E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ফিরে দেখা, ঘুরে দেখা

২০২৫ এপ্রিল ২৫ ১৮:৪০:১৮
ফিরে দেখা, ঘুরে দেখা

রহিম আব্দুর রহিম


টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলা। সবুজ-শ্যামলিমায় ঘেরা পাথরাইল গ্রাম। গ্রামের সম্প্রীতির সবচেয়ে বড় নিদর্শন, একই জায়গায় (লাগালাগি) মুসলিম সম্প্রদায়ের কবরস্থান এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্মাশানঘাট। নিবিড়, নিরিবিলি এই গ্রামের বাসিন্দা কাশিনাথ কুমার, এলাকায় যার নামের পরিচিতি কুশকুমার। ২ এপ্রিল সন্ধায় পৌঁছে গেলাম তাঁর বাড়িতে। রাত্রিযাপন। ৩ এপ্রিল সময় সকাল ৮টা। টার্গেট  ছিলো টাঙ্গাইলের ঐতিহাসিক শাড়ির রাজধানী পাথরাইলের তাঁত শিল্প এবং শিল্পীদের একাল সেকাল জানার। সম্ভব হয় নি। দেখা হলো, মোগল আমলের কারুকার্যময় স্থাপত্য 'আতিয়া'র মসজিদ। যে মসজিদটির কারুকার্যময় সৌন্দর্য ১০টাকার নোটের একপাশে স্থাপিত। উপজেলার প্রত্যন্ত পল্লী 'আতিয়া' গ্রামটি লৌহজং নদীর তীরে অবস্থিত। প্রায় ৫শত বছর  আগে ১৬০৮ সালে সাঈদ খান পন্নিই নামক এক ব্যক্তি, তাঁর পিতা বাবা আদম কাশ্মিরীর কবরের সন্নিকটে এই আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন। গ্রামটির নামকরণের ইতিহাসও মজার। আরবি ‘আতা’ থেকে ‘আতিয়া’ শব্দটির উৎপত্তি। যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘দানকৃত’। এলাকাটিতে একসময় তৎকালীন সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ টাঙ্গাইল জেলার জায়গিরদার হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তিনি এই অঞ্চলে  বসতি গাড়েন।শুরু করেন ধর্ম প্রচার। ইসলাম প্রচারের আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি আফগান নিবাসী কররানী শাসক সোলাইমান কররানীর কাছ থেকে এলাকার কিছু অংশ  দান বা ওয়াকফ্ হিসাবে পান। দানসূত্রে পাওয়ায় অঞ্চলটির নাম হয়েছে ‘আতিয়া’। পরে তিনি এই এলাকাটি একইভাবে আলি শাহান শাহ্‌ বাবা আদম কাশ্মীর (র)কে দান করেন। পরে বাবা আদম কাশ্মিরীর পরামর্শক্রমে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে উক্ত আতিয়া পরগণার শাসন কর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন।যিনি পরবর্তীতে  সাঈদ খান পন্নী নামক তাঁর এক ভক্তকে এটি দান করে দেন। এই ভক্তই  আতিয়া মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। যার স্থপতি ছিলেন সেই আমলের প্রখ্যাত স্থাপত্য শিল্পী মুহাম্মদ খাঁ। এরপর দু'দফায় মসজিদটি সংস্কার হয়। এর প্রথমটি ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরাণী কর্তৃক। দ্বিতীয় দফায় সংস্কার করেন আবুল আহমেদ খান গজনবী ১৯০৯ সালে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার এই মসজিদটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে অধিগ্রহণ করেন। মসজিদ ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হযরত শাহান শাহ আদম কাশ্মীর (র) মাজার শরীফ, হাফিজিয়া মাদ্রাসা, বীরমুক্তিযোদ্ধা শহীদ মিজানুর রহমান (অবৈতনিক) নৈশবিদ্যালয়, দাখিল মাদ্রাসা, নূরানী মাদ্রাসা, গার্লস হাইস্কুলে। সবগুলো প্রতিষ্ঠানই হযরত শাহান শাহ আদম কাশ্মীর (র) নামে নামকরণ। এখানকার সকল প্রতিষ্ঠানই এখন রাষ্ট্রীয় সম্পদ। যে কথা বলা হয়নি। এ যাত্রায় অন্যতম ভ্রমণটি ছিলো ৩০ মার্চ। ওইদিন সকাল ১০টায় আমার প্রতিষ্ঠিত তারারভিটা বংশাই থিয়েটারের কিশোরদের সঙ্গে নিয়ে বের হওয়া। 

