E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

গণমাধ্যম সাংবাদিকতা আমার কথা

২০২৪ মে ৩১ ১৬:৪৯:০২
গণমাধ্যম সাংবাদিকতা আমার কথা

আবদুল হামিদ মাহবুব


কি একটা অবস্থা! সর্বত্র কেবল অস্থিরতা দেখি। কারো মাঝে যেনো স্বস্তি নেই। এইসময়ে কোনো কিছুর সাথেই নিজেকে খাপখাওয়াতে পারছি না। হয়ত বয়স হয়ে গেছে, সে কারণেও হতে পারে। আবার এও হতে পারে যে, বছর দুই আগে আমি ঘোষণা দিয়ে, সাংবাদিকতা পেশা থেকে অবসর নিয়েছি। এতো দিনের অভ্যস্থ কাজের মধ্যে নেই বলে আমি চারিদিকে অস্থিরতা দেখছি। আমার বন্ধুরা বলেন সাংবাদিকতা পেশায় নাকি অবসর বলে কিছু নেই। আমি সেই ‘নেই’ টাকে ভাঙতে চেয়েছি। বয়স হয়ে গেলে সাংবাদিকতা পেশা থেকেও অবসর নিতে হয়। আমি অবসর নিয়ে এটা প্রমাণ করেছি। 

আমার এই লেখা সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট লেখা নয়। এটা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বোধ থেকে আনন্দ কিংবা বিষাদগ্রস্ততার প্রকাশ ধরে নিতে হবে। আমি প্রিন্ট মিডিয়া তথা ছাপা পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছি। এখানে আমি কেবল প্রিন্ট নয়, গণমাধ্যমের সকল ধরণের সাংবাদিকতার প্রতি দৃষ্টিপাত করেই কথাগুলো বলছি। প্রিন্ট মাধ্যমে আমার সাংবাদিকতার বসয়স চৌচল্লিশ বছরের। এই দীর্ঘ পুরো সময় রিপোর্টিং বিভাগের অধীনে মফস্বলে থেকে পেশায় সক্রিয় ছিলাম।

সাংবাদিকতাটা আমরা যেভাবে শুরু করেছিলাম, আমার বিবেচনায় এখন আর সেরকম অবস্থানের মধ্যে নেই। আমার অভিজ্ঞতা বলে, সমাজকে কল্যাণকর কিছু দেওয়ার ব্রত নিয়ে এখন কেউ আর সাংবাদিকতা পেশায় আসে না। আসলেও সে টিকে থাকার জন্য বদলে যায়। কিন্তু আমরা এসেছিলাম। বদলাইনি, তবে শেষ দিকে অনেক বিষয়ে আপোষ করতে বাধ্য হয়েছি।

আমরা বলতে এখানে আমি আমার সময়ের সাংবাদিকদের কথা বলছি। আমার সময়ে কিংবা আমার আগে যারা শুরু করেছিলেন তাদের মধ্যে দুই-চারজনের বেশি রিপোর্টিং পেশায় আছেন বলে আমার মনে হয় না।

আগে সংবাদপত্রের মালিকরা পত্রিকা প্রকাশ করতেন একটা লক্ষ্য নিয়ে। কারো লক্ষ্য থাকতো নিজ আদর্শের রাজনীতির বিস্তার, কারো বা জনকল্যাণকর কাজ করতে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরে সেসবের প্রতিকারের পথ দেখানো। কারো কারো ছিলো সাংবাদিক ও সাহিত্য সংস্কৃতিপ্রেমিদের পৃষ্ঠপোষকতা করার বাসনা।

কিন্তু এখনকার সংবাদপত্র বলুন আর টেলিভিশন কিংবা অনলাইন গণমাধ্যম বলুন, সেগুলো যেনো প্রকাশই হয় মালিক পক্ষের বৈধ-অবৈধ পথে কামানো সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তার ‘পাহারাদার’ হিসাবে। আমি এখানে বলে নিতে চাই যে, আমি ঢালাও ভাবে সকল গণমাধ্যমের কথা বলছি না। মফস্বলে এখনো অনেক মহতপ্রাণ মানুষ গাঁটের টাকা খরচ করে কেবল সমাজসেবার লক্ষ্যেই সংবাদপত্র প্রকাশ করছেন। তবে এদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে।

রাজধানীসহ আমাদের দেশের বড় বড় শহরগুলোতে গুটি কয়েক বাদে আর যে সকল সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সম্প্রচার দেখি, আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতার সুবাদে সেগুলোর মালিকদের পরিচয় জানা হয়ে গেছে। এই কারণে আমি সচেতন ভাবে ‘পাহারাদার’ শব্দটি ব্যবহার করে ফেললাম। সম্পদ কামানো গণমাধ্যম মালিকদের উপর যে কোনো বিষয় নিয়ে সামান্য ঝড়-ঝাপটা (আঘাত) আসলেই, নিজেদের গণমাধ্যমকে তারা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেন।

ব্যবসায়ীক প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা রাষ্ট্রের ক্ষমতামান কাউকে ‘সাইজ’ (বেকায়দায় ফেলা) করতে হলে তার মালিকানাধীন গণমাধ্যমকে হাতিয়ার করে সেইজনের পিছনে লাগিয়ে দেন। আর এই কাজগুলো করানো হয় তার গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের দিয়েই। গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের সিঁড়ি করে মালিক পক্ষ কেবলই উপরে উঠে। তাই ছোট করে বললে এভাবে বলা যায়, গণমাধ্যম এখন সাংবাদিকতার জন্য নয়, মালিকদের সম্পদের পাহারার জন্য।

