E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ঘুষের বাজার জমজমাট

২০২৫ মার্চ ২৮ ১৭:১৮:৫৭
ঘুষের বাজার জমজমাট

মীর আব্দুল আলীম


ঘুষের বাজার এখনো বেশ জমজমাট। বাংলাদেশে ঘুষ আর দুর্নীতি যেন আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই যদি দেখি ঘুষ-দুর্নীতি উধাও, তাহলে নিশ্চিতভাবেই সেটা হবে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় গুজব! স্বাধীনতার পর থেকে আমরা দুর্নীতি দমন নিয়ে যত আলোচনা করেছি, যদি সেই কথার চাপে দুর্নীতিবাজরা পিষ্ট হতো, তাহলে অনেক আগেই তারা পাতালে চলে যেত! কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই ভাইরাস এতটাই শক্তিশালী যে, টিকা তৈরি করলেও কাজ দেবে কিনা সন্দেহ। তবে “হাল ছাড়বো না!” বাংলাদেশে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা যেন পুকুর থেকে সব মাছ ধরে ফেলার মতো কঠিন কাজ। তবে একসাথে সবাই ঠিকঠাক কাজ করলে এটা রোধ করা সম্ভব। সরকারের উচিত আইনের শাসন নিশ্চিত করা, জনগণের উচিত নৈতিকতা বজায় রাখা, আর দুর্নীতিবাজদের উচিতৃ সরাসরি তওবা করা!

ঘুষ-দুর্নীতির কারণ: ১. নৈতিকতার অভাব: আমাদের নৈতিকতার অবস্থা এখন ‘লো ব্যাটারি’ মোডে চলে গেছে। ঘুষ দিতে আর নিতে কোনো অপরাধবোধ নেই, বরং এটা এখন এক ধরনের “স্মার্টনেস”! ২. দুর্বল আইন প্রয়োগ: আইন তো আছে, কিন্তু প্রয়োগের নামে চলে আইওয়াশ! প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে আইন অনেকটা ঘুমের ওষুধের মতো—অন্যদের চোখে ঘুম নামিয়ে রাখে। ৩. জবাবদিহিতার অভাব: “আমি কাকে রিপোর্ট করব, আমি নিজেই তো বস!”—এই মানসিকতায় দেশ চললে কীভাবে হবে? ৪. নিম্ন বেতন ও উচ্চ ব্যয়: সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, “আমাদের বেতন দিয়ে সংসার চলে না।” অথচ তাদের গাড়ি, বাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ দেখে মনে হয়, ওরা অলৌকিক উপায়ে ধনী হয়ে গেছে! ৫. রাজনৈতিক প্রভাব: রাজনৈতিক লেবাস থাকলে দুর্নীতি যেন এক প্রকার “ট্যাক্স ফ্রি” ব্যবসা!

যেখানে দেখিবে ছাই, দুর্নীতি খুঁজিয়া পাই!

দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতির এমন দশা যে, টাকা সরকারি খাতে ঢোকার আগেই ‘সুইস চালে’ সুইস ব্যাংকে চলে যাচ্ছে! আমাদের স্বাস্থ্যখাতে ওষুধের বদলে পাউডার, শিক্ষাখাতে বইয়ের বদলে প্রতিশ্রুতি, আর রাস্তায় উন্নয়নের নামে গর্ত! বিশ্বব্যাংকের হিসাবে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বেহাত হয়, কিন্তু দুর্নীতিবাজদের ভুঁড়ি দেখে মনে হয়, অর্থনীতি ঠিকই উন্নতি করছে!

৫ আগষ্টের পর ভেবেছিলাম। সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। পুলিশ অন্তত আর ঘুষ থাবে না। প্রশ্ন হলো পুলিশের ঘুষ কি কমেছে? এই বিভাগে ঘুষ নামক পারদের উদ্ধগতি লখ্য করা যাচ্ছে। ভুমি অফিস, সাবরেজিষ্ট্রার াফিসথেকে শুরু করে কোথায় ঘুষ কমেছে বলতে পারেন? এদেশে ঘুষ-দুর্নীতি কমেনি, বরং বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা সংস্থা, পাসপোর্ট, বিআরটিএ, ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, পুলিশ স্টেশন, আদালত পাড়াসহ সবখানেই অনেকটা রাখঢাক না রেখেই ঘুষ গ্রহণ চলছে। ঘুষ দেয়া বা নেয়া বর্তমান সমাজে এক অনিবার্য বিধান যেন। ঘুষহীনতা মানেই এখন অস্বাভাবিক কিছু। ঘুষহীন অবস্থাটা সেবা না পাবার আশংকা তৈরি করে। ঘুষ যোগ্যতাকে শক্ত করে সব কাজের রসদ তৈরি করে। বর্তমানে গ্রহীতা ঘুষ গ্রহণে আত্মতৃপ্তি পায় কেবল তা নয়; যে ঘুষ দেয় সেও যেন এক পরম শান্তি পাচ্ছে। কারণ, ঘুষ দিতে পারা মানেই কাজটে ভালোয় ভালোয় হয়ে গেল কিংবা চাকরিটা মিলে গেল। ঘুষের শক্তি অনেক! এটাই এখন স্বাভাবিক। ঘুষহীন দিন অস্বাভাবিক হয়ে গেছে এদেশে।

