুকলাম। বৌমা বললো, ‘আব্বা, রাস্তায় এমন দেখলে, ওদের দিকে তাকাবেন না। ওরা এডিকটেড (নেশাগ্রস্থ)। রাস্তায়ই পড়ে থাকে। হোমলেস্ (গৃহহীন)।

আমার মনে প্রশ্ন জাগে সভ্য ও উন্নতদেশে হোমলেস্ মানুষ থাকবে কেনো? আমরা কফি খেয়ে বের হওয়ার সময় একটা ছেলে দরজা টেনে ধরেলো। বৌমা তাকে একটা ডলার দিলো দেখলাম। কেনো ডলার দিলো, জিজ্ঞেস করলাম? বৌমা বলে না দিলে খারাপ ভাষায় গালাগাল করতো। আমাদের পিছন পিছন কালো আরেকজন লোক কফি শপ থেকে বের হলো। সে ওই লোককে কফি ভরা একটি গ্লাস ও কিছু খাবার দিতে দেখলাম। বুঝলাম এমন মানুষ লোকজনের সাহায্যেই বেঁচে আছে।

পরিচিত বাঙালি পরিবারের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে অন্য অনেক বিষয়ের সাথে এইদেশের নেশাগ্রস্থদের প্রসঙ্গ যখন আসলো তখন জানতে পারলাম; এই নেশাগ্রস্থদের চাইলেই সুস্থ করা যায়। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন চায় না এরা সুস্থ হোক। এরা সুস্থ হয়ে উঠলেই ক্রাইম (অপরাধ) শুরু করবে। প্রশাসন এদেরে নেশাগ্রস্থ করেই রাখতে চায়। কেউ কেউ জানালেন এদেশের পুলিশও লুকিয়ে লুকিয়ে তাদেরে নেশাদ্রব্যও যোগান দেয়। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠণ নিরাপদে যাতে তারা নেশা শরীরে নিতে পারে তার জন্য ইনজেকশন সিরিঞ্জসহ আনুষাঙ্গিক সরবরাহ করে।

বৌমা আমাদের সাবওয়ে চড়ানোর জন্য মাটির নীচে পাতাল রেল স্টেশনে নিয়ে গেলো। নীচে নামার সময় মুত্রের দুর্গন্ধ পেলাম। বৌমাকে সেটা বলি, সে বলে দেখে পা ফেলে ফেলে আসুন। নেশাগ্রস্থরা কোনো কোনো স্থানে মলমুত্র ত্যাগ করে রেখে দেয়। এইদেশকে যত সভ্য বলুন, এখানে অসভ্যতা অনেক আছে।

ফিলাডেলফিয়া শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ডেলওয়ার নদী। এই নদী পার হয়ে ওপারে গেলেই নিউজার্সি। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি রাজ্য। ওখানে বড় একটি গ্লোসারি সুপার শপ আছে। সেখানে ভালো ইন্ডিয়ান গৃহস্থালী সকল পণ্য পাওয়া যায়। আমার বৌমা ওখান থেকেই বেশির ভাগ সওদাপাতি কিনে আনে। আমাদের সাথে নিয়ে সে ওখানে যাবে। ট্রেনে ৪০ মিনিটের দূরত্ব। টিকেট করে আমরা ট্রেনে চেপে বসলাম।

দুই নাম্বার স্টপে যাবার পর একটি ছেলে উঠলো। ট্রেনে আমরা যে কম্পান্ডমেন্টে (বগী) উঠেছিলাম সেটাতে যাত্রী যদিও খুব বেশি নয়, সেই অল্প সংখ্যক যাত্রীর সবার সামনে গিয়েই ওই ছেলেটি কি যেনো চাচ্ছিলো। আমি তার ভাষা বুঝতে না পেরে বৌমাকে জিজ্ঞেস করি ছেলেটি কি বলে? বৌমা বলে ছেলেটি ভিক্ষা চাইছে। আমি বলি, ‘আমাদের দেশের মতো এদেশে ভিক্ষুকও আছে!’

আরেকদিন সাবওয়েতে উঠে বসেছি। মিনিটখানেক সময় গেছে। ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। এক্ষুনি ট্রেন ছাড়বে। আমি জানালা দিয়ে চেয়ে বাইরে সাবওয়ে স্টেশনের একটি সাইন পড়ার চেষ্টা করছি। হঠাৎ দেখি দুইজন পুলিশ দ্রুত আসছে। এক পুলিশ তার হাতে থাকা লাইট জ্বালিয়ে কাকে কি যেনো সংকেত দিলো। দরজা খুলে গেলো। দুই দরজা দিয়ে দুই পুলিশ ঢুকলো। ঠিক আমার পিছনে বসা একজনকে ধরলো। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই তাকে বাইরে নিয়ে গেলো। আবার লাইট দিয়ে সংকেত দিলো। ট্রেন ছাড়লো।

আমি বৌমার মুখের দিকে তাকাই। বৌমা বলে, ‘ওই লোক কোনো ক্রাইম করে এসেছে।’ আমি বলি ‘ট্রেনে আমরা এতো লোক। তারা ওই লোককেই চিনতে পারলো কি ভাবে? দুই সেকেন্ডও সময় নেয়নি!’ বৌমা বলেন, ‘হয়ত ক্যামেরা দেখেই সনাক্ত করেছে।’ এটা দেখে মনে হলো এখানে কোনো অপরাধির পুলিশকে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই।

