৭ নভেম্বরে নিহত কর্নেল হুদার কাছেই ভাটিয়াপাড়ার পাকিবাহিনী আত্মসমর্পণ করে
আবীর আহাদ
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানে বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম ও কর্নেল এটিএম হায়দার বীরউত্তমের সঙ্গে যে কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীরবিক্রম নিহত হয়েছিলেন- সেই হুদাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের অন্যতম সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এন হুদা। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানায় অবস্থিত ভাটিয়াপাড়া পাকিঘাঁটির বিপুলসংখ্যক সৈন্য ও রাজাকাররা একাত্তরের ১৯ ডিসেম্বর এই মেজর হুদার কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিলো।
কর্নেল কে এন হুদার আরেকটি ঐতিহাসিক পরিচয় ছিলো। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন হিশেবে চাকরি করার সময় বঙ্গবন্ধুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে সশস্ত্র পন্থায় স্বাধীন করার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয়সূত্রে, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভগ্নিপতি প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা এটিমএম সৈয়দ হোসেনের সাথে ক্যাপ্টেন হুদার এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সূত্রে ১৯৭০ সালের প্রথমদিকে ক্যাপ্টেন হুদার সাথে আমারও পরিচয় ঘটেছিলো।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষদিকে কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে একদিন ক্যাপ্টেন হুদার সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। আমার এক কাকা তখন মিশনের প্রেসবিভাগের একজন কর্মকর্তা আলীমুজ্জামানের কক্ষে বেশ কিছুদিন, বলা চলে, হুদাভাই ও আমি প্রায় প্রতিদিন একসঙ্গে কাটিয়েছি। সেই থেকে তাঁর সাথে আমার একটি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা তাঁর নিহত হওয়ার পূর্বপর্যন্ত অটুট ছিলো।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ-ভারত যৌথকমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও, ভাটিয়াপাড়ার পাকিবাহিনী ভয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে বলে গো ধরে বসে থাকে। কিন্তু আমরা অনড়। আমরা চাই, আমাদের কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হবে। তারা বিগত ন'মাসব্যাপী আমাদের এ-অঞ্চলে যে পৈশাচিক কর্মকাণ্ড করেছে, তার প্রতিশোধ তো নিতে হবে। কিন্তু বিশাল এলাকা জুড়ে মাটির তলে তারা কংক্রিটের বাঙ্কার খুঁড়ে তার মধ্যে অবস্থান করায় আমাদের পক্ষে সহজে তাদের হঠানো সম্ভব ছিলো না। অপরদিকে দেশ যেহেতু মুক্ত হয়ে গিয়েছে, সে-ক্ষেত্রে যশোর থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে ডাকলেও তারা আসবে না। ভাটিয়াপাড়ায় বিশাল অস্ত্রভাণ্ডারসহ খাদ্যশস্যভর্তি একটি এলএসডি গুদাম ছিলো পাকিদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে তারা গো-ধরে বসে থাকে। ফলশ্রুতিতে আমরাও উপায় খুঁজতে থাকি যে, কী উপায়ে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করানো যায়।
