E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

পঞ্চম শিল্প বিপ্লবে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

২০২৫ এপ্রিল ০৯ ১৭:১৩:৪৬
পঞ্চম শিল্প বিপ্লবে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

মীর আব্দুর আলীম


ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল। তারিখ-এপ্রিল ৯-১০। ঠিক যেন ইতিহাসের বুকের পাতা নতুন করে লিখতে বসেছে বাংলাদেশ।  ঢাকা শহরের বাতাসে হঠাৎ একটা বিদেশি গন্ধ। না না, কারও বডি স্প্রের কথা বলছি না। গন্ধটা বিনিয়োগের। বিশ্বের নামীদামী বিনিয়োগকারীরা আসছেন ঢাকায়। এমনটা বাংলাদেমে হয়নি কখনো। আর এই যে এত কাণ্ড, এর মূল চাবিকাঠি আমাদেরই লোক-ড.প্রফেসর ইউনুস। নোবেল পাওয়া মানুষ তো আর আরাম করে ঘুমাবেন না, ঘুমের মধ্যেও ভাবেন, “দেশটারে একটু নাড়া দেই না?” আর ড. ইউনুস বসলেন নেড়ে চড়ে! এতটাই নেড়ে দিলেন যে, বিল গেটস শুনেছেন, এলন মাস্ক ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়েছেন, জেফ বেজোস হয়তো গুগল ম্যাপে Narayanganj to Dhaka Intercontinental সার্চ দিচ্ছেন! শোনা যাচ্ছে, স্টারলিঙ্ক পুরো প্রোগ্রাম লাইভ ব্রডকাস্ট করবে।

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। একঝাঁক স্যুট-পরা গ্লোবাল ইনভেস্টর, নামী দামী কোম্পানির শীর্ষ কর্তা, প্রযুক্তির যোদ্ধারা নামছেন ঢাকার মাটিতে। আর এই সবকিছুর পেছনে যিনি, তিনি আর কেউ নন— নোবেল লরিয়েট, মানবতার ধ্রুবতারা, আমাদের প্রফেসর ইউনুস। এই মানুষটির নেতৃত্বেই ৫০ দেশের ২৩০০+ ইনভেস্টর ভিড় করছেন বাংলার বুকে। এমন দৃশ্য তো ভারত তো দূরের কথা, পুরো উপমহাদেশেই কেউ কখনও কল্পনা করেনি! গোটা রাজধানী যেন হয়ে উঠেছে এক আন্তর্জাতিক ককটেল। হোটেলগুলো ফুল, বুকিং ফুল, ব্যস্ত এয়ারপোর্ট, সর্বত্র বিদেশি একসেন্ট, আর চায়ের দোকানে পর্যন্ত আলোচনার ঝড়—”এই দেখো, ওই যে বিল গেটস আসবে কিনা!” কেউ বলছে এলন মাস্ক গোপনে এসেই গেছেন। আবার কারও চোখে জল-”এই দৃশ্য কি আমরা কোনদিন কল্পনা করেছিলাম ভাই?” এটা বাংলাদেশের জন্য কি কম অর্জন।

এই সম্মেলন যেন বলছে-”আমরা আর শুধুই পোশাক রপ্তানিকারক নই, আমরা চিন্তা রপ্তানি করব, আমরা ভবিষ্যত রপ্তানি করব।” বাংলাদেশ, তুমি প্রস্তুত তো? কারণ সময় এসে গেছে বলার-”এই মুহূর্ত থেকে বিশ্ব আমাদেরকে সমীহ করতে শুরু করেছে!” আর প্রফেসরের জন্য?

ভালোবাসা অবিরাম, সম্মান অফুরান। কারণ তিনিই দেখিয়েছেন-স্বপ্ন শুধু দেখা নয়, সেটা বাস্তবেও টেনে আনা যায়। আমাদের আর থামিয়ে রাখার সাধ্য কার। আমরা এখন এমন এক জাতি-যাদের শহরে এলন মাস্ক লাইভ দেয়, আর চায়ের দোকানে “স্টারলিঙ্ক আসলে কি?” এই নিয়েই তর্ক! সব শেষে একটাই কথা- যারা এখনো বলেন, “এই দেশে কিছুই হয় না”-তাদেরকে বলুন, ঢাকার বাতাস এবার গন্ধ ছড়াচ্ছে ‘ডলারের’! আর আমরা? আমরা তো সেই ইউনুসের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে, বলি-” ‘বলো বাংলাদেশ, জয় হোক Fifth Industrial Revolution-5IR-এর!’ সুতরাং ভাই ও বোনেরা, স্কিল শিখুন, কাগজ-কলম রেডি রাখুন, কারণ আগামীকাল হয়তো আপনার বাসার পাশেই বসবে ‘5IR হাব’। আর পাশের বাড়ির রাজু, যে কিনা মোবাইল সারাই করে, সে হতে পারে আগামী দিনের AIট্রেনার!

