E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

কাজলা নদী পাড়ের প্রতিবন্ধী গোপীর সংগ্রামী জীবনের করুণ গল্প

২০২৫ এপ্রিল ২১ ১৯:০১:১১
কাজলা নদী পাড়ের প্রতিবন্ধী গোপীর সংগ্রামী জীবনের করুণ গল্প

রূপক মুখার্জি, নড়াইল : জন্ম থেকেই একটি পা অচল গোপী বিশ্বাসের (৩২)। হাটা-চলা করতে হয় লাঠি ভর দিয়ে। ছোটবেলা থেকেই চেষ্টা করেছেন আত্মনির্ভরশীল হওয়ার। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখন ইলেকট্রনিক পণ্যের মেরামতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।

নড়াইল সদর উপজেলার মুলিয়া ইউনিয়নের কাজলা নদীর পশ্চিম তীরের পানতিতা গ্রামের বাসিন্দা গোপী। বাবা নিতাই বিশ্বাস ও মা কল্পনা বিশ্বাসের তিন সন্তানের মধ্যে তিনি সবার ছোট। গরীব পরিবারে জন্ম নেওয়ায় পড়াশোনার সুযোগ হয় নাই। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর স্কুল ছাড়তে হয় তাকে।

ছোটবেলায়ই এলাকার এক দোকানে সহকারী হিসেবে কাজ শেখা শুরু করেন গোপী। টর্চ লাইট, গ্যাস লাইটসহ নানা বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র মেরামতের কাজ রপ্ত করেন তিনি। প্রায় ১৮ বছর ধরে এই পেশায় রয়েছেন। কিন্তু একটানা এই পেশায় টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। আয় কম হওয়ায় মাঝে মাঝে ভ্যান চালানো, চা বিক্রি, এমনকি ওয়েল্ডিংয়ের কাজও করতে হয়েছে তাকে। তবে প্রতিবন্ধকতা থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।শেষমেশ আবারও মেরামতের পেশায় ফিরেছেন তিনি।

জেলা শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে মুলিয়া বাজারের দক্ষিণ পাশে, মুলিয়া-বাহিরগ্রাম সড়কের এক পাশে ছোট একটি একচালা দোকান বসিয়েছেন। টিনের ছাউনি থাকলেও চারপাশে কোনো বেড়া নেই। সেখানেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বসে টর্চ লাইট, গ্যাস লাইট, এলইডি বাল্ব, স্প্রে মেশিন ও রাইস কুকারসহ নানা ইলেকট্রনিক সামগ্রী মেরামত করেন গোপী।

চার সদস্যের পরিবার গোপীর ঘাড়ে। স্ত্রী, এক শিশু পুত্র এবং এক কন্যা সন্তান নিয়ে তার সংসার। বড় মেয়েটি বর্তমানে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। প্রতিদিন কাজ করে আয় হয় মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। ভালো দিন হলে ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। কিন্তু বর্তমান বাজার দরে এই টাকায় সংসার চালানো সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে ব্যাগে যন্ত্রপাতি ভরে এক পায়ে সাইকেল চালিয়ে পাশের তুলারামপুর হাটেও যান কাজের খোঁজে।

একান্ত আলাপকালে গোপী বিশ্বাস বলেন, আজ একটু হলুদ কিনি, কাল একটু লবণ। ছেলেমেয়েকে মাছ খাওয়াতে পারি না। দেনা করে বাজার করতে হয়। তিন মাস পর প্রতিবন্ধী ভাতার কিছু টাকা পাই, তাও দেনা শোধে চলে যায়।

অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তিনি আরোও বলেন, 'প্রতিবন্ধী জীবনটাই যেন অভিশাপ। সংসার চালাবো, না ছেলেমেয়েকে মানুষ করব—এই দুশ্চিন্তায় থাকি। সরকারের কাছে অনুরোধ, যেন আমাদের মতো মানুষদের পাশে দাঁড়ায়, আমাদের সন্তানরা মানুষ হতে পারে, সেই ব্যবস্থা করে। ওরা মানুষ হলে আমাদের কষ্টের কিছুটা হলেও সার্থকতা থাকবে''।

গোপীর কাজের প্রশংসা করেন স্থানীয়রাও। তারা জানান, তার মতো অভিজ্ঞ মেরামতকারীর কাজের ওপর অনেকেই নির্ভরশীল। তিনি না থাকলে এসব কাজের জন্য শহরে যেতে হতো, সময় ও অর্থ ব্যয় হতো বেশি।

গোপীর দোকানে লাইট মেরামত করতে আসা মিলন সরকার বলেন, 'গোপীর কাজের মান ভাল হাওয়ায় তার নিকট আমরা ইলেকট্রনিক বিভিন্ন জিনিস মেরামত করতে আসি। তার কষ্ট দেখে খারাপ লাগে, কিন্তু আমরা নিজেরাও খুব বেশি কিছু করতে পারি না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই খুপড়ি ঘরে বসে ইলেকট্রনিক যন্ত্র মেরামত করে সংসার চালায় সে। ভাবতে অবাক লাগে !

কোড়গ্রামের বাসিন্দা বিকাশ রায় বলেন, 'গোপী দীর্ঘদিন ধরে এই বাজারে কাজ করছে। ভালো মানুষ, ভালো কাজও করে। আমরা তার ওপর ভরসা করি। যদি সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই সংগ্রামী মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে হয়তো গোপীর মতো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবন আরেকটু সহজ হয়ে উঠতো, জীবনযাপনের চিত্রও পাল্টে যেতো।

(আরএম/এসপি/এপ্রিল ২১, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

২১ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test