আর এই ‘পাহারাদার’কে পরিচালনা করছেন কারা? উত্তর হচ্ছে; ওই গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা। কিন্তু এই সাংবাদিকরা কি সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকতা করছেন? -না তারা সেটা করতে পারছেন না। তারা করছেন ওই মালিক যা চাচ্ছেন, ঠিক সেটাই। তারা মালিকের আজ্ঞাবাহক হিসাবে কাজ করছেন। তাদের স্বাধীনতা বলতে কিচ্ছু নাই। আর সাংবাদিকের স্বাধীনতা না থাকলে কি সাংবাদিকতা করা যায়? আমি বলি, যায় না। সাংবাদিকতার নামে মালিক পক্ষের ফরমায়েশ পালন হয়, সাংবাদিকতা হয় না। আমার এই মতের সাথে আমার সাংবাদিক বন্ধুদের ভিন্নমত থাকতেই পারে।

তবে আমি আমার সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই; ফরমায়েশি সাংবাদিকতা করে কি আপনারা তৃপ্তি পান? আমি কিন্তু তৃপ্তি পাইনি। আমার সাংবাদিকতার শেষের প্রায় একযুগ একটি কর্পোরেট হাউসের সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার নামে ফরমায়েশ পালন করে কেটেছে। এই সাংবাদিকতায় আমি একদিনের জন্য তৃপ্তি পাইনি। অনেক রিপোর্টিংয়ের জন্য আমাকে বাহবা বাহবা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি ওই রিপোর্টের জন্য নিজেকে নিজে ধিক্কার দিয়েছি। আমার রিপোর্টে মালিকপক্ষ লাভমান হয়েছে। আর প্রান্তিক মানুষ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ। সাংবাদিকতা কি এই হওয়া উচিত? বিবেকের দংশনে কত কতবার যে নীল হয়েছি। কিন্তু কিচ্ছু করার ছিলো না। শেষমেশ বয়স উনষাট পূর্ণ করে ঘোষনা দিয়েই অবসরে এসে গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

আমি জানি এইসব কথাগুলো লেখার জন্য আমার এই লেখা আজ্ঞাবাহক সম্পাদকরা প্রকাশ নাও করতে পারেন। তবে বিবেকমান কোনো সত্যিকারের সাংবাদিকের হাতে পড়লে ঠিকই প্রকাশিত হবে।
সেই যে গ্লানির কথা বলেছিলাম, আসলেই কি গ্লানি থেকে মুক্তি পাচ্ছি? পাচ্ছি নাতো। যার সাথে দেখা হয়, যেখানে যাই, ওই আমাকে সাংবাদিক হিসাবেই সম্বোধন করে, পরিচয়ও করিয়ে দেয়। লেখক হিসাবে দেশব্যাপি আমার আরেকটা পরিচয় আছে। আমি লেখক পরিচয়ে পরিচিতি পেতে চাই। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমার এলাকায় এই পরিচয়টা প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না। হয়ত এই দুঃখ নিয়েই আমাকে একদিন চিরবিদায় নিতে হবে।

আমি কেনো সাংবাদিক পরিচয়ে আর থাকতে চাই না? এতো এতো সাংবাদিক চারিদিকে। কিন্তু সাধারণের কাছে আগের মতো আর সাংবাদিকদের সম্মান নেই। আগে মানুষ সাংবাদিকদের আপন মনে করতো। কাছে পেতে চাইতো। তাদের সুখ-দুখের কথা বলতো। মানুষ বিশ্বাস করতো সাংবাদিকের লেখনিতে তাদের কথাগুলো উপর মহলে যাবে, তাদের সমস্যা লাঘবের পথ হবে।

সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিয়ে গত কয়েক বছরে মানুষের মনে খারাপ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এখন ধারণাটা এমন পর্যায়ে এসেছে যে, মানুষ সাংবাদিকদের মনে করে ধান্ধাবাজ চিজ। ধান্ধা সকলেই করে। কিন্তু এই ধান্ধা শব্দটা মানুষ সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে নেতিবাচক হিসাবে ব্যবহার করে। মানুষেরা মনে করেন, সাংবাদিকরা নিজের ধান্ধা ছাড়া আর কিচ্ছু করে না। এই কথাটা গত দুইদশক ধরে প্রকটভাবে মফস্বলের বেশিরভাগ সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

সাংবাদিক পরিচয়ে কোনো মানুষের সাথে কথা বলতে চাইলে, সে মানুষ মানে মানে কেটে পড়ে। কোনো অফিসে গিয়ে কর্মচারী-কর্মকর্তার কাছ তথ্য নিতে চাইলে, তারাও সাংবাদিকদের পাশ কাটিয়ে যান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেছি চেয়ার ছেড়ে উঠে সরে পড়তে। কেউ কেউ বলেন, ‘তথ্য অধিকার আইনে চেয়ে নেন’। এই আইনে তথ্য পেতে যে সময় যায়, তাতে আর ওই নিউজ করার মতো পরিস্থিতি থাকে না। তবে দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের কথা আলাদা।

দীর্ঘ সাংবাদিকতার সুবাদে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিটা অনেক বড়। বলতে শুরু করলে অনেক অপ্রিয় সত্য কেবল বলেই যাবো। সেসব থাক আমার স্মৃতিতে। কখনো স্মৃতি কথা লিখতে না হয়, সবকথা লেখা যাবে।

লেখক: সাংবাদিক, লেখক, ছড়াকার ও সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।

পাঠকের মতামত:

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test