শিল্প বিপ্লব শব্দটা আমরা প্রায়ই শুনি। প্রথমে ছিল যন্ত্রের জয়, এরপর বিদ্যুৎ ও উৎপাদনের বিস্তার, তারপরে কম্পিউটার ও ডিজিটালাইজেশন। চতুর্থ বিপ্লবে আমরা দেখলাম স্বয়ংক্রিয়তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবট, বিগ ডেটার মতো প্রযুক্তির দাপট। কিন্তু প্রশ্ন জাগে-এই প্রযুক্তির দুনিয়ায় মানুষ কোথায়? আমাদের মানবিকতা, নৈতিকতা, আবেগ—এসবের স্থানই বা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এসেছে পঞ্চম শিল্প বিপ্লব (5IR)—একটি “হিউম্যান-সেন্ট্রিক টেকনোলজিক্যাল এরা”। এটা কেবল নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার নয়, বরং প্রযুক্তি ও মানবিক বোধের সহাবস্থানের বিপ্লব। যেখানে যন্ত্র শুধু কাজ করবে না, মানুষকে বুঝবে, সহমর্মিতা দেখাবে। বিশ্বের ইতিহাসে শিল্প বিপ্লব কখনোই কেবল প্রযুক্তির উত্তরণ নয়, বরং সমাজ, অর্থনীতি ও মানবিকতা—এই ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের এক গতিশীল রূপান্তর। এখন আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে প্রযুক্তি আর মানুষের মধ্যে কেবল সহাবস্থান নয়, বরং সহমর্মিতার সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে। এই নতুন যুগের নাম-পঞ্চম শিল্প বিপ্লব বা Fifth Industrial Revolution (5IR).

বাংলাদেশ, তার অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা, তরুণ শক্তি ও ডিজিটাল পরিকাঠামো নিয়ে 5IR-এর দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। কিন্তু আমরা কি প্রস্তুত এই বিপ্লবকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য? 5IR আমাদের কী সুযোগ দেবে, আবার কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবে? চলুন তা বিশ্লেষণ করি বিস্তারে। শিল্প বিপ্লবের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: পঞ্চম অধ্যায়ের পটভূমি-

১. প্রথম শিল্প বিপ্লব (১৮শ শতক): বাষ্পশক্তির আবিষ্কার ও মেশিন-চালিত উৎপাদনের সূচনা।

২. দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব (১৯শ শতক): বিদ্যুৎ ও গণউৎপাদনের যুগ।

৩. তৃতীয় শিল্প বিপ্লব (২০শ শতক): কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডিজিটাল রূপান্তর।

৪. চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (বর্তমান): কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, বিগডেটা, ওড়ঞ, মেশিন লার্নিংয়ের জোয়ার।

৫. পঞ্চম শিল্প বিপ্লব (উদীয়মান): প্রযুক্তির সাথে মানবিক মূল্যবোধ, সহানুভূতি ও নৈতিকতা সংযুক্ত করার প্রয়াস।

চতুর্থ বিপ্লব যেখানে যন্ত্র মানুষের কাজ ছিনিয়ে নিচ্ছে, সেখানে পঞ্চম বিপ্লব মানুষকে প্রযুক্তির ‘সহযোগী’ হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করছে।

ইতিমধ্যে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে-ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি ফিলিপাইন থেকেও ফান্ড ম্যানেজাররা বলছেন, বাংলাদেশ ইজ দ্য নেক্সট বিগ থিং! কূটনৈতিক মহল ফিসফিস করছে—এই মুহূর্তে যদি বাংলাদেশ আসিয়ান সদস্য হওয়ার জন্য দরখাস্ত পাঠায়, তো তাৎক্ষণিক টিক মার্ক পড়ে যাবে! এ যেন এক “বাংলাদেশ রেনেসাঁ”-যেখানে প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, ও গ্লোবাল কানেক্টিভিটির মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা, এক বুক গর্ব নিয়ে। এমন সময়ে রাজনীতি নিয়ে বকবক করে লাভ নেই। এই সম্মেলন রাজনীতির উর্ধ্বে। এটা ভবিষ্যতের এক রূপরেখা। ইউনুস সাহেব যেন এক কাণ্ডারি, যিনি ঢাকাকে সিলিকন ভ্যালির মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের রেশ কাটিয়ে পঞ্চম শিল্প বিপ্লব বা 5th Industrial Revolution (5IR)-এর দিকে ধাবিত হচ্ছে। যেখানে 4IR ছিল প্রযুক্তিনির্ভর স্বয়ংক্রিয়তার জয়যাত্রা, সেখানে 5IR মানবিকতাকে প্রযুক্তির পাশে বসাতে চায়—‘Tech for Humanity’ এটাই এই বিপ্লবের মূলমন্ত্র।

কী এই পঞ্চম শিল্প বিপ্লব?

