E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

চাকায় ঘোরে ভাগ্যের চাকা

২০২৪ অক্টোবর ২৮ ১৯:৫৩:০৬
চাকায় ঘোরে ভাগ্যের চাকা

শেখ ইমন, ঝিনাইদহ : সাপের মতো আঁকাবাঁকা গাঁয়ের পথ। শেষ বিকেলের মরে যাওয়া আলোয় ধুলো উড়িয়ে চলছে একটি ছইওয়ালা গরুর গাড়ি। সন্ধ্যার আগেই গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। গাড়োয়ান বারবার তাগাদা দিচ্ছে বলদজোড়াকে, ‘হুররররর...হাঁট হাঁট।’ ক্লান্তি মানুষের মতো গরুও আছে। সেই কাকভোর থেকে একটানা হেঁটে চলেছে। একটু ঢিল দেওয়ার জো নেই। গতি কমালেই গাড়োয়ানের লাঠির শপাং শাপাং বাড়ি পড়বে পিঠে। ছইয়ের ভেতরে শিশুছেলাটাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন গাঁয়ের বধূ। চোখে মুখে তার রাজ্যের উৎকণ্ঠা,সময়মতো পৌঁছাতে পারবে তো?

ছেলেটারও বিরক্তি এসে গেছে একঘেয়ে পথচলায়। মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠে বিরক্তি প্রকাশ করছে সে। তবুও চলার যেন শেষ নেই। গাড়ির চাকায় কর্কশ শব্দ, যেন বিরামহীন পথচলায় সে প্রতিবাদ করছে। কাল্পনীক এ গল্পের মতই গ্রাম প্রধান এ দেশের একসময়ের চিত্র ছিল এমন।

দেশে চাকার তৈরী বাহনই ছিল কৃষিপন্য, বিয়ের অনুষ্ঠান বা রোগ-বালাইয়ে ডাক্তার-হাসপাতালে যাতায়াতের একমাত্র বাহন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে চাকার আবিষ্কারকে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে ধরা হয়। শিল্প-সাহিত্যেও জায়গা করে নিয়েছে চাকা। প্রখ্যাত নাট্যকর ও গবেষক সেলিম আল দীন চাকা নিয়ে তৈরী করেছেন নাটকও। কদর থাকায় চাকা তৈরীর কারিগররা ভাল উপার্জন করে স্বাচ্ছন্দে জীবন-যাপন করত। তবে কালের বিবর্তনে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে এসব চাকার তৈরী বাহন। এখন উন্নত রাস্তা-ঘাট আর প্রযুক্তির কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে এই শিল্পের সাথে জড়িতরা। আর কারিগররাও ছাড়ছেন তাদের বাপ-দাদার আমলের পেশাটি।

কাঠের চাকা তৈরীর একমাত্র উপকরন বাবলা গাছের সহজ লভ্যতার কারনে ঝিনাইদহের শৈলকুপা-গাড়াগঞ্জ সড়কের ওয়াপদার পাশে রাস্তার দু’ধারে ছোট ছোট টিনের ঘরে গড়ে ওঠে গরু,মহিষ ও ঘোড়ার গাড়ির চাকা তৈরীর কারখানা। এ কারখানায় চাকা তৈরি করেন ইলিয়াস উদ্দিন ও সদর আলী নামে দুই কারীগর। তাদের দু’জনার বাড়ি রাজশাহীর চাপাইনবাবগঞ্জের ফাটাপাড়া গ্রামে। পরিবার সেখানে থাকলেও পেশাগত কারণে এখানকার ঝুঁপড়ি ঘরেই থাকেন তারা। কাজের চাপ কম থাকলে বাড়িতে যান। সময় দেন পরিবারের সাথে।

কারীগর ইলিয়াস উদ্দিন জানান, ‘আগে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ জোড়া চাকা বিক্রি হলেও কালের বিবর্তণে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩-৪ জোড়ায়। ভরা মৌসুমে (অগ্রহায়ন ও চৈত্র মাস) কাজের চাপ থাকলে ২ দিনেই তৈরি করেন প্রতি জোড়া চাকা। প্রতি জোড়ায় প্রায় ৮ ফুট (সিএফটি) বাবলা কাঠ লাগে। তা কিনতে খরচ হয় প্রায় ৪ হাজার ৮’শ টাকা। আর চাকা তৈরির পর প্রতিজোড়া বিক্রি করেন ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা।

তিনি জানান, এ থেকে প্রতি মাসে আয় করেন প্রায় বিশ হাজার টাকা। এই রোজগার দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলেকে পড়ালেখা করাচ্ছেন। অন্য ছেলে স্থানীয় একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজ করছে।’

কারীগর ইলিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘কাজ না থাকলে বাড়িতে গিয়ে চাষাবাদ সহ অন্যান্য কাজ করি। নাহলে সংসার চলে না। এত অল্প রোজগারে কিভাবে সংসার চলবে?

আরেক কারিগর সদর আলী বলেন, ‘বর্তমানে চাকার চাহিদা অনেক কম। পাকা রাস্তাঘাট আর প্রযুক্তির ছোয়ায় গরু-মহিষের চাকার কদর নেই। পাট কাটা পড়লে এ চাকার কদর কিছুটা বাড়ে। কাদার মধ্যে অন্য গাড়ি যেতে না পারায় মাঠ থেকে পাট আনার জন্য গরু বা মহিষের গাড়ি প্রয়োজন হয়। তখন গাড়িওয়ালা পুরাতন বা ভেঙে যাওয়া চাকা বাদ দিয়ে আমাদের কাছ থেকে নতুন চাকা লাগায়। প্রতিবছর অগ্রহায়ন ও চৈত্র মাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এসময়টায় চাকার চাহিদা বাড়ে, রোজগারও বেশি হয়। তা দিয়েই কোনরকমে চলে সংসার। চাকা তৈরি করে বিক্রি করতে না পারলে সংসার চলে না। প্রতিবছর অগ্রহায়ন ও চৈত্র মাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তবে কয়েক বছরের মধ্যে গরু-মহিষের গাড়ি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’

স্থানীয় আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘একসময় রাস্তা-ঘাট খারাপ থাকার কারণে গরু ও মহিষের গাড়ির কদর ছিল। এই গাড়িতে মানুষ বিয়ে করতে যেত। মাঠ থেকে ফসল আনা,বাজারে তোলা এমনকি মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল এই গাড়িগুলো। সেইসময় গাড়ির চাকা তৈরির কারিগরদের সবসময় ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা কাজ করতো তারা। কিন্তু বর্তমানে রাস্তাঘাটের উন্নতির কারণে নানারকম ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের দাপটে গরু ও মহিষের গাড়ীগুলো বিলুপ্তির পথে। যার কারণে চাকা তৈরির কাগিগররা অনেক কষ্টে আছে।’

স্থানীয় যুবক তারেক রহমান বলেন, ‘বাপ দাদ দেও কাছে গরু বা মহিষের গাড়ির কথা অনেক শুনেছি। ছোটবেলায় এই গাড়ি দেখলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। শুধুমাত্র মাঠ থেকে ফসল বাড়িতে আনা ছাড়া অন্য কোন কাজ করা হয়না এই গাড়িগুলো দিয়ে। ফলে এই চাকা তৈরির সাথে যারা জড়িতত তাদের কাজ কমে গেছে, সাথে উপার্জনও। কাজ না থাকায় সারাদিন বসে থাকতে দেখি। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।’

(এসআই/এসপি/অক্টোবর ২৮, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

২১ নভেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test