E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

খাদ্যে বিষ: মরার আগে মরছি!

২০২৫ এপ্রিল ০৬ ১৭:২০:১৮
খাদ্যে বিষ: মরার আগে মরছি!

মীর আব্দুল আলীম


একটা সময় ছিল, মানুষ কষ্টে মরতো। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিষ খেত, কিংবা জমিজমার মামলা-মোকদ্দমায় দিশেহারা হয়ে গলায় দড়ি দিত। আর এখন? এখন বিষ খেতে হয় না। খাবারে মেশানো থাকে। তা খেয়ে মানুষ মৃত্যুবরণ করে! যুগ পাল্টেছে। আধুনিক জীবন মানেই আধুনিক মৃত্যু। আগে যেখানে খাবার ছিল পুষ্টির উৎস, এখন তা যেন নীরব ঘাতক। আমরা আর খাবার খাচ্ছি না- খাচ্ছি কার্বাইড, ফরমালিন, সোডিয়াম সাইক্লামেট, বোরিক অ্যাসিড, ডাইক্লোরোডাইফ্লুরোমিথেন (যেটার নাম উচ্চারণেই মানুষ মরার উপক্রম হয়)। নাম শুনে মনে হয় কেমিস্ট্রির ল্যাব! অথচ এদের আমরা বলি “ভাত-মাছ-সবজি”। মাছ-ভাতে বাঙালি এখন বিষ-ভাতে বাঁচে!

এদেশে কেউ ক্যান্সারে, কেউ কিডনি রোগে, কেউবা ফুসফুসে আক্রান্ত। চাচা ক্যান্সারে মারা গেছেন, ভাইও আক্রান্ত। পাশের বাসার শিশুটির ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চারপাশে যেন রোগের ছড়াছড়ি। অকালে হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয়জনেরা। বিষ খেলে মানুষ মরবেই-এ তো জানা কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ আমরা প্রতিদিন বিষ খাচ্ছি-খাবারের নামে!

বাজারে ফরমালিনে ফ্রেশ সব: এক সময় মাছ মরার পর পচতো, এখন পচে না। কারণ মাছটা মারা তো যায়নি — তাকে মেরে জ্যান্ত রাখা হয়েছে ফরমালিনে চুবিয়ে! চিংড়ি মাছ টকটকে লাল, কিন্তু আসলে সেটা রঙিন মৃত্যু। সবজিতে রং এত উজ্জ্বল যে প্যারিস ফ্যাশন উইকে পাঠালেও মানায়! আমরা খাচ্ছি ভাত, কিন্তু সেই ভাতে আছে ‘পটাশিয়াম ব্রোমেটে’, রন্ধন তেলে আছে র‌্যান্সিডিটি। বিজ্ঞান যেটাকে বলে অক্সিডেশন, আমরা বলি ‘হালকা ঘ্রাণ আছে মনে হয়’। খাবারে গন্ধ থাকলেই যে ভালো কিছু, এটা তো আর সব সময় সত্যি না!

অর্গানিক প্রতারণা এবং ‘ভেজালপ্রীতি’: বাংলাদেশে এখন একটা নতুন বাজার তৈরি হয়েছে — “অর্গানিক” বাজার। দোকানপাটে লেখা “অর্গানিক আম”, “অর্গানিক চাল”, “অর্গানিক কুমড়া” শুনলে বোঝা যায়, এ যেন বিদেশি রাজপুত্রের রাজকীয় ভোজ! কিন্তু সেই অর্গানিকের উৎস জানতে গেলে দেখা যায়, সব কিছুই গাজীপুর বা নবীনগরের কোন এক ‘ব্যবসায়ী চাচার’ হোমিও ল্যাব থেকে আসা। ঢাকায় বসে আমরা এখন অর্গানিক রসগোল্লা খাচ্ছি, যাতে গ্লুকোজ সিরাপের বদলে দেওয়া হয়েছে “প্রাকৃতিক হাইড্রোজেনেটেড সুগার সাবস্টিটিউট”- যা শোনার পরই প্রেশার ১৫০ হয়ে যায়।

