E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বঙ্গবন্ধুর স্নেহধণ্য আগরতলা মামলার স্টুয়ার্ড মুজিব একটি অনন্য নাম

২০২৩ জানুয়ারি ০৪ ১৭:১৮:৩৬
বঙ্গবন্ধুর স্নেহধণ্য আগরতলা মামলার স্টুয়ার্ড মুজিব একটি অনন্য নাম

বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম


৬০ এর দশকে পাকিস্তানের সাজানো আগরতলা মামলার অন্যতম মহান ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহযোগী ৩৫ জনের সারিতে স্টুয়ার্ড মুজিব ৩ নং তালিকাভুক্ত একজন অগ্নিপুরুষ। ভরা যৌবনের উষালগ্ন থেকে স্টুয়ার্ড মুজিব একজন আপোষহীন প্রতিবাদী ব্যক্তিত্বের পথচলায় ছিলেন অবিচল। পাকিস্তান নেভীতে চাকুরীরত অবস্থান বাঙালির অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করে পশ্চিমাদের বৈষম্যমূলক শাসনের বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসার প্রত্যয় মনোবলে বলিয়ান ছিলেন স্টুয়ার্ড মুজিব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সশস্ত্র যুদ্ধে তিনি একজন বলিষ্ঠ, সাহসী ও উচ্ছ্বল স্ফুলিঙ্গের মূর্ত প্রতীক। মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যদের সাথে তার বহুধা ভূমিকা মুক্তির আধারকে আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলেছিল। 

স্বাধীনতাযুদ্ধে জীবন বিসর্জন ত্যাগ, তিতিক্ষা ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ হযয়েছেন স্মরণীয় ও বরণীয়। ঐ সকল বরণীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে জাতীয় স্বীকৃতি পেয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ইতিহাসে হয়েছেন চির জাগত ও গর্বোচ্ছল, তাদের সারিতে স্বাধীনতা পিপাসু স্টুয়ার্ড মুজিব এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তার অবদান ও ত্যাগের কোন স্বীকৃতি জাতীয় পর্যায়ে অদ্যাবধি দৃশ্যমান নয়। তিনি হারিয়ে গেছেন নাম না জানার ভীড়ে ঘুরে ফিরে প্রতি বছরে ৫ই জানুয়ারী স্টুয়ার্ড মুজিবের অর্ন্তধান দিবস" স্মরণে তার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের মানসপটে জেগে উঠে বেদনাহত স্মৃতি যা আমরা ভুলতে পারি না, ভোলার নয়, স্মৃতিতে দ্বিপ্তিময়। মাদারীপুরের কৃতি সন্তান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী স্টুয়ার্ড মুজিব এর আদিবাস মাদারীপুর সদর উপজেলার রাস্তি ইউনিয়নের লক্ষ্মীগঞ্জ গ্রামে।

কোন এক সময় ঐ গ্রামের পূর্ব সীমানা দিয়ে প্রবাহিত খরস্রোতা আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গনে ঐ এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং স্টুয়ার্ড মুজিব এর বাবা ঐ গ্রাম হেড়ে ঘটমাঝি ইউনিয়নের ঘটমাঝি গ্রামে বসবাস শুরু করেন। এখান থেকে প্রাইমারী স্কুল শেষ করে মুজিব চরমুগরিয়া মার্চেন্ট হাইস্কুলে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশোনা অবস্থায় তিনি পাকিস্তানী নেভীর অফিসপার এম এ খান সাহেবের সাথে যোগাযোগ করেন। ঘটমাঝি ইউনিয়নের খাগদী গ্রামে লে. কমান্ডার এম.এ খান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানী সেনা ও নৌ সেনা ও নৌবাহিনীর রিক্রটিং অফিসার থাকাকালে মুজিবকে পাকিস্তান নেভীতে ১৯৫৮ এর প্রথম দিকে ভর্তি করেন। মুজিব পাকিস্তান নেভাল ট্রেনিং সেন্টার করাচী পি.এন এস বাহাদুর এ ট্রেনিং শেষ করে পি এন এস মনোরাতে বদলি হন। এখানে থাকাকালীন পাকিস্তানী সাথীদের সাথে হরহামেশা তার তর্ক-বিতর্ক ও মনোমালিন্য লেগে থাকত, যেহেতু পশ্চিমারা বাঙালিদেরকে সর্বদায় আড়চোখে নানা সমালোচনায় মানসিকভাবে আঘাত করত।

