E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

মাদকাসক্তির অভিশাপে নিমজ্জিত পৃথিবী, প্রয়োজন নির্মূলের কৌশল

২০২৪ জুলাই ১৪ ১৬:৩৯:০৬
মাদকাসক্তির অভিশাপে নিমজ্জিত পৃথিবী, প্রয়োজন নির্মূলের কৌশল

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


সারা পৃথিবীতে তরুণ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো নিয়ে একটি তালিকা বানাতে গেলে মাদকাসক্তি বোধ হয় সবার উপরের দিকেই থাকবে।আর মাদকদ্রব্য বলতে বোঝানো হয় যে, এমন দ্রব্য, যা খেলে নেশা হয়। এগুলো হলো গাঁজা, ফেনসিডিল, চরস, ভাঙ, গুল, জর্দা, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, মদ, ইয়াবা ইত্যাদি। যখন কেও এসব দ্রব্যাদির উপর নেশাগ্রস্থ হয়, তখনই তাকে মাদকাসক্ত বলা হয়।

কেন এই আসক্তি?

মানুষকে মাদকাসক্তির দিকে পরিচালিত করার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা, সামাজিক অস্থিরতা, উত্তেজনা, একঘেয়েমি, একাকিত্ব এবং পারিবারিক কাঠামো পরিবর্তনের পরিবেশে ব্যর্থতার সঙ্গে লড়াই করতে অক্ষমতা। তবে মাদকাসক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ হলো মাদকের সহজলভ্যতা।

দ্রুত নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যাপক উন্নয়ন এবং ইন্টারনেট ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, সামাজিক সচেতনতার অভাব ইত্যাদিও মাদকের সমস্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। পারিবারিক কলহ, ডিভোর্সের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবার, প্রেম ও চাকরিতে ব্যর্থতা থেকে হতাশার কারণেও মাদকাসক্তের হার বাড়ছে। বেশির ভাগ মাদক ব্যবহারকারী ‘পিয়ার প্রেশার’ বা বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়াকে প্রধান ‘পুল ফ্যাক্টর’ হিসেবে দোষারোপ করেছেন। প্রথমবারের মতো মাদক গ্রহণের জন্য কৌতূহল অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করে।

কিশোর-কিশোরীরা কিভাবে নেশাগ্রস্থ হয়

_ বন্ধু বান্ধবের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে।

_বিজ্ঞাপনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে।

_ ভুল তথ্য, হতাশা, কৌতূহলবশতঃ।

_ আদর্শ মনে করে এমন কার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে।

_ স্মার্ট দেখানোর জন্য।

মাদকাসক্তির কুফল বা ক্ষতিকর দিকগুলো:মাদকদ্রব্য শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষতি করে থাকে।

মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি

_ শেখার ক্ষমতা এবং কাজের দক্ষতা কমিয়ে দেয়।

_ বিচার-বিবেচনা, ভুল ঠিক বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে যায়, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা।

_ আবেগ নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকেনা।

_ উগ্র আচরণের জন্ম দেয়।

_ মানসিক পীড়ন বাড়িয়ে দেয়, আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। স্বাভাবিক জীবন যাত্রা ব্যাহত হয়।

শারীরিক ক্ষতি

_ মস্তিষ্ক ও শ্বাসযন্ত্রের ক্ষমতা ও শরীরের সূক্ষ্ম অনুভূতি কমিয়ে দেয় এবং স্মৃতি শক্তি কমিয়ে দেয়।

_ স্বাভাবিক খাদ্য অভ্যাস নষ্ট করে।

_ যৌন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

_ এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

_ হৃদরোগ সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

অর্থনৈতিক ক্ষতি

_ পরিবারে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়।

_ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত খরচ বেড়ে যায়।

_ কর্মক্ষম জনশক্তি কমে যায়।

মাদকাসক্তির প্রতিরোধ ও এর প্রতিকার কিভাবে করা যায়

মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ হলো শারীরিক নির্ভরতা দূর করা। এজন্য প্রয়োজন কার্যকর ও সাশ্রয়ী মূল্যের ওষুধ। সরকারের উচিত মাদক নিরাময়ে ব্যবহার করা ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রয়োজনে ভর্তুকি প্রদান করা। যাতে করে স্বল্প খরচে মাদক সেবীদের চিকিৎসা করা যায়।

মাদকাসক্তির পেছনে অনেক সময়ই মানসিক কারণ কাজ করে। হতাশা, উদ্বেগ, ট্রমা, – এসবের প্রভাব মাদকের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করে। তাই মাদকাসক্তদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনোবিজ্ঞানী, মনোচিকিৎসক এবং সামাজিক কর্মীদের সহায়তায় মাদকাসক্তদের মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব।

তবে মাদকমুক্ত জীবনে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন আর্থিক স্বাবলম্বন। তাই মাদকাসক্তদের জন্য জীবিকা নির্বাহের প্রশিক্ষণ প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে তারা নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে।