আইন আছে, প্রয়োগ নেই: খাদ্যে ভেজালবিরোধী আইন আছে। এমনকি ১৯৫৯ সালের ‘খাদ্য নিরাপত্তা আইন’ এখনও বইয়ের পাতায় চমৎকারভাবে শোভা পাচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। এর ব্যবহার অনেকটা সেই পুরোনো গ্রাম্য চৌকিদারের লাঠির মতো- শুধু ঝাড় দেওয়া যায়, পেটানো যায় না। ভেজাল দেওয়া বা ভেজাল খাদ্য ও পানীয় বিক্রির কারণে ১৯৭৪ সালের বিশেখ ক্ষমতা আইনে কঠের শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইনের ২৫ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো খাদ্য বা পানীয়দ্রব্যে ভেজাল দিয়ে তা ভক্ষণ বা পান করার অযোগ্য করে ও তা খাদ্য, পানীয় হিসেবে বিক্রি করতে চায় বা তা খাদ্য বা পানীয় হিসেবে বিক্রি হবে বলে জানা সত্ত্বেও অনুরূপ ভেজাল দেয় অথবা কোনো দ্রব্য নষ্ট হয়েছে বা নষ্ট করা হয়েছে বা খাদ্য, পানীয় হিসেবে অযোগ্য হয়েছে জানা সত্ত্বেও বা তদ্রূপ বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও অনুরূপ কোনো দ্রব্য বিক্রি করে বা বিক্রির জন্য উপস্থিত করে; তবে সে ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে এবং তদুপরি জরিমানাদন্ডে দন্ডনীয় হবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০৫ সালে অর্ধশত বছরের পুরনো ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশে (পিএফও) বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনে। বিএসটিআই অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এবং এর অধীনে প্রণীত বিধিমালায় খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির জাতীয় মান প্রণয়ন এবং প্রণীত মানের ভিত্তিতে পণ্যসামগ্রীর গুণগত মান পরীক্ষা ও যাচাই করার বিধান রয়েছে।

পালনীয় বিধানাবলী ভঙ্গের জন্য চার বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। খাদ্যে ভেজাল রোধ ও ভেজালকারীদের শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে সিটি কর্পোরেশন অধ্যাদেশগুলোয়। দেখা যাচ্ছে, দেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালবিরোধী আইনের কমতি নেই। শাস্তির বিধানও রয়েছে এসব আইনে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, শাস্তির বিধানসংবলিত এসব আইন বলবত থাকা সত্ত্বেও খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের এত দৌরাত্ম্য কেন? কারাদন্ডের বিধান থাকলেও এ পর্যন্ত তা প্রয়োগের কোনো নজির নেই। এটা আমাদের বাঙালি জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছুই খাদ্যে মিশ্রণ করা যাবে না- এটাই বিধান। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা এ আইন মানছে না। এ জন্য চলমান ভেজালবিরোধী আইনকে কঠের করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের জনবল ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।এদেশে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ‘দি পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স’ ১৯৫৯ বর্তমান ব্যবস্থায় কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। এই আইন যখন হয়েছে তখন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অনেক রাসায়নিক দ্রব্য সৃষ্টিই হয়নি। আর খাদ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে আশির দশকের পর। ফলে জনস্বার্থে আইন সংশোধন না করে নতুন করে কঠের আইন তৈরি করতেই হবে। এতে খাদ্যে ভেজালকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি ২০২ ধারা অনুসরণ করা দরকার। কারণ খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে মানুষ মারা এবং সরাসরি মানুষ মারাকে এই অপরাধের আওতায় আনা না হলে ভেজাল মেশানো প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না।

বিভিন্ন অভিযানে দেখা যায়, দোকানে গিয়ে কিছু চিনি ফেলে পরীক্ষা করা হলো- ফলাফল: “চিনিতে কাপড়ের রং পাওয়া গেছে।” তারপর কী হয়? এক কাপ চা, একটু সমঝোতা, এবং ফিরে আসা। দোকানদার বলেন, “মাফ কইরা দেন ভাই, আর হইব না!” পরের দিনই তিনি নতুন নাম দিয়ে প্যাকেট ছাপান- “মায়ের দোয়া সুগার: ১০০% বিশুদ্ধ (বাজারে একমাত্র)!”

