E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে কিছু কথা

২০২৪ আগস্ট ৩০ ১৭:১২:০৭
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে কিছু কথা

আবীর আহাদ


জাতীয় স্মৃতিশৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণের পর সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে এরং আমার সাথে দু-বার আলাপচারিতায় নয়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম বীরপ্ততীক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার প্রয়োজনে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের যে প্রত্যয় ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, তাঁর সেই প্রত্যয় ও অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা যায় যে, মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত গেজেটই কেবল প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার সদয় অবগতি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সুবিধার্থে আমি নিন্মলিখিত নিবন্ধটি উত্থাপন করছি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং মুজিবনগর সরকারের পরিচালনায়, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে, বীর মুক্তিবাহিনীর শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে পরিগণিত হয়েছেন। স্বাধীনতার বিগত ৫৩ বছরে এদেশে যারা জীবনে যা কল্পনা করেননি তারা তাই হয়েছেন- এখনো হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে হতেই থাকবেন। এর মূলেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ তথা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান।

বিগত পাঁচ হাজার বছরের মধ্যে এই প্রথম পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। অতঃপর বাংলাদেশ একটি সংবিধান পেয়েছে, পেয়েছে একটি জাতীয় পতাকা ও একটি জাতীয় সঙ্গীত। চির পরাধীন বাঙালি জাতি পেয়েছে তাদের একটি জাতিসত্তা, জাতিরাষ্ট্র ও স্বাধীন বাঙালি সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে দেশ পরিচালনার অধিকার। মুক্তিযোদ্ধাদের সৃষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই বাঙালি আজ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, এমপি, সামরিক প্রধান, সচিব, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী প্রভৃতি হতে পারছেন। আর এ-সবই সম্ভব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের ভিত্তিতে। বাংলাদেশ পরিচালিত হতে থাকবে তাই সেই মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা ও আদর্শে। সুতরাং বাঙালি জাতি ও তার সরকার কোনোমতেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন ও অবমাননা করার কোনোই অধিকার রাখে না।

কিন্তু আমরা দুঃখের সাথে বলছি, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করেনি! সংবিধানের প্রস্তাবনাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। যেমন সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : "আমরা বাংলাদেশের জনগণ উনিশশো একাত্তর খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসের ছাব্বিশ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি"- সেখানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কথা নেই! অর্থাৎ 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটি অনুপস্থিত। অথচ আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত এক রক্তাক্ত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছি বলেই আমরা 'মুক্তিযোদ্ধা' হয়েছি; বিজয় লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছি। এবার আসুন প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে। সেখানে বলা হয়েছে : "যেসকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল" বলে উল্লেখ রয়েছে সেখানেও মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বীরযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা নেই!

বীর 'জনগণ' বলতে একাত্তরের এদেশের সব মানুষকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু সব জনগণ তো মুক্তিযুদ্ধে তথা স্বাধীনতা আনায়নে অবদান রাখেননি। তৎকালীন সাড়ে সাতকোটি মানুষের মধ্যে বিশাল এক মানবগোষ্ঠী হানাদার পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিলো। তারা তথাকথিত শান্তি কমিটি গঠনসহ সশস্ত্র রাজাকার আলবদর আলশামস ও আলমুজাহিদ বাহিনী গঠন করে হানাদারদের সহযোগী হিশেবে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেছে। তারা পাকিস্তান বাহিনীর সাথে মিলেমিশে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, তিন লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে, লক্ষ লক্ষ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের সহায়সম্পদ লুটপাট করেছে।

মুক্তিযুদ্ধে জনগণের অবদানের কথা বলে ঐসব স্বাধীনতাবিরোধীদের কার্যকলাপকে এড়িয়ে তাদেরকেও মুক্তিকামী জনগণ বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে ! আর সবচেয়ে দু:খজনক এই যে, যে প্রায় দেড় লক্ষ সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে বলে যে রাষ্ট্রীয় সংবিধান সৃষ্টি করা হলো, সেখানে তাদের অবদানেরই কোনো উল্লেখ নেই! এমতাবস্থায় সংবিধানের প্রস্তাবনা মোতাবেক প্রতিভাত হয় যে, বাংলাদেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি এবং মুক্তিযোদ্ধা বলতে কেউ নেই! যার ফলে জামায়াতী আলী আহসানরা দাঁত বের করে বলতে পেরেছে যে, বাংলাদেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি!

অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ ও বোদ্ধারা মনে করেন, সংবিধানের প্রস্তাবনায় বর্ণিত 'মুক্তিগ্রাম'ই 'মুক্তিযুদ্ধে'র নামান্তর। তাহলে তো বাংলাভাষার অভিধানে 'মুক্তিসংগ্রাম' ও 'মুক্তিযুদ্ধ' বলে দু'টি শব্দ থাকতো না। সংগ্রাম ও যুদ্ধ দু'টি ভিন্ন শব্দ বলেই তো অভিধানে তা ভিন্ন নামে স্থান করে নিয়েছে, যার ব্যাখ্যা শব্দদ্বয়ের মধ্যেই নিহিত। ইংরেজি ভাষায়ও এ-প্রসঙ্গ দু'টির ভিন্ন নাম রয়েছে, একটি হলো Liberation Struggle (মুক্তিসংগ্রাম), আর একটি হলো Liberation War বা War of Liberation (মুক্তিযুদ্ধ)।

আমরা একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছি বলেই তো আমরা অহরহ বলে থাকি 'মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার', 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নই আমাদের লক্ষ্য' ইত্যাদি। অপরদিকে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে ঘটা করে মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানহ নানান অভিধায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষিত করা হয়। অথচ সংবিধানের মূলস্তম্ভ 'প্রস্তাবনা'র কোথাও মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দের নামগন্ধ নেই। ফলে জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরব্জ্জ্বল অধ্যায় ও শ্রেষ্ঠ সন্তান হিশেবে 'মুক্তিযুদ্ধ' ও 'মুক্তিযোদ্ধা'র সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই! এই ভুল ও অস্পষ্টতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ চলতে পারে না। সাংবিধানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃত নয় বলেই অহরহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ঘটছে এবং অ-মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকাররাও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে চলেছে! মুক্তিযুদ্ধের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকার ফলে একটি কুচক্রীমহল আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভাইয়ে-ভাইয়ে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, গণ্ডগোলের বছর ইত্যাদি অপবিশেষণে অভিহিত করার সুযোগ পাচ্ছে যা আগেই বলেছি।

এসবের মধ্যে দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পদদলিত হচ্ছে এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদাহানি ঘটছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বসহ তাদের জন্য যৎসামান্য ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় বিরাটসংখ্যক ভুয়ারা ভাগ বসিয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে যেখানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দেড় লাখের বেশি নয়, সেখানে আজ মুক্তিযোদ্ধার সরকারি সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দু'লাখ পঁয়ত্রিশ হাজারের ওপরে, যার মধ্যে আশি/পঁচাশি হাজারই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা! বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও সাম্প্রতিক ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার আমলেই এই ভুয়াদের সিংহভাগ গেজেটভুক্ত হয়েছে।

জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্য ও গৌরবকে চিরস্মরণীয় করে মহাকালের গতিপথে সত্য সুন্দর ও পবিত্রতাকে প্রতিষ্ঠিত করার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের সচেতন নাগরিক হিশেবে আমি 'একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ'-এর ব্যানারে জাতীয় স্বার্থে সংবিধানের যথাস্থানে 'মুক্তিযুদ্ধ' ও 'মুক্তিযোদ্ধা' শব্দদ্বয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানসহ বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে একটি উচ্চপর্যায়ের সামরিক বা বিচারবিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই তদন্ত কমিশন গঠন করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা প্রণয়নের দাবি তুলেছি, যা এখন ব্যাপক মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে মাননীয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা তাঁর প্রত্যয় ও অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করবেন বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

১৫ জানুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test