E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

উন্নয়নের পথে বাংলাদেশ: সম্ভাবনার সাথে চ্যালেঞ্জও কম নয়

২০২৫ এপ্রিল ০৩ ১৭:১০:৪৯
উন্নয়নের পথে বাংলাদেশ: সম্ভাবনার সাথে চ্যালেঞ্জও কম নয়

মীর আব্দুল আলীম


বাংলাদেশ এখন এক পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য হ্রাস, রপ্তানির ইতিবাচক প্রবণতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মতো বিষয়গুলো দেশটির অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে আরও দৃঢ় করছে। তবে, এসব ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি খাদ্যে ভেজাল, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, সড়কের বিশৃঙ্খলা এবং ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য এখনও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই সময়টিতে সঠিক নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া গেলে দেশ আগামী দশকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছাবে। তাই, বর্তমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার পর্যালোচনা অত্যন্ত জরুরি।

শুরুতেই ইতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক-

রিজার্ভ বৃদ্ধি: অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সূচক- ঈদের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্প্রতি ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়। এটি দেশের আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে, এই রিজার্ভকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই রাখা এবং আরও বৃদ্ধি করা একটি চ্যালেঞ্জ, যা কৌশলগত পরিকল্পনা ও যথাযথ অর্থনৈতিক নীতির ওপর নির্ভরশীল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এটি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং উন্নত করতে সহায়ক হবে, যা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ঋণ গ্রহণ সহজতর করতে পারে। পাশাপাশি, রিজার্ভ বৃদ্ধির ফলে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য মুদ্রানীতি পরিচালনা করা সহজ হবে, বিশেষত যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা বা মুদ্রার অবমূল্যায়ন মোকাবিলা করতে হবে। উন্নত রিজার্ভের আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো এটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বার্তা পৌঁছে দেয়। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণত এমন দেশগুলিকে বেশি গুরুত্ব দেয়, যাদের পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে, যা অর্থনৈতিক সংকটের সময়েও আমদানি ব্যয় ও ঋণ পরিশোধ নিশ্চিত করতে পারে।

যদিও বর্তমান রিজার্ভ বৃদ্ধি স্বস্তিদায়ক, তবে এটি ধরে রাখার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজন। নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার। বাংলাদেশ এখনো অনেক পণ্যের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে জ্বালানি, শিল্প কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য ও প্রযুক্তি খাতের আমদানির কারণে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। দেশে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, স্থানীয় শিল্পের বিকাশ এবং বিকল্প জ্বালানি উৎসের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে আমদানি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে।

রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়ানোর জন্য সরকারকে নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান, বিদেশগামী কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ, এবং বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলকে আরও সহজ ও আকর্ষণীয় করতে পারলে অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো কমতে পারে। প্রবাসী আয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা জরুরী। প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে তাদের জন্য সহজ ঋণসুবিধা, বিশেষ সঞ্চয় প্রকল্প এবং আকর্ষণীয় বিনিয়োগ পরিকল্পনা প্রয়োজন। এর ফলে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আসবে, অন্যদিকে দেশের উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়বে।

পোশাক রপ্তানির পুনরুদ্ধার অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি: বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো তৈরি পোশাক শিল্প। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অন্যান্য নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। এটি শুধু অর্থনীতির জন্য নয়, শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থানের জন্যও অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে, এই খাতের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান। শ্রমিক অধিকার, কর্মপরিবেশের মানোন্নয়ন, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা এবং কারখানাগুলোর টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে না পারলে এই ইতিবাচক প্রবণতা দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে। আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করতে হলে শ্রমিক কল্যাণ ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন কৌশল গ্রহণ করা জরুরি। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (ঋউও) বাড়ানোর জন্য সরকারকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ঝঊত) এবং প্রযুক্তি পার্কের কার্যকারিতা বাড়াতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য শুল্ক সুবিধা, কর অবকাশ, এবং সহজ ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য হ্রাস স্থিতিশীল অর্থনীতির ইঙ্গিত: গত কয়েক মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আটা-ময়দার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপণ্যের দাম কমে আসায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্য ও জ্বালানির মূল্য হ্রাস, সরবরাহ চেইনের উন্নতি এবং সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতির ফলে এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, বাণিজ্য ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা এবং জ্বালানি খাতের ব্যয় হ্রাসের ফলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর আমদানির ব্যয়ও কমেছে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্বাভাবিকের দিকে ফিরতে শুরু করেছে।

সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ বাজার নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে, টিসিবির মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য সরবরাহ, ভর্তুকিযুক্ত আমদানি, এবং মজুতদারদের ওপর কড়া নজরদারি মূল্য হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যাতে বাজারে সরবরাহ বাড়ে এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না হয়। সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা আগের তুলনায় শক্তিশালী করা হলেও, বিভিন্ন পর্যায়ে এখনো অসঙ্গতি দেখা যায়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৈরি করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার সংস্থাগুলোর নজরদারির ফলে এসব চক্রের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি।

যদিও বর্তমান মূল্য হ্রাস সাধারণ জনগণের জন্য স্বস্তিদায়ক, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি ধরে রাখা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, সরবরাহ শৃঙ্খলার অনিয়ম, এবং অতি-লাভজনক ব্যবসায়িক প্রবণতা মূল্য হ্রাস প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারের পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনের উপর নির্ভর করেই ভবিষ্যতে মূল্য প্রবণতা নির্ধারিত হবে। একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, মূল্য হ্রাসের সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী বাজারে নতুনভাবে মজুদদারি শুরু করতে পারে, যা আবারও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

অতীতে দেখা গেছে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মূল্য কমার পর, ব্যবসায়ী চক্র নতুনভাবে সরবরাহ সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেয়। এ ধরনের প্রবণতা রোধ করতে হলে, বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতি আরও কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে, সরবরাহ চেইনের প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার। মজুদদারি ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ: বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাত, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। তবে শুধু পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী ও টেকসই করতে হলে রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। আইটি খাতের সম্ভাবনা দিন দিন বাড়ছে, বিশেষ করে সফটওয়্যার রপ্তানি, বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) এবং ফ্রিল্যান্সিং খাতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এ খাতের আরও প্রসার ঘটাতে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ, দক্ষ জনশক্তি গঠন এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ওষুধ শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি বাড়ানোর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। দেশীয় ওষুধ উৎপাদন ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে, নতুন ওষুধ উদ্ভাবন এবং রপ্তানিযোগ্য ওষুধের মান উন্নত করে এই খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করা দরকার। একইভাবে, চামড়া শিল্পের ক্ষেত্রে শুধু কাঁচা চামড়া রপ্তানি না করে, সেটিকে প্রক্রিয়াজাত করে বিশ্বমানের চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক বাজার সম্প্রসারণ করা সম্ভব।

কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন বাড়াতে হবে। দেশে উৎপাদিত ফল, শাকসবজি, মসলা এবং অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। অন্যদিকে, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করেছে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, দক্ষ জনবল এবং উচ্চমানের কাঁচামাল ব্যবহার করে এই খাতকে আরও প্রসারিত করা গেলে বাংলাদেশ দ্রুত একটি গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হতে পারে।

এছাড়া, নতুন বাজার অনুসন্ধান এবং বিদ্যমান বাজারের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করা দরকার। দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাজারগুলোতে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা গেলে রপ্তানি আয়ে আরও বৈচিত্র্য আসবে। পাশাপাশি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সুবিধা আরও উন্নত করতে কূটনৈতিক ও বাণিজ্য আলোচনার মাধ্যমে নতুন চুক্তি করা গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে, বহুমুখী রপ্তানি বাজার গড়ে তোলা গেলে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী ও টেকসই হবে।

এবার নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক-

আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ: আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে দেশের চলমান অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্বৃত্তায়ন, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অপরাধ দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা বাড়াতে হলে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা বা পক্ষপাতিত্ব করা হলে আইনের প্রতি জনগণের বিশ্বাস কমে যায়। একটি সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য অপরাধীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আইনের প্রতি অবজ্ঞা না দেখায়। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণ যদি দেখে যে অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এবং নিরপরাধরা সুরক্ষা পাচ্ছে, তাহলে তারা আইন মেনে চলতে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হবে।

জনগণের সম্পৃক্ততা ও আইন মেনে চলার গুরুত্ব: দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য জনগণের সক্রিয় সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। কেবল সরকার বা প্রশাসনের উদ্যোগে উন্নয়ন সম্ভব নয়; বরং সাধারণ নাগরিকদেরও রাষ্ট্রের কল্যাণে সচেতনভাবে ভূমিকা রাখতে হবে। আইন মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক দায়িত্ব। ট্রাফিক আইন মানা, কর প্রদান করা, অপরাধ দমনে সহযোগিতা করা এবং সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। দুর্নীতি, অবৈধ কার্যকলাপ ও অসততার কারণে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়। সাধারণ জনগণ যদি জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এবং দায়িত্বশীল আচরণ করে, তবে দেশ আরও দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে। সুশাসন ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে জনগণের মধ্যে আইন মেনে চলার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করতে হবে। তরুণ সমাজকে আইন মেনে চলার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