পঞ্চম শিল্প বিপ্লব মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ইন্টারনেট অব থিংস (IoT), রোবোটিক্স, ব্লকচেইন, জেনারেটিভ এআই প্রভৃতিকে মানুষের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সৃজনশীলতার সঙ্গে সমন্বয় করার যুগ। এটি মানবিক প্রযুক্তির বিপ্লব—যেখানে যন্ত্র ও মনুষ্য শক্তি একসঙ্গে কাজ করবে, প্রতিযোগিতার চেয়ে সহযোগিতাকে প্রাধান্য দেবে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা ও 5IR-এর সম্ভাবনা

১. বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠী আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি: বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশই তরুণ (১৫-৩৫ বছর)। এই তরুণরা প্রযুক্তি-সচেতন, মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানের অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিযোগী। সঠিক প্রশিক্ষণ ও সুযোগ পেলে এই জনশক্তি 5IR যুগে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদে পরিণত হতে পারে।

২. তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার 5IR-এর ভিত্তিভূমি: ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ইন্টারনেট পৌঁছেছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা এই বিস্তারকে জনগণের দৈনন্দিন জীবনের অংশে পরিণত করেছে। এখন দরকার এই প্রযুক্তিকে মানবিক করে তোলা—যার দিকে এগিয়ে নিচ্ছে 5IR।

৩. স্টার্টআপ ও ইনোভেশন হাবের উত্থান: বাংলাদেশে একাধিক অও-ভিত্তিক স্টার্টআপ, ফিনটেক প্রতিষ্ঠান, অ্যাগ্রিটেক উদ্ভাবন এবং স্বাস্থ্য প্রযুক্তির প্ল্যাটফর্ম জন্ম নিচ্ছে। “পাঠশালা”, “ডাক্তার ভাই”, ‘10 Minute School’, ‘ShopUp’, ‘Bkash’, ‘Sheba.xyz—এরা ভবিষ্যতের স্মার্ট বাংলাদেশের পূর্বাভাস দিচ্ছে।

চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের পাশাপাশি ঝুঁকি

১. দক্ষতা ঘাটতি- প্রযুক্তির গতির সাথে মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও পিছিয়ে। প্রযুক্তি জ্ঞান, সফট স্কিল ও মানবিক বোধ—এই তিনের সমন্বিত শিক্ষা প্রয়োজন।

২. মানবিক সংকটের ঝুঁকি- AI এবং রোবটিক্স যদি শুধুমাত্র উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়, তবে মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস হতে পারে। কাজ হারানো, একাকীত্ব, তথ্যের অপব্যবহার—এসবই সম্ভাব্য ঝুঁকি।

৩. নীতিমালা ও সাইবার নিরাপত্তার অভাব- ডেটা সুরক্ষা আইন, AI ব্যবহার সংক্রান্ত নীতিমালা, রোবটের নৈতিক ব্যবহার—এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে।

5IR বাস্তবায়নে করণীয় ও পথনির্দেশিকা

১. শিক্ষায় রূপান্তর- প্রাইমারি স্তর থেকেই AI-literacy ও মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলকভাবে যুগোপযোগী করা দরকার।

২. একটি জাতীয় “‘5IR রোডম্যাপ”। সরকারি ও বেসরকারি খাতে সমন্বয় করে পঞ্চম শিল্প বিপ্লব নিয়ে একটি সমন্বিত কৌশলপত্র প্রণয়ন করা সময়ের দাবি।

৩. গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ- বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্টার্টআপদের 5IR সংশ্লিষ্ট গবেষণায় সরকারি অনুদান, ট্যাক্স সুবিধা এবং প্রযুক্তি হাব গঠন করতে হবে।

৪. মানবিক নেতৃত্ব গড়ে তোল-এই বিপ্লবের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন value-based leadershipঢ়। নেতৃত্ব হতে হবে মানবিক, দূরদর্শী এবং প্রযুক্তিসচেতন।

পঞ্চম শিল্প বিপ্লব কেবল একটি প্রযুক্তিগত যুগান্তর নয়, এটি একটি মানবিক জাগরণ। যন্ত্র যেখানে কেবল কাজ করবে, আর মানুষ সেই যন্ত্রকে ব্যবহার করে মানবতা রক্ষা ও বিকাশ ঘটাবে। বাংলাদেশের সামনে রয়েছে এক সুবর্ণ সুযোগ—এই বিপ্লবের পথিকৃৎ হওয়ার। তবে এর জন্য প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব, দক্ষ জনশক্তি, মানবিক শিক্ষা এবং সময়োপযোগী নীতিমালা। আমরা যদি প্রযুক্তিকে মানবতার সেবায় নিয়োজিত করতে পারি, তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়-5IR যুগে বাংলাদেশ হবে A smart, sustainable and soulful nation. বাংলাদেশ যদি এখন থেকেই মানবিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গঠনের প্রস্তুতি নেয়, তবে এই বিপ্লব কেবল অর্থনীতিকে নয়, মানুষের জীবনদর্শনকেও বদলে দিতে পারে। আমরা প্রযুক্তির দাস হব না, প্রযুক্তিকে সেবায় নিয়োগ করব-এটাই হোক বাংলাদেশের 5IR অভিযাত্রার মূলমন্ত্র। তবে একদিন আমরা গর্ব করে বলতে পারব-“প্রযুক্তি আমাদের শাসায়নি, আমরা প্রযুক্তিকে সেবায় লাগিয়েছি-মানবতার জন্য।”

লেখক: সাংবাদিক, জীবনমুখী লেখক, কলামিস্ট, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

১৩ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test