অচিরেই স্টুয়ার্ড মুজিব মাদারীপুরের জয়নাল, হায়দার, খন্দকার হাশেম ও সীম্যান সুলতান, আরো কিছুসংখ্যক নাবিক নিয়ে একটি কল্যান সমিতি গড়ে অতি সন্তর্পনে তৎপড়তা শুরু করে। ধীরে ধীরে সেনানো ও বিমানবাহনীর বাঙ্গালি সদস্যরা মিলে কল্যান সমিতিকে পুষ্ট করে তোলে। স্বাধীন চেতনা স্টুয়ার্ড মুজিব বাঙালির অধিকার আদায়ের একজন প্রত্যয় ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তখন পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফাপ কর্মসূচির আন্দোলনের ডামাডো তুঙ্গে। পাকিস্তানী সাময়িক সদস্য বাঙালীদের সমিতির তরফ থেকে আওয়ামী লীগের সাথে যোগাযোগের সেতুবন্ধন সৃষ্টি হয়। স্টুয়ার্ড মুজিব সার্জেন্ট জহিরুল হক লে. কমান্ডার মুয়াজ্জেম এর জানাজায় এবার স্টুয়ার্ড মুজিব সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নাইট পাস নিয়ে করাচি থেকে প্লেনে করে পূর্ব পাকিস্তান এস বঙ্গন্ধুর সাথে দেখা করে আবার করাচি ফিরে যান। করাচী এয়ারপোর্টে রাস্ত্রি বেলায় নেমে মনোরাতে যেতে যেতে রাত্র একটু গভীর হয়। পোর্টে গিয়ে দেখেন তার শীপ সমুদ্রে নোঙর করে আছে। তিনি চিন্তা কি করা যায়, অতঃপর পোর্টের গার্ডকে ম্যানেজ করে নিজের গায়ের পোষাক খুলে তার কাছে রেখে সাঁতার কেটে শীপে উঠেন এবং বাঙালি সাথীদের সহায়তা ঝামেলামুক্ত হয়ে ফ্রেশ হন এবং তার উপরস্থ অফিসারের সাথে দেখা করেন।

ইতিমধ্যে সাথীদের সহ তার পিছনে গোয়েন্দা লেগে যায়, একই ধারাবাহিকতায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর সাথে স্টুয়ার্ড মুজিব আরো কয়েককজন বাঙালি অফিসার সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য ঐ মামলায় জড়িয়ে পডড়েন। ব্রিটিশ শাসনামলে (১৮৫৮-১৯৪৭) অপশাসনের চক্রে ভারত উপমহাদেশে তাদের উদারনৈতিক রাজনীতির খেলায় সাধারণ জনগণ ছিল নিপীড়িত, বঞ্চিত ও শোষিত। কালের প্রবাহে ঐ শ্রেণী গোষ্ঠী স্বীয় চেতনার জাগরণে স্বাধীকার আন্দোলনে সর্ব হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে ১৯৪৭ সালে আগষ্টে পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চল) ও ভারত নামক দুটি দেশকে ভৌগলিক হাজার মাইল দূরত্বে ফেলে এক অবাস্তব ও অসম অবস্থানে মেঘমালার আবর্তে নব ঝান্ডা দিয়ে ব্রিটিশদের প্রস্থান। শুরু হলো পাকিস্তানী শাসনামল (১৯৪৭-১৯৭১) এ আমলে প্রাদেশিক শাসন ব্যাবস্থায় পশ্চিমারা পূর্ব অঞ্চলকে নানা দিক দিয়ে দুর্বল ও হেয় প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে ছিল লিপ্ত। তাদের দ্বিমাত্রিক আচরণ অর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রত্যাশিত প্রাপ্তি থেকে এ অঞ্চলের জনগণ বঞ্চিত ও কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামোর বেড়াজালে এদেশবাসীকে নিয়ে চলে রাজনৈতিক খেলা।

এক সময় পূর্ব অঞ্চল জাতীর মধ্যে ক্ষোভ ও ক্রোধের রক্তক্ষরণে অচিরেই স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম আন্দোলনের বহিঃ প্রকাশ ঘটে এবং বাঙালির স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের ভাবনা স্পষ্টরূপ ধারণ করে। অনেক চড়াই উৎরাই পার হবে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। ৬ দফা দাবী আদায়ের ঘোর আন্দোলনে দেশের আপামর ছাত্র জনতা মিলে মিশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এগিয়ে চলে। ১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারী পাকিস্তানী সাময়িক জান্তা সরকার শেখ মুজিবর রহমানকে ১ নং লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে ২ নং এবং স্টুয়ার্ড মুজিবকে এবং আসামী করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। অচিরেই এ সকল ব্যক্তিবর্গ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়, এতে বাঙালিরা প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অতঃপর ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের চাপে পাকিস্তানী সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে স্টুয়ার্ড মুজিব ঐ বছর শরীয়তপুর জেলার আঙ্গাবীয়ায় রুদ্রকর গ্রামের হাসমত আলীর মেয়ে সুলতানাকে বিয়ে করেন।

