E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

বৈষম্যের রাজনীতি ও লাঠিয়াল বাহিনী

২০২৪ সেপ্টেম্বর ০১ ১৬:২০:৪৩
বৈষম্যের রাজনীতি ও লাঠিয়াল বাহিনী

আবু মকসুদ


ছাত্ররা বিপ্লব করে দুর্ধর্ষ স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ এবং পলায়নে বাধ্য করেছে। ছাত্রদের মাঝে অমিত সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। ভাবা গিয়েছিল, তারা হয়তো দেশকে নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারবে। কিন্তু বর্তমানে তাদের কর্মকাণ্ড দেখে তাদেরকে স্রেফ লাঠিয়াল বাহিনী ছাড়া আর কিছু ভাবা যাচ্ছে না। যাদেরকে ভবিষ্যতের নেতৃত্বদাতা হিসেবে আশা করা হয়েছিল, তারা আজ ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করছে।

সচিবালয় আনসাররা ঘেরাও করেছে। আনসারদের প্রতিহত করার জন্য পুলিশ আছে, বিজিবি আছে, আর্মি আছে। সেখানে ছাত্ররা যদি ছাত্রলীগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদের মধ্যে পার্থক্যটা কী থাকে? এটা অবশ্য ঠিক কথা উঠেছিল, দুই সমন্বয়কে জিম্মি করা হয়েছে। বাস্তব কতটুকু সত্য সেটা এখনও জানা যায়নি। ছাত্ররা যদি ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় নিজস্ব আদর্শ বিসর্জন দেয়, তবে তাদেরকে আর আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় কীভাবে?

আনসাররা ছাত্রদের আহত করেছে, এজন্য শত শত তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হলো। কিন্তু যে ছাত্রদের হাতে আনসাররা আহত হলো, তারা বহাল তবিয়তে থেকে গেল। এটাকে বৈষম্যের কোন ভাষায় ব্যাখ্যা করা যাবে? ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে যে অন্যায়কে সঠিক প্রমাণিত করা যায়, তা তো বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এই বৈষম্য কি আমাদের সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে না?

সব আন্দোলন যদি ছাত্রদের মাধ্যমেই দমাতে হয়, তাহলে পুলিশ, বিজিবি এবং আর্মির প্রয়োজনীয়তা কী? একদিকে ছাত্রদের ব্যবহার করে অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা—এটা কোন নীতি বা আদর্শের প্রতিফলন?

বাংলাদেশে নতুন প্রতিরক্ষা ফোর্স গঠন করে বৈষম্যবিরোধী এই ছাত্রদের নিয়োগ করা হোক, ল্যাঠা চুকে যাক। ছাত্ররা উপদেষ্টাদের নিয়োগ দিয়েছে, অর্থাৎ উপদেষ্টাদের কান ধরে উঠবস করানোর ক্ষমতা ছাত্রদের আছে। আমার মনে হয়, উপদেষ্টাদের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। ছাত্ররা যেহেতু উপদেষ্টাদের সব কাজ নিজ দায়িত্বে সম্পন্ন করছে, সেহেতু উপদেষ্টা রেখে ফায়দা কী? উপদেষ্টাদের নামে শুধু অর্থের অপচয় হচ্ছে, যা সহজেই রোধ করা যেতে পারে।

যে কাজ ছাত্ররা নিজে করতে পারবে, সেই কাজের জন্য অহেতুক অর্থ ব্যয় করার কোনো মানে হয় না। চাকরের কাজ মুনিব করতে পারলে চাকরের প্রয়োজন কী? মনিবের পয়সা বাঁচল, তার সাথে মুনিবত্বও অক্ষুন্ন থাকল। এটা তো এক ধরনের সস্তা কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।

ছাত্রলীগ যদি আওয়ামী লীগকে ডুবাতে পারে, তাহলে এই তথাকথিত ছাত্ররা এই সরকারকে পদ্মায় চুবাবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। যখন ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া হয়, তখন ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলেও দেশের ভবিষ্যৎ কোন দিকেই যাবে তা বলা অত্যন্ত কঠিন।
দেখে শুনে ক্ষেপে গিয়েই উপরোক্ত কথাগুলো লিখে ফেলেছি। এতে আমার কোনো অনুশোচনা নেই।আমি সত্যই লিখেছি।