মনে রাখবেন, মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে নিজের পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ, সহানুভূতি, সমর্থন এবং উৎসাহের মাধ্যমে একটি পরিবার কোনো মাদকাসক্তদের নতুন জীবন গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা যোগাতে পারবে।

কঠোর আইনে মাদক প্রতিরোধ

মাদকের সহজলভ্যতা কমিয়ে আনা মাদকাসক্তি রোধের অন্যতম কার্যকর উপায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুলো কে অবশ্যই মাদকের উৎস ও সরবরাহ চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে হবে। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা, মাদক বিক্রির স্থান গুলোতে অভিযান চালানো এবং গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করলে মাদকের সহজলভ্যতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

পরিশেষে বলতে চাই, মাদকাসক্তি এক নীরব ঘাতক ব্যাধি। যে দ্রব্য গ্রহণে আসক্তি জন্মে তার নাম মাদকদ্রব্য। মাদকদ্রব্য গ্রহণ একটি বদঅভ্যাস, একটি আচরণগত সমস্যা, মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে মাদকাসক্তের স্বাস্থ্যহানি হয় জীবনীশক্তি কমতে থাকে, শরীরের ইন্দ্রিয়গুলো নিস্তেজ হয়ে যায়, আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়, মানসিক ভারসাম্য লোপ পায়, কর্মদক্ষতা ও ক্ষমতা হ্রাস পায়, হতাশা এবং অবসাদ তাকে ঠেলে দেয় এক অন্ধকার জীবনে। সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলে। কোনো ব্যক্তি মাদকাসক্ত হলে তার মধ্যে নানান রকম পরিবর্তন দেখা দেয়। এ সব পরিবর্তনকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- দৈহিক পরিবর্তন, আচরণগত পরিবর্তন, মানসিক পরিবর্তন, বোধশক্তিতে পরিবর্তন, কাজে-কর্মে পরিবর্তন ইত্যাদি। মাদকসক্তি অপরাধ নয়, রোগ। মাদকাসক্ত ব্যক্তি তাই কোনো অপরাধী নয়, একজন রোগী। মাদকাসক্তি একটি মারাত্মক বয়সের অসুস্থতা। এইডস, ক্যানসার ও হৃদরোগের মতো এটি একটি ভয়াবহ রোগ। এ রোগটি নিরাময়ের অযোগ্য হলেও মাদকাসক্ত ব্যক্তি যদি সুস্থতার জন্য আগ্রহী হন চিকিৎসা ও চিকিৎসা পরবর্তী পরিচর্যার মাধ্যমে অসুস্থ মনোভাব ও জীবনধারা পরিবর্তন করেন, জীবনকে সুশৃঙ্খল পুনর্ভাবে পরিচালনা করার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন তাহলে তিনিও মাদকমুক্ত থেকে সুন্দরতম জীবন উপভোগ করতে পারেন।

মাদকাসক্তির অভিশাপে নিমজ্জিত এখন গোটা পৃথিবী। মাদকদ্রব্যের ভয়াবহতা আজ কোনো দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সমগ্র বিশ্ব এ সমস্যার সম্মুখীন। পৃথিবীর অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এই সমস্যায় জর্জরিত। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ মাদক পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জাতি আজ বেশি উদ্বিগ্ন কারণ বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে মাদকাসক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের প্রায় দ্বিগুণ। এ দেশের মাদকাসক্তদের অধিকাংশই তরুণ এবং শতকরা ৮৫ ভাগ মাদকাসক্তের বয়স ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। আমাদের দেশে বহুবিধ মাদকদ্রব্যের মধ্যে এখন 'ইয়াবা' হলো সবার প্রিয়। এই মাদকদ্রব্য বর্তমানে বাজারের আলু-পটলের মতো সবখানেই পাওয়া যায়। কারণ, এটি সহজলভ্য, ঝটপট নেশা, সেবনে মনে জাগায় আনন্দ। তাই যুবসমাজের কাছে বর্তমানে নেশার জগতে ইয়াবাই সেরা। দেশে ইয়াবা সেবনকারী দিন দিন বেড়েই চলছে। সেই সঙ্গে জায়গায় জায়গায় খুন, ছিনতাইসহ বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। পারিবারিক দিক দিয়েও বেড়ে যাচ্ছে অশান্তি।

জানা যায়, দুই-তিনদিন একনাগাড়ে 'ইয়াবা' সেবনের ফলে 'ইয়াবায় আসক্তি হয়ে পড়ে। তখন তাকে আর এই বদ নেশা থেকে ফেরানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই নেশার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। যাতে আমাদের সন্তানরা নেশার জগতে পা বাড়াতে না পারে। সন্তানের প্রতি একটু মনোযোগী হলেই নেশা থেকে তাকে দূরে রাখা সম্ভব। আর মাদক প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা, পরিমিত জীবন যাপন, বন্ধু নির্বাচন, দায়িত্বশীলতা ইত্যাদি মাদকাসক্তি প্রতিরোধ ও প্রতিকারের পথ।

লেখক : সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test