স্বাধীনতা পাগল স্টুয়ার্ড মুজিব মুক্তিযোদ্ধার অগ্নী ভূমিকায় সোচ্চার হয়ে ওঠেন এবং মাদারীপুরের ক্যাপ্টেন সওকত আলী সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই দুই নেতা শলা পরামর্শ করে মাদারীপুরে প্রথমত নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে যুবকদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেন। এতে তরুণদের মধ্যে বেশ আলোরণ দেখা দেয়, তারা উজ্জীবিত হয়ে এ প্রশিক্ষনে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১৭ ই এপ্রিল সর্বপ্রথম স্টুয়ার্ড মুজিব মাদারীপুর থেকে ১৬৫ জনের একটি দল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং গ্রহণের জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। লং যোগাযোগে চাঁদপুরের নীলকমল পৌঁছে পায়ে হেঁটে রায়পুর হয়ে দলটি নিয়ে স্টুয়ার্ড মুজিব চৌমুহনী দিয়ে ছাগলনাইয়া হয়ে বাংলাদেশ ভারত বর্ডারে পৌঁছেন। তিনি এই পথে বর্ডারের খবর নিয়ে সেখানে ঝামেলা জানতে পেরে অগত্যা ঐখানে অবস্থান নেন।

দলটির যার যা টাকা পয়সা ছিল তা শেষ হয়ে গেলে এখন কি উপায় কি করা যায়, তিনি সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে ২ জন সাথী নিয়ে ফেনী শহরে হাজির হয়ে একটি ১টি স্বর্ণের দোকানে ঢুকেন। কিছু স্বর্ণের গহনা বিক্রির কথা জানালে উপস্থিত সহযোগীরা হতবাক হয়ে যান। একটি সোনার হার, ২টি সোনার ঝুমকা বিক্রি করে দিলেন, মাদারীপুর থেকে আসার সময় স্টুয়ার্ড মুজিব তার স্ত্রীর দেওয়া সোনার হার ও ১টি সোনার ঝুমকা এসকল বিক্রি করে দলের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করলেন স্টুয়ার্ড মুজিব। স্বাধীনতা যুদ্ধে এটি একটি বিড়ল ঘটনা ও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন যা স্বাধীনতা পিপাসুদের পক্ষেই সম্ভব। ২৫ শে এপ্রিল খবর পেলেন হানাদার বাহিনী ফেনী শহরে আসছে, এতে চিন্তিত ও বিপদের আশঙ্খায় দ্রুত বাংলাদেশ ভারত বেলুনিয়া বর্ডার পার হয়ে দুর্গম এলাকা পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের কাঠালিয়া বিসিএফ ক্যাম্পের বাজারে পৌঁছেন। স্টুয়ার্ড মুজিব রাত ৮ টায় ঐ দলকিটে কাঠালিয়া বিএসএফ এর ক্যাম্পে প্রশিক্ষনের জন্য রেখে তিনি ফিরে আসার ক্ষণে এক ভারাক্রায় হৃদয়ে সকলে তাকে হিসাব জানালেন।

যুবকদের ভারতে নিয়ে যাওয়া ও ট্রেনিং শেষে তাদেরকে মাদারীপুরে এনে পৌঁছানোর দায়িত্ব তিনি অতি সন্তর্পনে প্রত্যয়ী হয়ে পালন করেছেন। আসা যাওয়ার পথে দল নিয়ে অনেক সময় সম্মুখ যুদ্ধেও অংশ নেন । ১৯৭১ এর ২৭ শে জুন রাত ১১ টার দিকে তার নেতৃত্বে শরিয়তপুরের পালং থানায় আক্রমন হয় এবং সেখান থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসেন। আগরতলা মামলার সাময়িক সদস্যদেরকে প্রথমে ৯ নং স্টেকরে মেজর জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধার বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকার সিদ্ধান্ত হয়। পরে ৮নং সেক্টরের অধীনে অনেকেই ন্যস্ত হয়ে পড়েন। স্টুয়ার্ড মুজিব ৮ ও ৯নং উভয় সেক্টর প্রধান কার্যালয় এর লিয়াজু অফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ৮নং সেক্টরের প্রধান কার্যালয় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কল্যানীতে একদিন পরন্ত বিকালে খুব সম্ভবত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় আমি (নুরুল বিমান বাহিনীর মেজর মঞ্জুর স্যারের রুম থেকে বেি য়ে করিডোর দিয়ে হেঁটে চলছি, হঠাৎ করে আমার কানে ভেসে ওঠে- ভাগ্নে ভাগ্নে ইসলাম ফিরে তাকিয়ে দেখি স্টুয়ার্ড মুজিব আমার দিকে দ্রুত একজন কাছে আসতেই জড়িয়ে ধরে অনেক প্রশ্নে আমাকে স্মৃতি আবহে ফেলে দিলেন । সাথে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৬৭ এর শেষের দিকে (আমি তখন পাকিস্তানে বিমান বাহিনীতে চাকরীরত এম এ খান সাহেবের বাসায়।