বিএসটিআই ক্যাব আর বাস্তবতা: বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর হাতে যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি আছে, তা দিয়ে তারা আসলে তেলাপোকার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলেও চালাতে হিমশিম খায়। পরীক্ষাগার নেই, যন্ত্রপাতি নেই, লোকবল নেই — অথচ দায়িত্ব বিশাল। ক্যাব (ভোক্তা অধিকার সংগঠন) মাঝে মাঝে রিপোর্ট দেয় — ঢাকার ৭০% হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারে ভেজাল! শুনে আমরা কাঁধ ঝাঁকি দেই, তারপর বাসার নিচের ওই হোটেলেই পরোটা-ভাজি খাই। কারণ খিদে আর অভ্যাস, দুইটা জিনিসই পেটের পক্ষে ভীষণ আপোষকারী।

শিশুরা আজকের বলি: আজকাল শহর কিংবা গ্রামে বাচ্চাদের যে হারে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, লিভার ডিজঅর্ডার হচ্ছে, তাতে ডাক্তাররা বলছেন: “ওদের শরীরে প্রাকৃতিক কিছু কম, কৃত্রিম জিনিস বেশি!” শিশুর দুধে হাইড্রোজেনেটেড ফ্যাট, নুডলসে ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভ, চিপসে সোডিয়াম গ্লুটামেট! বাচ্চারা খেলছে, খাচ্ছে, বড় হচ্ছে, কিন্তু শরীর যেন তৈরি হচ্ছে ‘নরম পলিথিন দিয়ে’। শিশুকালেই গোটা দেহটায় যেন বিষের রাজত্ব।

আমরা আসলে কী খাচ্ছি: এ প্রশ্ন কি আমরা কখনো নিজের কাছে করেছি? সম্প্রতি এক লেখায় পড়লাম-“প্রতি জনে, প্রতি ক্ষণে, জেনে-শুনে করেছি বিষ পান।” আরও এক লেখক লিখেছেন-“কত কিছু খাই, ভস্ম আর ছাই।” জাতীয় দৈনিকে হেডলাইন- “মাছের বাজারে মাছি নেই!” এগুলো নিছক রসিকতা নয়-এগুলো বাস্তবতা। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যে কোনো না কোনো মাত্রায় বিষ মেশানো হচ্ছে-এ আর অজানা কিছু নয়। আর এই বিষই আমাদের নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে, ধীরে ধীরে নীরব ঘাতকের মতো।

বাঁচার উপায় কী?

আমরা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকি, তবে এক সময় হয়তো এই দেশে শোকবার্তা লেখা হবে এমনভাবে: “তিনি মাত্র ৪০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, মৃত্যুর কারণ ছিল সকালে খাওয়া এক প্লেট খিচুড়ি।”

খাদ্যে ভেজাল বন্ধ করতে হলে চাই: (১) কঠোর আইন ও তার কার্যকর প্রয়োগ (২) স্বতঃস্ফূর্ত গণসচেতনতা ভোক্তা আন্দোলন (৩) মিডিয়া নজরদারি খাদ্য পরীক্ষার জন্য আধুনিক ল্যাব ও সক্ষম জনবল (৪) বিশেষ আদালত চালু করে দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা

খাবার নয়, আমরা জীবন চাই! আমরা চাই না পত্রিকার হেডলাইন হোক: দুধে দুধ নেই, “পেঁয়াজে পেঁয়াজ নেই, পোলাওয়ে পোলাওর খোঁজ নেই!” এভাবে আর চলতে পারে না। জীবন বাঁচাতে হলে আমাদের সবাইকে-জনগণ, প্রশাসন, ব্যবসায়ী, গণমাধ্যম এবং সরকার—একযোগে যুদ্ধ করতে হবে। ভেজালের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে, প্রয়োজনে আন্দোলনে যেতে হবে। এটা কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়, এটা আমাদের সবার। নইলে একদিন বলতেই হবে- “বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবে নিরাপদ খাদ্যে রীতিমতো অনাহারী!” আর আমরা যারা এই সমাজের নাগরিক- চলুন না, অন্তত এমন মৃত্যুর মুখে বাঁচার অভিনয় না করি। আমরা বিষময় খাবারে বিরুদ্ধে লড়ি।

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

০৭ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test