আরো বলি, শিক্ষক যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, তার শাস্তি দেওয়ার অধিকার ছাত্রদের কে দিয়েছে? নৈতিকতার কথা বাদ দিলেও, সামাজিকতা কিংবা দেশের প্রচলিত আইনে কি ছাত্রদের কোনো অধিকার আছে শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা, অপমান করা, বা টেনে হিচড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেওয়ার? শিক্ষক ছাত্রদের সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন, তবে কোনো পরিস্থিতিতেই শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের মধ্যে সহিংসতা কিংবা অসম্মানজনক আচরণের জায়গা নেই। এটা শুধু নৈতিকতার প্রশ্ন নয়, বরং শৃঙ্খলা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার বিষয়ও।

যারা ছাত্রদের এসব গর্হিত কাজের পক্ষে সাফাই গাইছেন, তারা কি কখনো ভেবেছেন যে, নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে যদি তারা কোনো অন্যায় করে থাকেন, এবং সেই কারণে যদি তাদেরও শিক্ষকদের মতোই টেনে হিচড়ে বের করে দেওয়া হয়, তারা কি তা মেনে নেবেন? কোনো পেশার মানুষের জন্যই এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়, তাই শিক্ষকদের প্রতি এমন আচরণ কেন সহনীয় হবে?

শিক্ষকের অন্যায়ের জন্য যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষ আছে। যদি কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে প্রতিকার করতে না পারে, তাহলে আদালত রয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত, ন্যায়বিচারের পথেই ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপ্লবের নামে ছাত্রদের বেয়াদবি সহ্য করা হলে, সেই বিপ্লব পালটা বিপ্লব হয়ে আপনার নিজের ঘাড়ে এসে পড়তে পারে। কারণ, সহিংসতার মাধ্যমে যে বার্তা পাঠানো হয়, তা সমাজের সকল স্তরে সহিংসতাকে উৎসাহিত করে।

১২-১৪ বছরের নাবালক ছাত্ররা যেখানে-সেখানে শিক্ষকদের অপমান করছে, আর আপনারা সুশীল হিসেবে তা মেনে নিচ্ছেন কিংবা এসব কাজের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। এতে এটা বোঝায় যে, আপনারা নিজেরাই অন্যায়ের বোধ হারিয়ে ফেলেছেন। একজন নাবালক শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষক হচ্ছেন আদর্শের প্রতিমূর্তি, সেই শিক্ষককে অবমাননা করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কোন সমাজে বেড়ে উঠছে?

শেখ হাসিনার স্বৈরাচারের সমালোচনা করতে চাইলে, প্রথমে নিজের মনের স্বৈরাচার ধ্বংস করুন। নিজের মন যদি সঠিক পথে না থাকে, কোনটি ন্যায় কোনটি অন্যায় বুঝার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। শিক্ষকদের প্রতি সম্মান ও সংযম প্রদর্শন না করলে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় হবে এবং সমাজে সত্যিকার সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না।

এই আপনারাই দুদিন পরে সমাজকে নিয়ে হাপিত্যেস করবেন। অন্যায়কে সমর্থন করে নিজেকে ন্যায়ের প্রতি অনুগত প্রমাণ করা যায় না, অন্যায় সর্বক্ষেত্রে অন্যায়। শেখ হাসিনা করলেও অন্যায়, ছাত্ররা করলেও অন্যায়। অন্যায়ের নিন্দা করুন, কোন প্রকার যুক্তি দিয়ে তা জায়েজ করার চেষ্টা করবেন না। ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলার জন্য সঠিক পন্থায় অবস্থান নিন, যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম একটি স্থিতিশীল সমাজে বেড়ে উঠতে পারে।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক।

পাঠকের মতামত:

১৫ জানুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test