দেশকে এগিয়ে নিতে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করা জরুরি: উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনের জন্য সমাজ থেকে হিংসা, বিদ্বেষ এবং বিভেদ দূর করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকলে জাতীয় উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দলীয় সংকীর্ণতা ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা একটি জাতিকে পিছিয়ে দেয়। সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহনশীলতার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যাতে জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায়, রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও তারা জাতীয় স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করে। আমাদের দেশেও সেই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক বিভাজন ও প্রতিহিংসার বদলে জনগণের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে মানুষকে হিংসা ও বিদ্বেষের কুফল সম্পর্কে অবগত করা জরুরি।

অতীতের মত মিথ্যা মামলা যেন না হয়: বিগত শাসনামলে বহু মানুষ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। মিথ্যা মামলা, হয়রানি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারের মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষদের বিপদে ফেলা হয়েছিল। বর্তমান সরকারের উচিত এমন একটি নীতি গ্রহণ করা, যেখানে নিরপরাধরা হয়রানির শিকার না হয় এবং অপরাধীদের উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত হয়। আইনের অপব্যবহার বন্ধ করতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দরকার। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরিহার করে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি। মিথ্যা মামলা ও হয়রানির বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন হতে হবে এবং সরকারেরও দায়িত্ব নিতে হবে যেন এমন ঘটনা পুনরাবৃত্তি না ঘটে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে এবং সবার জন্য সমান বিচার নিশ্চিত হলে জনগণের আস্থা বাড়বে। এটি শুধু সরকারের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সামগ্রিকভাবে সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্যও অপরিহার্য।

রাজনৈতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় চালুর প্রয়োজনীয়তা: বাংলাদেশের শিল্পখাত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি। তবে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিংবা বন্ধ হয়ে গেছে। এটি শুধু ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্যই নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতির জন্যও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্পখাতের উন্নয়ন ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে, এসব ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করা জরুরি। রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারান, যার ফলে নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরুদ্ধারের পরিবর্তে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। এর ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয় এবং হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। তাদের পরিবারের জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, যা সামাজিক বৈষম্য এবং দারিদ্র্যের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।

শিল্পায়নের অগ্রগতিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তোলে। অনেক সময় প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের শাসনামলে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় বা তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক হয়রানি চালানো হয়। এতে শুধু উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন না, বরং জাতীয় অর্থনীতির চাকা শ্লথ হয়ে পড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও নিরুৎসাহিত করে, যার ফলে দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ দুর্বল হয়ে যায়। একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকরা চাকরি হারান, তাদের পরিবার চরম সংকটে পড়ে এবং সামগ্রিকভাবে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। যখন কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়, তখন বাজারে চাহিদাও কমে যায়, যা অর্থনীতির স্থবিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

শিল্পখাতের স্থবিরতা সরকারের রাজস্ব আদায়ের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো যখন উৎপাদন বন্ধ করে দেয় বা আয় কমে যায়, তখন কর আদায়ের পরিমাণও কমে যায়। ফলে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অর্থের অভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়া, শিল্প প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হলে আমদানি নির্ভরতা বেড়ে যায়, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুদ্ধারে যথাযথ সহায়তা দিতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি প্রণোদনা, সহজ শর্তে ঋণ এবং ট্যাক্স সুবিধা প্রদান করতে হবে, যাতে উদ্যোক্তারা পুনরায় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করতে পারেন।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রয়েছে। বর্তমান সাফল্যগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে হলে দুর্নীতি দমন, আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন, খাদ্যে ভেজাল রোধ, ব্যবসায় সিন্ডিকেট ভাঙা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। একটি সুসংগঠিত নীতি, স্বচ্ছ প্রশাসন ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। জনগণের সচেতনতা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং নৈতিকতা বজায় রাখা হলে দেশ আরও গতিশীলভাবে এগিয়ে যাবে। সময় এসেছে একসঙ্গে কাজ করার, যাতে দেশের প্রতিটি নাগরিক উন্নয়নের সুফল উপভোগ করতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

০৭ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

Website Security Test