ভাটিয়াপাড়া এলএসডির উত্তরপাশে বারাশিয়া নদীর পাড়ে আফম হাফিজুর রহমানের মুজিববাহিনী ও আমার সি-ইন-সি স্পেশাল বাহিনীর যৌথ অপারেশন সেন্টার ছিলো। অপারেশন সেন্টারে বসে ১৮ ডিসেম্বর সকাল বেলা আমি ও হাফিজ সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আজ বিকেলে আমি চারজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নড়াইল যাবো। আমরা খবর পেয়েছিলাম যে, নড়াইলে নাকি একজন অফিসারসহ আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈন্য অবস্থান করছেন। মূলত: তাদের সাথে পরামর্শ করে কিছু করা যায় কিনা সে-বিষয়ে আলোচনা করার জন্যই আমাদের সেখানে যাওয়া। মধুমতি পার হয়ে প্রায় ১০/১২ মাইল পায়ে হেঁটেই আমরা রাত ন'/দশটা নাগাদ নড়াইল পৌঁছি। সেখানে কোনো কমিশনড অফিসার পেলাম না। হাবিলদার মজিদের কাছে জানতে পারি, সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর হুদা যশোরে অবস্থান করছেন। হাবিলদার মজিদ ওয়ার্লেসে মেজর হুদার সাথে আমাকে যুক্ত করে দিলে আমি মেজর হুদাকে সার্বিক পরিস্থিতি অবগত করি। তিনি আগামীকাল ১৯ ডিসেম্বর সকালে ভাটিয়াপাড়া আসতে সম্মতি দেন। ঐ রাতেই আবার আমরা পায়ে হেঁটে ভাটিয়াপাড়া ফিরে আসি।
১৯ ডিসেম্বর সকাল এগারোটায় মেজর হুদা ভাটিয়াপাড়া আসেন। আমার অপারেশন সেন্টারে হালকা নাস্তা সেরে, ভাটিয়াপাড়া পাকিঘাঁটি ঘিরে-থাকা প্রায় তিন/চার শতাধিক মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রক প্রায় আট/ দশজন অধিনায়কের সাথে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে সবাইকে যার যার অবস্থানে ফিরে যেতে বললেন। আগে-থেকে আমাদের কাছে ধৃত পাকিসৈন্য খিজির খানের কাছে তিনি একটি চিঠি দিয়ে পাকিঘাঁটির প্রধান মেজর শওকত হায়াত খানের প্রতি বিকেল তিনটার মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলেন।
বিকেল পৌনে দু'টায় মেজর শওকত হায়াত খান একটি ফিরতি চিঠি দিয়ে মেজর হুদাকে তাদের ক্যাম্প-হেডকোয়ার্টার ওয়ারলেস সেন্টারে আত্মসমর্পণ বিষয়ে আলোচনার আমন্ত্রণ জানায়। অসীম সাহসী মেজর হুদা একাই সেখানে যেতে উদ্যত হলে আমি তাঁর হাত চেপে ধরি বলি, আপনাকে একা যেতে দেবো না। আমিও আপনার সঙ্গে যাবো।' মেজর হুদা একটু মুচকি হেসে বললেন, চলো।
মেজর হুদা একটা এসএমজি কাঁধে ঝুলিয়ে আমাকেও আমার এসএলআর কাঁধে ঝুলিয়ে নিতে বললেন। তারপর পাকিসৈন্য খিজির আগে আগে পথ চিনিয়ে আমাদের নিয়ে চললো। আমাদের পেছনের মুক্তিবাহিনীকে যার যার অবস্থানে পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে বলা হলো।
আমরা প্রায় পনেরো মিনিটের মধ্যে শত্রুর মূল ঘাঁটিতে পৌঁছে গেলাম। যাওয়ার পথে আমরা লক্ষ্য করি, বিভিন্ন বাঙ্কার থেকে পাকিসৈন্যরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে বসে আছে। মেজর শওকত হায়াত খান আমাদের স্বাগত: জানায়। সে আমাদের সাথে করমোদন করে। মেজর হুদার পাকিস্তান বাহিনীর পূর্বতন ক্যাপটেনের পরিচয় পেয়ে মেজর শওকত বেশ খুশি ও আস্থাশীল হয়। আমার মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় পেয়ে সে কৌতুহলের হাসি হাসে। বলে, তুম এতনি ছোটি হ্যায়! তারপর আমার একটা হাত ধরে ছলছল চোখে বলে, I have a little brother like you !
মেজর শওকত হায়াত খান আমাদের চা পান করায়। তারপর শুরু হলো আত্মসমর্পণের বিষয়টি। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী মেজর হুদা ও মেজর শওকত আত্মসমর্পণ চুক্তিতে পরস্পর স্বাক্ষর করেন। মেজর শওকত হায়াত মাইকে তার সৈন্য ও রাজাকারদের যার যার অস্ত্রসমেত ওয়ারলেস চত্বরে এসে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেয়। অপরদিকে মেজর হুদা আমাদের মুক্তিবাহিনীকে চারদিক থেকে উঠে আসার নির্দেশ দেন।
আধা ঘন্টার মধ্যে পাকিবাহিনী ও রাজাকারদের ঘেরাও করে আমাদের মুক্তিবাহিনী তাদের অস্ত্রগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। অস্ত্র সমর্পণের এক পর্যায়ে এক পাকিসদস্য 'হাম সারেন্ডার নেহি করেগা' বলেই নিজের মাথায় চাইনিজ রাইফেল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করে।