উদ্দেশ্য, টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হেমনগর জমিদার বাড়ি পরিদর্শন। যাবার পথেই দেখার সুযোগ হয় ধনবাড়ি জমিদার বাড়ি এবং মসজিদটি। দুপুর বারোটায় পৌঁছায় গোপালপুরের প্রত্যন্ত পল্লীতে স্থাপিত ২০১ গম্ভুজ বিশিষ্ট মসজিদে। অপূর্ব! তবে মসজিদের প্রায় চতুর পাশে সাঁটানো নোটিশ, বিলবোর্ডের কারণে সৌন্দর্যের যথেষ্ট ব্যতয় ঘটছে। বেলা আড়াই পৌঁছে যায় কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য হেমনগর রাজবাড়ী। প্রচন্ড রোদ,সবুজ ঘেরা বিশাল মাঠ, দুর্বাঘাসে বসে বিশ্রাম। এবার দেখার এবং জানার পালা। ১৮৯০ সালে জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী এই বাড়ি নির্মাণ করেন। শাসক হিসেবে হেমচন্দ্র চৌধুরী খুবই কঠোর ছিলেন। তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ জুতা পায়ে হাঁটতে পারতো না। যেতে হলে খালি পায়ে, উল্টো হয়ে মাথা নুয়িয়ে যেতে হতো চলাচলকারীদের। এখানে তিনি বসতি স্থাপন করেন ১৮৮০ (১২৮৬ বঙ্গাব্দ) সালের দিকে। এর আগে জমিদার মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়ার রাজবাড়িতে বসবাস করতেন, সেখান থেকেই রাজত্ব চালাতেন। পরে বর্তমান গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের সুবর্ণখালি গ্রামে নতুন রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। সুবর্ণখালি ছিল যমুনা তীরের প্রসিদ্ধ নদীবন্দর। তৎকালে কলকাতার সাথে সহজ যোগাযোগের কারণে সেখানে আসাম ও কলকাতার স্টীমার আসতো। হেমচন্দ্র চৌধুরীসহ কয়েকজন হিন্দু জমিদারের প্রচেষ্টায় ১৯০৫ সালে ময়মনসিংহ হতে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন সম্প্রসারণ করা হয়। ফলে ওই সময় ঢাকার সাথে কলকাতার যোগাযোগ সহজ হয়ে ওঠে। তৎকালে সুবর্ণখালি হতে সরিষাবাড়ি উপজেলার জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সড়কে হেরিংবন্ড করায় অতি সহজে এইপথ ধরে টমটম বা পালকি চলাচল সহজ হয়ে উঠে। তৎকালীন এটিই গোপালপুর উপজেলার প্রথম পাঁকা সড়ক। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দশকে যমুনার করাল গ্রাসে বিলীন হয় সুবর্ণখালি নদীবন্দর ও হেমচন্দ্রের রাজবাড়ি। বর্তমানে সুবর্ণখালি ঐতিহ্য হারিয়ে আজ 'সোনামুই' সোনামুখী নাম ধারণ করে টিকে আছে।

দিল্লী ও কলকাতার কারিগর দ্বারা ইটসুরকির তৈরি বাড়িটি দেখতে অপূর্ব! ৬০ একর জায়গার উপর শত কক্ষবিশিষ্ট একসময়ের সৌন্দর্যের প্রতীক বাড়িটি এখন অরক্ষিত।সন্ধা নামলেই শুরু হয় অন্ধকার জগতের লীলাখেলা। বাড়িটা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সরকার দেখ-ভাল করার ব্যবস্থা করলে এলাকাটি যেমন পর্যটন নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে, তেমনি এলাকায় পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ফিরে আসবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

লেখক : নাট্যকার ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test