E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

মাদক নির্মূলে পারিবারিক সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ জরুরি

২০২৪ জুন ২৪ ১৬:৪৪:৫৫
মাদক নির্মূলে পারিবারিক সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ জরুরি

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


মাদকের অপব্যবহার এবং অবৈধ পাচারের বিরুদ্ধে ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর ২৬ জুন আন্তর্জাতিক ভাবে পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবস। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্ভাবনাময় সময়ের অগ্রযাত্রায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ানো একটি নাম মাদক। তবে হতাশার কথা হলো এটি এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তাই কথা বলতে হবে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। কথা বলার শুরুতেই জানা দরকার মাদকটা আসলে কি ? যে সব প্রাকৃতিক বা রাসায়নিক দ্রব্য সেবন বা গ্রহণ করার ফলে মানুষের অনুভূতি অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে এবং মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে তাকেই মূলত আমরা মাদক বলি। মাদক এমন একটা বস্তু যার দ্বারা হঠ্যাৎ মানুষ আসক্ত হয় না। ধীরে ধীরে মানুষ এসব মাদকের নেশায় আবদ্ধ হয়। মাদক এমন একটি নেশা যাতে একবার প্রবেশ করলে পরিত্যাগ করা খুবই কঠিন। তাই প্রথমেই মাদকের প্রতি যেন সকলের আলাদা একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। 

মাদক কিভাবে মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে চলে তা সে নিজে জানে না, এমন কি সে নিজে বুঝতে পারে না এবং অপরকে বুঝতে দেয় না। ভয়াবহতা সম্পর্কে সবাই জানি কিন্তু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। এমন একটা অবস্থা সবই হচ্ছে আবার কিছুই হচ্ছে না। প্রতিশ্রুতির মাঝে সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে হাজারো বাঁধা নিয়ে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমাজ ব্যবস্থায় যেসব বাঁধাকে আমরা মোকাবেলা করছি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাদক। সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এর প্রবণতা। মাঝে মাঝে কিছু ধমকা হাওয়ার মতো ব্যবস্থা আবার আগের জায়গায়। এ যেন কাঁনামাছি খেলা। ছোট ছোট মাদক ব্যবসায়ীরা ধরা খেলেও গড ফাদাররা থাকছে বহাল তবিয়তে। বিশেষ করে যুব সমাজ নিমজ্জিত হচ্ছে অন্ধকারের দিকে। ভেঙ্গে যাচ্ছে দেশের চালিকা শক্তি যুব সমাজের মেরুদন্ড। কুফলের দিক জেনেও এক অদৃশ্য শক্তি বশ করছে এ সমাজকে।

প্রতিনিয়তই সুস্থ্য জীবন থেকে সরে যাচ্ছে বহু তরুণ, কিশোর-কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। দেশে কি পরিমাণ মাদকাসক্ত মানুষ রয়েছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। অভিযোগ রয়েছে যে সব কারাগারে মাদকাসক্তদের সাজা দিয়ে রাখা হয় সেখানেও মাদকের বিস্তার চরমে। মাদকের সর্বশেষ যে নামটি সবার মুখে মুখে সেটা হলো ইয়াবা। এই ইয়াবা নামটি এত প্রচারিত হয়েছে যে এখন এটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মতো মনে হয়। মাদক গ্রহণের সাথে সাথে মানুষ সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। পরে শুরু হয় পারিবারিক বিচ্ছেদ। প্রাথমিক অবস্থায় বন্ধু বান্ধবের মাধ্যমে সাধারণত এ যাত্রা শুরু হয়ে থাকে। যার প্রাথমিক সূত্রপাত হতে পারে সিগারেটের মাধ্যমে। এক সময় এসব মাদক কেবলমাত্র ছেলেদের গ্রহণ করতে দেখা যেত। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় মেয়েরাও সমান তালে এগিয়ে চলছে। কিছু দিন পূর্বেও শহরে এসবের ব্যবসা থাকলে বর্তমানে গ্রামে গঞ্জে এর বিস্তৃতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হওয়ার কারনে মাদক অতি সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামে।