প্রায় ছুটির দিনে স্টুয়ার্ড মুজিবের দেখা মিলত ওখানে। অনেক কথা বলতেন মনে পড়ে পশ্চিমারা চলন বলেন খাবার দাবারের কিভাবে আমাদেরকে নির্যাতিত করত আরও শোনাতো অধিকার আদায়ের কথা। পশ্চিম বঙ্গের কল্যাণীতে তিনি ঐদিন রাতে আমাকে সহ আরো সেনা ও বিমান বাহিনীর কয়েকজনকে নিয়ে আলোচনায় বসেন। রঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলে হানাদারদের মোকাবেলা করার কৌশল ও অনেক কথা। পরে তিনি আমাকে নিয়ে কয়েকদিন ৯নং সেক্টরে কয়েকটি ক্যাম্পে ঘুরলেন আর বললেন কিভাবে ভিতরে যেতে হবে, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে ইত্যাদি। তাকে জানালাম মঞ্জুর স্যারের অনুমতি ছাড়া আমিতো বের হতে পারব না, তিনি মঞ্জুর স্যারের সাথে আলোচনা করে আমার স্থানীয় সাথী রইসউদ্দিন সহ ও গোপালগঞ্জের ৭-৮ জন বিমান বাহিনীর সাথে যাওয়ার অনুমতি করালেন। আমাদেরকে ৯নং সেক্টরে নিয়ে অস্ত্র গোলাবারুদ ইস্যু করে প্রায় ৭০ জনের মত অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা ও আমাদের সাথে ২০০ থেকে ৩০০ শরণার্থী পর্ডার পাড় করে দিয়ে স্টুয়ার্ড মুজিব জানালেন তোমরা যাও আমি পরে আরও ১টি গ্রুপ নিয়ে আসছি।

ভিতরে আসার পথে নানা প্রতিকূলতার যশোর পাড় হয়ে পাড়পাড়ার নিকটে তিলখড়ী গ্রামে হানাদার বাহিনীর সাথে আমরা সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হই। এতে আমার সাথী রইসউদ্দিন- হানিফ শাহার মোট ৫ জন বিমান ও সেনাবাহিনীর সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। অনেকে আহত এবং অনেকেই বিচ্ছন্ন হয়ে যায়। অনেক কষ্টে অনাহারে দিন কেটে আমরা কিছু সংখ্যক মাদারীপুর এসে কমান্ডার আলমগীর হোসাইন ও কমান্ডার মমিনুর রহমানের সাথে দেখা করি। ১০ ই ডিসেম্বর মাদারীপুর শত্রুমুক্ত হওয়ার কয়েকদিন আগেই স্টুয়ার্ড মুজিব এক দল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নড়িয়া রুদ্রকর আসেন এবং মাদারীপুর মুক্তি হওয়ার পর পরই তিনি নড়িয়া থেকে মাদারীপুর এসে নাজিমউদ্দিন কলেজে ওঠেন। আমাকে খবর দেন এবং আমার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তার সাথে দেখা করে। ঐ কলেজ ক্যাম্প করেন। পাকিস্তানী নেভীর আফজাল কাশিয়ান ও বিমানবাহিনীর আমাকে স্টুয়ার্ড মুজিব এর সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য রেখে দিলেন। উল্লেখ্য মঞ্জুর স্যার স্টুয়ার্ড মুজিবকে অনারারী সাব লে. পদ দিয়ে তখন মাদারীপুর মহকুমার দায়িত্বে মতকুমাধীন সকল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সহ সকলকে একটি চেইন অফ কমান্ড পালনের জন্য নির্দেশিকা দিয়ে দেন।