মেজর খন্দকার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে এভাবেই ভাটিয়াপাড়ার পাকিসৈন্যদের আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে এ-অঞ্চলের সর্বশেষ পাকিঘাঁটির চূড়ান্ত পতন ঘটে।
লেখক :মুক্তিযোদ্ধা লেখক গবেষক, চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।
পাঠকের মতামত:
- ‘নয়া দামান’ খ্যাত তসিবা এবার গাইলেন ‘নয়া বাতাস’
- শ্রীপুরে নাকোল ইউনিয়ন কৃষক দলের কৃষক সমাবেশ
- সোনারগাঁয়ে কিশোরী ধর্ষণ, গ্রাম্য সালিশে ১৩ লাখ টাকায় রফাদফা
- কুষ্টিয়ায় নারী পুলিশের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
- নিখোঁজের ৪৩ ঘন্টা পর কর্ণফুলি নদীতে ভেসে উঠলো নিখোঁজ দুই পর্যটকের লাশ
- ফরিদপুরে চিকিৎসকের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় মামলা, গ্রেফতার ৩
- ফিরলেন বাবর, বাদ পড়লেন শফিক
- ‘পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার আর দেশে ফিরে আসতে পারবে না’
- কাজাখস্তানে প্লেন দুর্ঘটনায় ৩৮ জন নিহত
- রেষারেষি বন্ধ করে ইজতেমা বহাল রাখতে সরকারকে আইনি নোটিশ
- পাঁচ দিন বন্ধ থাকবে ন্যাশনাল ব্যাংকের লেনদেন
- আবাসন মেলায় বুকিং দিলেই বিশেষ ছাড়
- মুম্বাইয়ে ১৭ বাংলাদেশি আটক
- ‘সচিবালয়ে আগুন নাশকতা কিনা, তদন্তের পর বলা যাবে’
- সেতু মন্ত্রণালয় থেকে বাদ যাচ্ছে ১১১৮৬ কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় ব্যয়
- গাজায় হাসপাতালের কাছে ইসরায়েলি হামলা, ৫ সাংবাদিক নিহত
- 'গণহত্যার বিচার করতে ট্রাইব্যুনাল গঠন করুন'
- চাঁদপুরে চাঞ্চল্যকর ৭ খুন : গ্রেফতার ইরফান ৭ দিনের রিমান্ডে
- পঞ্চগড়ে শুরু হলো ষড়ঋতু ব্যাডমিন্ট টুর্নামেন্ট
- কাজাখস্তানে যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত
- ৭ জানুয়ারি লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া
- নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যা জানালেন সিইসি
- ভারত থেকে দেশে আসছে ২৪ হাজার টন চাল
- ঝালকাঠি সাংবাদিক সংস্থার নতুন কমিটি
- দেবহাটায় মামলার সাক্ষী হওয়ায় বাড়িতে হামলা ভাঙচুর লুটপাট, স্ত্রীকে কুপিয়ে জখম
- সোনালী ব্যাংক: এসএমএসে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চুক্তি!
- শুক্রবার ছাত্রলীগ নেতা চয়নের কুলখানি
- মিতা চক্রবর্তী
- বঙ্গ মনীষীদের রঙ্গ : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
- কুড়িগ্রামে হচ্ছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
- করোনায় আরও ৩৫ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ২৩১৬
- হিন্দু সেজে রাস পূর্ণিমার পূজা ও পূণ্যস্নানে যেতে প্রতারণা, ৫ যুবক কারাগারে
- উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে বকুল
- আগৈলঝাড়ায় থানা প্রশাসনের উদ্যোগে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ পালিত
- অনন্য সংগঠন শারদাঞ্জলি ফোরাম বাংলাদেশ
- মোংলায় ৫ নারী পেলেন জয়িতা সম্মাননা
- করোনায় উত্তাপ নেই কামারের হাপরে
- চুয়াডাঙ্গা পৌর নির্বাচন উপলক্ষে মেয়রপ্রার্থী টোটন এর সাথে জেলা গনমাধ্যম কর্মীদের মতবিনিময়
- ছাতকে ২২ লাখ টাকার ওএমএসের চালসহ আটক ২
- ভাইস চেয়ারম্যান হতে চান সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মারুফ
- একুশে পদক পাচ্ছেন ২১ বিশিষ্ট নাগরিক
- সরকারি ২০ বিঘা জমি ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড নিয়ে তোলপাড়
- ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আর আ.লীগের সম্পাদকই চালাচ্ছে কর্ণফুলী যুবলীগ!
- মালদ্বীপে বাংলাদেশ মিশনে বঙ্গমাতার ৯৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন
- ‘২৮ অক্টোবর জানান দিয়েছিল ক্ষমতায় এসে খুন-গুমের রাজ্য কায়েম করবে’