পারিবারিক মূল্যবোধ, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং ধর্মীয় চর্চ্চার অভাবের কারণে মাদকের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও কমেছে মানুষের পারিবারিক বন্ধন এবং সামাজিক দায়িত্বহীনতা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে এ পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক দেশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, প্যাথেডিন, বুপ্রেনরফিন, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মান্টেড ওয়াশ, বুপ্রেনরফিন ( বনোজেসিক ইঞ্জেকশন), মরফিন, আইচ পিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টুলইন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন। দেশের যত্রতত্র মিলছে এইসব মরন নেশা। মাদক গ্রহণের কারনে নির্দিষ্ট কোন শ্রেণি ধ্বংস হচ্ছে এটা ভাবা যাবে না। এই মাদকের সাথে সমাজ ব্যবস্থায় যে পঁচন ধরছে তা থেকে প্রভাব পড়ছে সমাজের সকল জায়গায়। তিলে তিলে নষ্ট হচ্ছে ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র। মাদকে আসক্ত করার জন্য মাদকসেবিরা তরুণ-তরণীদের বিনা পয়সায় এসব নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করিয়ে আসক্ত করছে। পরবর্তীতে তারাই এসব নেশার অর্থ যোগান দিচ্ছে।

দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রবেশ করছে এসব নেশা জাতীয় দ্রব্য। গেল কয়েক বছরে যুক্ত হয়েছে আমাদের দেশে আরেক নতুন উপসর্গ রোহিঙ্গা। দেশবাসী তাদের আশ্রয় দেওয়ার সময় সর্বাত্মক সহায়তার হাত নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আস্তে আস্তে সময় অতিক্রান্ত হতে থাকে আর তাদের অন্তরের রুপ প্রকাশ পেতে থাকে। আমাদের দেশে যেসব মাদকের চালান প্রবেশ করছে তার বেশিরভাই এদের দ্বারা সম্পাদন হচ্ছে। এসব অপকর্মের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে আমার দেশের মানুষ। তাই যতদিন এদের দেশে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না ততদিন এদের কঠোর আইনের আওতায় রাখতে হবে। আবার অনেক সময় মাদকাসক্তদের নিয়ে পারিবারিক বা সামাজিকভাবে লুকোচুরি কারণে একদিকে যেমন আসক্তদের চিকিৎসা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে অন্যদিকে মাদকাসক্ত নিয়ন্ত্রণেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও মিলছে না সুফল।

বিভিন্ন বাহিনীর অভিযানে প্রায় সময়ই ধরা পড়ছে ছোট বড় অনেক চালান। সাথে ধরা পড়ছে মাদকসেবি ও ছোট ছোট চালানকারীরা। মাদক দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস, অপব্যবহার ও চোরাচালান প্রতিরোধ এবং মাদকাসক্তের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। ওই আইনের অধীনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এবং এসব অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিনও এসব মামলার অগ্রগতি না হওয়ায় দেখা দিয়েছে মামলার জট। তবে ইতোমধ্যে সকল আদালতে বিচারকার্য করার লক্ষ্যে ‘ মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন)- বিল ২০২০ পাস হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতকে মামলা প্রাপ্তির তারিখ ৯০ কার্য দিবসের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। আর রায় দেওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। ২০১৮ সালের আইনে নেশার বড়ি ইয়াবার উৎপাদন, পরিবহন, বিপণনের জন্য সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডর বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু এ কয়েক বছরে কতটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে মাদক?

মাদক নিয়ে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা তৈরিতে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যেটুকু সচেতনতার কথা বলা হচ্ছে তাও বাস্তবে নেই। মূল কথা হচ্ছে সচেতনতা তৈরির যে প্লাটফর্ম প্রয়োজন সেখানে আমরা যেতে পারছি না এবং যে সচেতনতার কথা বলা হচ্ছে তাও আবার শহর কেন্দ্রিক। তাই গ্রামেগঞ্জে এর প্রভাব দিন দিন দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রামেগঞ্জের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায় অভিভাবকদেরই এ সম্পর্কে ধারণা নেই। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় এতটা চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে যে যেখানে নির্বাসিত হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণের শিক্ষা।

অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২৮ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদক বিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটি কি করছে এর খবর কে নিচ্ছে ? কাগজে পত্রে যেসব কমটি রয়েছে এসব কমিটিকে কাজে লাগাতে হবে। এসব বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বশেষ কথা হলো এ অবস্থা থেকে ফিরে সুন্দর একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন মাদক দ্রব্যের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধের মাধ্যমে সহজলভ্যতা রোধ করা, মাদকের শারীরিক কুফল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, মাদক ব্যবসায়ের সাথে জড়িতদের আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে গ্রেফতার ও দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা, বেকারদের কর্মসংস্থান, প্রতিটি ধর্মের মূল্যবোধ সম্পর্কে অবহিত ও এর বিধি নিষেধ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি এর কুফল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় শক্তিশালী করা এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।

পাঠকের মতামত:

২৯ জুন ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test