E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

নদী ভাঙন আতঙ্কে উপকূলবাসী, প্রতিরোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা 

২০২৪ জুলাই ১২ ১৯:৩২:০৭
নদী ভাঙন আতঙ্কে উপকূলবাসী, প্রতিরোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


নদী ভাঙন এক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সাধারণত সমুদ্রে গিয়ে পড়ার সময় নদীর পানি তীব্র গতিপ্রাপ্ত হয়। এতে পানির তোড়ে নদীর পাড় ভাঙতে থাকে। পানির স্রোতে নদীর পাড় ভাঙার এই অবস্থাই হলো নদী ভাঙন। এর অন্যতম কারণ বন্যা।আর নদী ভাঙ্গন উপকূলীয় বাসিন্দাদের কাছে এক আতংকের নাম। শব্দটি শুনলেই চোখের কোনে ভেসে উঠে সব হারানো কিছু অসহায় মানুষের ছবি। প্রতিবছরই উপকুলীয় এলাকায় মাইলের পর মাইল জমি নদী গর্ভে চলে যায়। এক জরিপে দেখা যায় প্রতিবছর প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমি নদী গর্ভে চলে যায়। এতে করে বসতভিটা জায়গা-জমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। বিলীন হচ্ছে রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদরাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

নদী ভাঙনের প্রাকৃতিক কারণ সমূহ

* বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ: বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ হওয়ায় এখানকার জমি পলি মাটি দিয়ে গড়া। এতে করে মাটির গঠন অনেক দূর্বল। এই দূর্বল মাটি নদীর পানির স্রোত সবসময় সইতে পারেনা। এতে করে সামান্য শক্তিশালী স্রোত এলেই নদী ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়।

* বন্যা: নদী ভাঙনের একটি অন্যতম কারণ হলো বন্যা। সাধারণত বর্ষাকালে আমাদের দেশে বন্যার প্রকোপ বেড়ে যায়। বন্যার সময় নদীতে পানির প্রবাহ খুব বেশি থাকায় ঐ পানির স্রোত মাটির স্তর ভেঙ্গে ফেলার জন্য যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে থাকে। এসময় নদীর তীরের পানির গতি বেশি থাকে এবং ঐ পানি তীরবর্তী মাটিতে আঘাত হেনে নদী ভাঙ্গন সৃষ্টি করে। এতে করে বন্যার সময় নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।

* অতি বৃষ্টিপাত: অতি বৃষ্টিপাতে ফলে নদীতে পানির প্রবাহ বেড়ে যায় সেই সাথে বাতাসের প্রভাবে নদীর পানি উত্তাল থাকে। এতে করে অতি বৃষ্টিপাতের সময় নদীতে শক্তিশালী ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। তখন নদীর ঢেউ তার তীরবর্তী স্থানের উপর বাড়তি চাপ প্রয়োগ করে। এতে করে নদীর তীরের দুর্বল অংশের মাটি ভেঙ্গে পড়ে এবং ধীরে ধীরে এই ভাঙ্গন প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পায়।

* নদীর তলানীতে পলি জমা: প্রকৃতির নানা বিচ্যুতির কারনে নদীর তলানীতে পলি জমে থাকে। এতে করে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। এতে করে নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে তীরে চাপ সৃষ্টি করে এবং নদীর তীর ভেঙে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ঘটায়। এভাবে নদী ভাঙন তরান্বিত হয়।

* প্রবল স্রোতস্বিনী নদী: কিছু কিছু নদী পানির প্রবাহের পরিমান বা পাহাড়ী ঢলের কারণে প্রবল স্রোতস্বিনী হয়ে থাকে। এসব নদীর পানির প্রবাহের তীব্রগতির কারণে নদীর ভাঙ্গন হতে পারে। এসব স্থানের নদী তীরের গঠন শক্তিশালী না হলে নদী ভাঙ্গন তরান্বিত হয়।

* নদীর প্রশস্ততা: নদীর প্রশস্ততা নদী ভাঙ্গনের সাথে সম্পর্কিত। নদীর প্রশস্থতা বেশি হলে নদী ভাঙ্গনের সম্ভাবনা ও বেড়ে যায়।

