E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

রক্তাক্ত ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলা

মানবতার পৃথিবী তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার

২০২৫ এপ্রিল ০৭ ১৭:৫৬:৩৯
মানবতার পৃথিবী তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার

ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি হামলায় আরও অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অবরুদ্ধ এই উপত্যকাজুড়ে দখলদার বাহিনীর বর্বর হামলা অব্যাহত রয়েছে এবং এর মধ্যেই একদিনে আরও অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটল।টানা প্রায় ১৮ মাস ধরে চালানো এই আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৫০ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি।এর মধ্যে গত ২০ দিনেই গাজায় প্রায় ৫০০ শিশুকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এতে এই সময়ের মধ্যে মোট শহীদের সংখ্যা ১৩৫০ জনে দাঁড়িয়েছে।সোমবার (৭ এপ্রিল) এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, দেইর আল-বালাহের পাঁচটি এলাকার বাসিন্দাদের তাদের এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর ইসরায়েল গাজার মধ্যাঞ্চলে নতুন করে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে। সর্বশেষ এই হামলার ফলে বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন যার মধ্যে একজন সাংবাদিকও রয়েছেন।গাজায় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের একদিন পর নতুন করে এই হামলা চালানো হলো। রোববার এই উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় ৫০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়েছেন।

এর আগে গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে আগ্রাসনের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলার মুখোমুখিও হয়েছে ইসরায়েল।

গাজার পরিচয় : গাজা, (গাজা আরবিতে غَزَّةَ বা Ġazzah বা গাজ্জা) ভূমধ্যসাগর বরাবর ১৪০ বর্গমাইল (৩৬৩ বর্গ কিলোমিটার) এলাকা নিয়ে অবস্থিত। এর দক্ষিণ-পশ্চিমে মিসর এবং পূর্ব ও উত্তরে ইসরাইল রয়েছে। সহজভাবে গাজা দুটি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের মধ্যে একটি ছোট অংশ (অন্যটি হচ্ছে পশ্চিমতীর)।

গাজার সাথে বাংলাদেশের অদ্ভুত মিল আছে। যেমন বাংলাদেশের আড়াই দিক ঘিরে আছে ভারত, সামান্য কিছুটা মিয়ানমার আর দক্ষিণে সাগর। গাজার অবস্থাও তাই। তবে গাজা (Ġazzah) আয়তনে আমাদের বর্তমান ঢাকা মহানগরীর কাছাকাছি (Dhaka=Dacca, উচ্চারণটাও কাছাকাছি) ৩০৬ বর্গকিলোমিটার।

গাজার সরকারি ভাষা আরবি। জাতিগোষ্ঠী ফিলিস্তিনি আরব। ধর্ম ৯৯% সুন্নি ইসলাম, ১% খ্রিস্টধর্ম। জনসংখ্যা আনুমানিক ২,৩৭৫,২৫৯ (২০২২)। জন-ঘনত্ব ৬,৫০৭/বর্গ কিলোমিটার (১৬,৮৫৩.১/বর্গ মাইল) গাজার জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি (হংকংয়ের সাথে তুলনীয়)। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘের ১৩৮ সদস্য দ্বারা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।

গাজা সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের কেন্দ্র : গাজার ইতিহাস প্রায় ৪,০০০ বছরে বিস্তৃত। গাজা বিভিন্ন রাজবংশ, সাম্রাজ্য দ্বারা শাসিত হয়েছে আবার অনেকের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং পুনরুদ্ধার হয়েছিল। এটি ফিলিস্তিনের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে একটি। এর আগে গাজা প্রায় ৩৫০ বছর ধরে প্রাচীন মিসরীয়দের নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। গাজা ৭৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট শহরটি অবরোধ ও দখল করেন। তার আক্রমণের সময় বেশির ভাগ বাসিন্দা নিহত হয়। অতঃপর শহরটি হেলেনিস্টিক শিক্ষা ও দর্শনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং আরব বেদুইনদের দ্বারা পুনর্বাসিত হয়।