এরমধ্যে একদিনের জন্য নিউইয়র্ক সিটিতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার জন্য আগের দিন বাসের টিকেট কিনতে গেলাম। ছেলে ও বৌমা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কিনছে। আমি পাশে দাঁড়ানো। খেয়াল করিনি আমি যেখানে দাঁড়ানো সেখানে একটা দরজা ছিলো। হঠাৎ একটা শব্দ পেলাম। দরোজা ঠেলে দুইজন বিশালদেহী কালো মহিলা বের হলো। তারা আমাকে দরোজার সামনে দাঁড়ানো দেখে বেশ কিছু কথা বললো। আমি যদিও ইংরেজি খুব একটা বুঝিনা, তবে ধীরে ধীরে বললে এক দুই শব্দ বুঝতে পারি। যেমন ফিলাডেলফিয়া এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার কোনো কথাই বুঝিনি। আবার যে পুলিশ কর্মকর্তা আমাদের সিকিউরিটি চেক করলো তার বেশির ভাগ কথাই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু ওই দুই মহিলার বলা একটি শব্দও বুঝতে পারিনি।

আমার ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আব্বা তারা তোমাকে কি বলছে, বুঝছো?’ আমি বলি, নারে বাবা।’ ছেলে বলে আড়াই বছর ধরে আছি, আমিও এদের সব কথা বুঝিনা। তবে তোমাকে বলেছে দরোজার সামনে না দাঁড়ানোর শিক্ষাটা নার্সারী ক্লাসে দেওয়া হয়েছে, সেটা কি তুমি ভুলে গেছো? এমন কিছু কথা বলেছে। আমি বলি আমি তো কখনো নার্সারী ক্লাসে পড়িনি, আমি এসব শিখবো কি ভাবে! আমার বৌমা আমার কথা শুনে হাসে।

পরদিন সকাল আটটায় আমাদের নিউইয়র্কের বাস। সাতটা পয়তাল্লিশে রিপোর্ট করতে হবে। সময়ের আগেই আমরা গেলাম। কিন্তু বাস এলো সাড়ে আটটায়। এখানেও ঠিক সময়ে বাস ছাড়ে না! আমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করি। ছেলে বলে গত আড়াই বছরে আজই দেখলাম সময়ের হেরফের হতে।

নিউইয়র্ক যাওয়ার রাস্তায় স্থানে স্থানে অনেক জ্যাম ছিলো। বেলা প্রায় এগারোটায় নিউইয়র্ক পৌঁছালাম। বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে কিছুদূর যেতে রাস্তার কয়েক পয়েন্টে দেখলাম আমাদের দেশের মতো ট্রাফিক পুলিশ হাত ইশারা নিয়ে যানবাহন চলাচলের নির্দেশনা দিচ্ছে। মহিলা ট্রাফিক পুলিশও রাস্তা কন্ট্রোলে কাজ করতে দেখলাম। আমর বৌমা নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের কয়েক জায়গা দেখিয়ে পাতাল ট্রেন স্টেশনে নিয়ে গেলো। একুশ ডলার করে মেশিনে দিয়ে দিয়ে পর পর ছয়খানা কার্ড করে ফেললো। আমাদের ঢাকার মেট্টো রেলের মতো কার্ড মেশিনে পাঞ্চ করে ট্রেনের কাছে যাবার মুখে দেখি একজন লোক দাঁড়ানো। তার দুই হাত কনুইয়ের কাছে থেকে নেই। গলায় একটি ব্যাগ ঝুলানো। আমার ছেলে ওই লোকটার ব্যাগে দুই ডলার ঢুকিয়ে দিলো। বিয়াই জিজ্ঞেস করলেন তুমি কি তাকে সাহায্য করলে? আমি বলি এইদেশে কারো হাত কাটা গেলে তো কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দেওয়ার কথা। ছেলে আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বলে তারা বিশ্বকে দেখানোর জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গিয়ে বিনামূল্যে এসব করে আসে। এইদেশে ইন্সুরেন্স কাভার না করলে কোনো নাগরিক ঠিক মতো চিকিৎসা পায় না। এদেশে এসে থাকো, তখন বুঝতে পারবে কেমন সুযোগ-সুবিধা আছে।

আমি এই লেখায় আমেরিকার যে বিষয়গুলো আমাকে হোচট খাইয়েছে অর্থাৎ সভ্য ও উন্নত দেশ হিসাবে যেসব বিষয়গুলো আমি অন্য ভাবে ভেবে রেখেছিলাম, কিন্তু এখানে এসে বাস্তবে অন্যরকম দেখলাম, সেগুলোর টুকটাক কিছু লিখলাম। আগামীতে তাদের উন্নয়ন শৃংখলা গণতন্ত্র মুক্ত বাজার সেসব নিয়ে লেখার ইচ্ছা রইলো।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।

পাঠকের মতামত:

২২ নভেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test