* নদীতে নতুন চর তৈরি হওয়া: নদীতে পলি জমে চর তৈরি হয়। অনেক সময় নদীর মাঝখানে নতুন চর তৈরি হলে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়। এতে করে নদীর একপাড়ে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয় এবং নদী গতিপথ পরিবর্তন করে অন্য দিকে চলে যায়।

নদী ভাঙনের মানবসৃষ্ট কারণসমূহ

* বন উজাড় করা: গাছের শিকড় মাটির গভীরে গিয়ে মাটির গঠনকে শক্তিশালী করে। এতে করে নদীর তীরবর্তী মাটির ভিত্তি শক্তিশালী হয়। দিনে দিনে মানুষ নিজের প্রয়োজনে বন কেটে উজাড় করার কারণে নদীর তীরের মাটি দূর্বল হয়ে যায়। এতে করে নদীর তীব্র স্রোতের ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাটি ভেঙ্গে পড়ে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়।

* নদীর পাড়ে বসত বাড়ি ও স্থাপনা নির্মান করা: মানুষ নদীর তীরবর্তী স্থানে বাড়ী ঘর ও নানা স্থাপনা নির্মাণের ফলে মাটি ধারন ক্ষমতা কমে যায় এবং ধ্রুত ভেঙ্গে পড়ে। তাই নদী তীরবর্তী স্থাপনা ও নদী ভাঙ্গনের একটি কারণ।

* নদী থেকে বালি উত্তোলন: আমরা প্রায়ই নদী হতে বালু উত্তোলন করতে দেখি। এই বালু উত্তোলনের ফলে নদীর ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং নদী ভাঙ্গন শুরু হয়। তাই নদী থেকে বালু উত্তোলন ও নদী ভাঙ্গনের জন্য দায়ী।

* নদীতে বাধ দেয়া: অনেক সময় আমরা নদীর উপর বাধ দিয়ে নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করা চেষ্টা করি। তৈরি করি বিদ্যুত কেন্দ্র, সেচ প্রকল্প। এতে করে আমরা সাময়িকভাবে কিছুটা উপকৃত হলেও এতে করে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার তৈরি হয়ে থাকে। নদীতে সৃষ্ট বাধ নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্থ করে এবং এতে করে নদী ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়।

* শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি করা: যুগ যুগ ধরে নদীর তীর ঘেষে তৈরি হয়েছে নানা জনপনদীর তীর অনেক সময় নদীর একতীরে অবস্থিত শহর রক্ষা করতে গিয়ে মানুষ শহর রক্ষা বাঁধ দিয়ে থাকে। এতে করে নদীর একপাড়ের ভাঙ্গন রোধ হলেও অন্য পাড়ে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়।

* অপরিকল্পিত ড্রেজিং: আমরা নদীতে নিয়মিতভাবেই ড্রেজিং করতে দেখতে পাই। সব সময় ড্রেজিং উপকারে আসে না। অপরিকল্পিতভাবে ডেজিং করার ফলে নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততার মাঝে ভারসাম্য থাকে না। এতে করে নদী ভাঙন সৃষ্টি হয়ে থাকে।

পরিশেষে বলতে চাই, বর্ষার শুরুতেই নদীভাঙন শুরু হয়েছে বিভিন্ন জেলায়। নদীগর্ভে চলে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। বহু গ্রাম, জনপদ, ফসলের জমি হারিয়ে যায় নদীভাঙনে। হাজার হাজার মানুষ গৃহহারা, নিঃস্ব হয়। বছরের এ সময়টা নদীতীরের ভাঙন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন এটা দেশবাসীর ভাগ্যের লিখন। সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে নদীভাঙনের খবর আসছে। ভাঙনের খবর আসবে আরও কয়েক মাস।আর বাংলাদেশের মোট আয়তনের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই প্রধান তিনটি নদ-নদী অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত। প্রধান তিন নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা ছাড়াও নদীবিধৌত বাংলাদেশের ছোট-বড় নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ৪১০টি। এসব নদ-নদীর তটরেখার দৈর্ঘ্য হচ্ছে প্রায় ২৪ হাজার ১৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে কমপক্ষে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার তটরেখা নদীভাঙনপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নদীভাঙনের দ্বারা। ফলে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