ইসলামের এক প্রাণকেন্দ্র : ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনে আল-আস গাজা জয় করেন। সে সময় অধিকাংশ গাজাবাসী প্রাথমিক মুসলিম শাসনামলেই ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর শহরটি সমৃদ্ধির শীর্ষে আরোহণ করে। ১১০০ সালে ক্রুসেডাররা ফাতেমিদের কাছ থেকে গাজার নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয়, কিন্তু সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী তাদের বিতাড়িত করেন। ১৩ শতকের শেষের দিকে গাজা মামলুকের হাতে ছিল এবং সিনাই উপদ্বীপ থেকে সিজারিয়া পর্যন্ত বিস্তৃৃত একটি প্রদেশের রাজধানী হয়ে ওঠে। এটি ১৬ শতকে অটোমান-নিযুক্ত রিদওয়ান রাজবংশের অধীনে একটি স্বর্ণযুগের সাক্ষী ছিল।

ষড়যন্ত্রের সূচনা : ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বাহিনী শহরটি দখল করে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল সৃষ্টির পর মিসর প্রায় দুই দশক ধরে গাজা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনিদের নির্বাসনের ফলে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৭ সালে আরবদের বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের বিজয়ের পর ইসরাইল গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিমতীরের নিয়ন্ত্রণ কব্জা করে নেয়। পরবর্তী ৩৮ বছর ধরে, সে গাজাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ২১টি ইহুদি বসতি নির্মাণ করে। ২০০৫ সালে, আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে, ইসরাইল গাজাকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে দিতে বাধ্য হয়।

পরিশেষে বলতে চাই, সার্বিক পর্যালোচনা ও তথ্য-প্রমাণ বলছে, ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরাইল যুদ্ধ নয়, পরিকল্পিত গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। সেখানে সৈনিকে সৈনিকে লড়াই হচ্ছে না, সাধারণ নাগরিক, নারী এবং শিশু তথা গোটা জাতিকে টার্গেট করে যুদ্ধ করছে ইসরাইল। আক্রমণ পরিচালিত হচ্ছে সকল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এবং প্রতিটি ফিলিস্তিনি সংস্থার বিরুদ্ধে। বসতবাড়ি, ধর্মস্থান, অর্থনীতি, সংস্কৃতি রক্ষা পাচ্ছে না। পশ্চিমা দেশ ও মিডিয়া পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রচারণা করে ইসরাইলের মানবাধিকারবিরোধী কার্যক্রমকে মদত দিচ্ছে। গাজায় একটি ‘মিথ্যা’ ও ‘সাজানো’ যুদ্ধের খবর প্রচার করে ‘আসল’ গণহত্যাকে আড়াল করা হচ্ছে। তাই গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা আর ভারতে মুসলিম নির্যাতন একই সূত্রে গাঁথা। ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলমানদের ওপর চালানো বর্বর গণহত্যা বিশ্ব মানবতার জন্য কলঙ্ক। শুধু আরব বিশ্ব নয়, মানবতার পৃথিবী তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। কিন্তু আফসোস, মুসলিম বিশ্বও আজকে গতানুগতিক মৌখিক প্রতিবাদ করে বসে রয়েছে। তাই মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন থেকেও ভারতের মুসলমানদের রক্ষা করতে হবে। আর হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন পৃথিবীকে বিষাক্ত করে তুলছে। উভয় অপশক্তির বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহকে জাগিয়ে তুলতে হবে। ওরা আমাদেরকে মানবতার সবক শেখায়! মানবতার হন্তারক ওরা। ওরা পৃথিবীর মানবতাকে গলাটিপে হত্যা করছে।আর গাজার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে দেখে অনেকেই আমরা অস্বাভাবিক অবস্থায় আছি। চলুন সবাই যে যার জায়গা থেকে মজলুমের পাশে দাঁড়াই। একটি দেহের মতোই একাত্ম হয়ে গর্জন করি। মজলুমের ফরিয়াদ আর আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না। আল্লাহ তুমিই একমাত্র এই মজলুম ও পবিত্র জনপদের সর্বোত্তম সাহায্যকারী। তাই তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। আমিন।

লেখক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল, drmazed96@gmail. com

পাঠকের মতামত:

০৭ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test