হযবরল অবস্থায় মাদারীপুরে তখন স্টুয়ার্ড মুজিব মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে চেইন অফ কমান্ডার মোতাবেক শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা চালান। স্বধীনতার পর স্থানীয় পর্যায়ে উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তখনকার মহকুমা প্রশাসক, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও স্থায়ী প্রশাসন নিয়ে স্টুয়ার্ড মুজিব আলোচনায় বসেন এবং এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানি স্যারের এবং ঢাকার আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দদের সাথে আলোচনার জন্য ঢাকা যাওয়া তার অপরিহার্য হয়ে দাড়ায়। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ১০ ই জানুয়ারী ১৯৭২ আসছেন সংবাদ পেয়ে তার সাথে দেখা করার জন্য। তিনি ২রা জানুয়ারী ঢাকার উদ্দেশ্যে লঞ্চযোগে মাদারীপুর ত্যাগ করেন। তার সাথে এডভোকেট লতিফ সাহেব অন্যতম উপদেষ্টা হিসাবে ও আরো ২ জন মুক্তিযোদ্ধা সঙ্গী হন। ঢাকায় লতিফ উকিল সাহেবকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রশাসন কর্মকর্তার সাথে ৪ঠা জানুয়ারী দেখা করে আলোচনা করেন। ৫ই জানুয়ারী স্টুয়ার্ড মুজিব এম এ জি ওসমানি সাহেব হাই প্রফাইল ব্যক্তিবর্গের সাথে দেখা করার জন্য সকাল ৯-১০ টার দিকে লতিফ উকিলকে নিয়ে রিক্সাযোগে সচিবালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন, প্রেসক্লাবের ওখানে স্টুয়ার্ড মুজিব এর রিক্সার গতিরোধ করে, একটি সাদা প্রাইভেট কার থেকে ২ জন যুবক নেমে স্টুয়ার্ড মুজিব এর সাথে হ্যান্ডশেক করে এবং বলেন, মুজিব ভাই আপনাকে জরুরী অনুকে (কোন একজনের নাম উল্লেখ করে তিনি দেখা করতে বলেছেন এবং আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ী পাঠিয়েছেন চলুন গাড়ীতে।

এই সময় লতিফ উকিল সাহেব ঐ গাড়ীতে যেতে চান, কিন্তু যুবক নিষেধ করে বলেন আপনি থাকুন আধা ঘন্টার মধ্যে মুজিব ভাইকে এখানে পৌছিয়ে দিব। স্টুয়ার্ড মুজিব লতিফ উকিলকে বলেন কোন অসুবিধা নেই ওরা আমার পরিচিত, আপনি এখানে থাকুন। সাদা সাড়ি ধীরে ধীরে গতিতে চলতে শুরু করে তাকিয়ে থাকেন তিনি এক সময় গাড়ি খানা চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। উকিল সাহেব চিন্তা ভাবনার প্রহর গুনছে কখন স্টুয়ার্ড মুজিব ফিরে আসছেন। যুবক ঘন্টা খানেক পরে ফিরে এসে জানালেন মুজিব ভাই এর আসতে দেরী হবে। আপনাকে চলে যেতে বলেছেন, একটু হুশিয়ারী সংকেতে বলল এ স্থান ত্যাগ করাই আপনার জন্য শ্রেয়। লতিফ উকিল মুজিবের সন্ধান নিতে অনেক চেষ্টাও করেন কিন্তু ঘুরে ফিরে ব্যর্থ হন। অন্য যুবকরা তাকে এসে বলে যায় আপনি ঢাকা ত্যাগ করুন নতুবা বিপদ হতে পারে। এক অজানা আশংকায় লতিফ উকিল ঢাকা ত্যাগ করে মাদারীপুর এসে ঘটনার বর্ণনা দেন। স্টুয়ার্ড মুজিব ১৯৭২ সালে অপহৃত হলেন, তার পর থেকে তার অপহরণের কোন সন্ধান মেলেনি। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন আগড়তলার মামলার সহযোগী, স্টুয়ার্ড মুজিব লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা-এই বীর সেনানীর স্মৃতি রক্ষার্থে আজও কোন স্থাপনা নেই, জাতীয় খেতাব তালিকায় তিনিও নেই, তিনি হারিয়ে গেছে নাম না জানাদের ভীড়ে, আমরা তার সকল সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ ও স্থানীয় জনগন স্টুয়ার্ড মুজিবের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অবদানের জন্য তাকে স্মরণীয় করে রাখা এবং রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হতে পারে সেই প্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি কাম্য।

লেখক : সাবেক সহকারী কমান্ডার, মাদারীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test