এ ছাড়া প্রতিবছর নদীভাঙনে নিঃশেষ হয়ে যায় প্রায় ৮,৭০০ হেক্টর জমি।আর নদীভাঙন সংঘটিত হয় দেশের প্রায় ১০০টি উপজেলায়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে নদীভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জমির মালিকরা। কারণ তারা কখনোই আর সে জমি পুনরুদ্ধার করতে পারে না। আর এ দেশের নদীভাঙন একটি অতি প্রাচীন ও ভয়াবহ সমস্যা। পুরো বর্ষাকালেই চলতে থাকে ভাঙনের তাণ্ডবলীলা। বর্ষা শেষে ভাঙনের প্রকোপ কিছুটা কমলেও বছরজুড়ে তা কমবেশি মাত্রায় চলতে থাকে। আর এবারের বন্যায়ও নদী ভাঙনের করুণ শিকার হয়ে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এবারও নদী ভাঙনের শিকার মানুষেরা সেই আগের কথার প্রতিধ্বণিই করেছেন ‘আমরা ত্রাণ চাই না, আগে নদী ভাঙন ঠেকান’। আসলে নদী ভাঙন প্রতিরোধ এবং নদীভাঙা মানুষের পুনর্বাসন এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানে সরকারেরও তেমন আলাদা বরাদ্দ নেই।

জেলা বা উপজেলাগুলোতে সরকারের যে ডিজাস্টার ফান্ড রয়েছে সেখান থেকে নামকাওয়াস্তে কিছু খয়রাতি সাহায্য সহযোগিতা করা হলেও ফান্ড অপ্রতুলতার কারণে সেটা খুব বেশি ফলদায়ক কিছু হয় না। নদীভাঙা মানুষের যে নিয়ত দুর্ভোগ তা থেকে তাদেরকে মুক্তি দিতে হলে সরকারের কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। আর নদী ভাঙা মানুষের পূনর্বাসনে জেলা-উপজেলাগুলো সরকারের সুনিদিষ্ট ফান্ড থাকা প্রয়োজন। যেখান থেকে ভাঙন কবলিত মানুষগুলোকে দ্রুত সাহায্য সহযোগিতা করার সুযোগ থাকবে। একইভাবে নদী ভাঙন এলাকাতে যে সব উন্নয়ন সংগঠন কাজ করে তাদের একটি সমন্বিত ফান্ডের ব্যবস্থা থাকবে যা থেকে তারা দ্রুততই দুর্যোগ এলাকাগুলোতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।

বন্যা, নদী ভাঙন আমাদের নদী পরিবেষ্টিত এই দেশে মোটেও নতুন নয়। কিন্তু নদী ভাঙন রোধ, এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে এখনও আমরা সেভাবে সক্ষমতা দেখাতে পারিনি। ফলে প্রতিবছরই আমাদের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে।

একইভাবে নদী ভাঙনের কারণে স্বল্প আয়ের চরবাসীকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে চরাঞ্চলে যে প্রায় ১ কোটি মানুষ বাস করে তারা আমাদের অন্যতম এক সম্পদ। এই ১ কোটি মানুষের রক্ষায় আমাদের সঠিক কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে। আর আশংকার বিষয় হচ্ছে, এমনিতেই বাংলাদেশে প্রতিবছরই আবাদী জমি কমছে। বাড়ছে মানুষ। নদীভাঙ্গা উদ্বাস্তু মানুষের চাপ পড়ছে বড় শহরগুলোতে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যত কি? যদিও চাইলেও পরিকল্পনা, মহা পরিকল্পনা করেও প্রকৃতির এতো বড় বিপর্যয় মানুষের পক্ষে ঠেকানো সম্ভব নয়। তারপরও এখন সর্বোচ্চ সতর্কতা নিতে হবে নদী ভাঙন কমিয়ে আনতে। এজন্য শুধু জাতীয় নয়, নিতে হবে আন্তর্জাতিক সহায়তা, পরামর্শ ও পরিকল্পনা।

লেখক : সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test