যত হয়রানি তত ঘুষের অংক বাড়ে। তাই অনেক অফিসে অহেতুক লম্বা লাইনে দাঁড়ানো কিংবা কাজের সিরিয়াল থাকে। বিশেষ করে, পাসপোর্ট অফিস আর বিআরটিএতে এ দৃশ্য কমন। কাজের ব্যাপ্তি অনুসারে ঘুষের পরিমাণ নির্ধারিত কোনো কোনো দপ্তরে। সেবা প্রাপ্তি নাগরিক অধিকার। এ অধিকার অনেকটাই হরণ করেছে ঘুষ-দুর্নীতি। এক পরিসংখ্যান বলছে, ঘুষের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। তা বছরে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ঘুষ-দুর্নীতি সংখ্যায় কিছুটা কমেছে, টাকার পরিমাণে বেড়েছে অনেক। কাজ উদ্ধার করতে রাষ্ট্রের ছোট মাপের নানা কর্তাকে ঘুষ দিতে হয়, তা হলে মনে হয়, দুর্নীতি তো আরও বেড়ে গেল! কিন্তু বড় কর্তা, মন্ত্রক-আমলাদের দফতরে বন্ধ দরজার পিছনে যে সব রফা হয়, সেখানে বহু কোটি টাকার অপচয় কেউ টেরও পায় না। দুর্নীতি বেশি চোখে পড়া মানেই দুর্নীতি বেড়ে যাওয়া, এমনটা বলা তাই সহজ নয়।

এ দেশে মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে, কুচকে-মুচকে ২০-৫০ টাকা গ্রহণ করে। এটা ঘুষ। আর টেবিলের নিচে, ব্যাংক টু ব্যাংক কোটি কোটি টাকার লেনদেন, এটাও ঘুষ। আমাদের দেশে লোকে ঘুষ দেয়, যাতে সুবিধেমতো আইন ভাঙতে পারে। সহজে মানুষ ঘুষ দিতে পারে তাই দেশে আইনও ভঙ্গ হয় বেশি। আবার ন্যায্য সেবা পেতে জনগণকে ঘুষ দিতে হয়। জনগণকে সেবা পেতে হয় যদি ঘুষের বিনিময়ে, এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে যেভাবে দুর্নীতির প্রসার ঘটছে তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, লুটপাট, জালিয়াতি বেড়েই চলছে। প্রতিদিন নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

দুর্নীতি বাড়ছে তাই এখনই জনগণের সেবা খাতকে নির্ঝঞ্জাট ও দুর্নীতিমুক্ত রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি যে বাড়ছে সাদা চোখেই তা দৃশ্যমান। সরকার দুর্নীতি কমিয়ে আনাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রায় দ্বিগুণ করেছে। সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। এটা নিঃসন্দেহে সরকারের সদিচ্ছা। সদিচ্ছার প্রতিফলন নেই।

সেবা খাতের কোথাও দুর্নীতি কমেছে এমন কথা শোনা যায়নি। বরং ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে সেবা খাতের নানা অনিয়মের পাশাপাশি জোর করে ঘুষ আদায় করার অভিযোগও উঠেছে। সেবা খাতের ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে, ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। দুর্নীতির এই চিত্র যে কতোটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তার উদাহরণ উঠে এসেছে টিআইবির চলতি প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, ঘুষ ছাড়া সেবা প্রাপ্তি এখন প্রায় দুরূহ। পৃথিবীর সবদেশেই কমবেশি দুর্নীতি আছে, ঘুষের রেওয়াজ আছে।

এই কথাটির আপেক্ষিক সত্যতা মেনে নিয়েও, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় দুর্নীতির ব্যাপকতাকে অস্বীকার করার কোনো অজুহাত নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, এই দুর্নীতি জনগণের মনে ব্যাপক হতাশাবোধের জন্ম দিয়েছে। এই হতাশাবোধের মূল কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যকর ভূমিকা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। একটি গণতান্ত্রিক এবং স্বাধীন সমাজ ব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি হওয়ার কথা এসব প্রতিষ্ঠানের। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অগ্রগণ্য হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, সরকারি ও বেসরকারি আমলাতন্ত্র, জাতীয় সংসদ, সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তি খাত। আমরা বিগত কয়েক দশক ধরে এসব প্রতিষ্ঠানকে ক্রমে ধ্বংস বা অকার্যকর করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চালিত করেছি।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর প্রতিটি সেক্টরই যেন ছেয়ে গেছে দুর্নীতি ও ঘুষে। ঘুষ ছাড়া কোনো কিছুই মিলে না। এর আগে টিআইবি দেশের ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাতের ওপরে জরিপ করে দুর্নীতি ও ঘুষের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রশাসন, ভূমি, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বিআরটিএ, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, বীমা, গ্যাস সেবা খাতে এই জরিপ করেছে টিআইবি। জরিপে বলা হয়, দেশের ৮৯ শতাংশ মানুষ মনে করে, ঘুষ না দিলে কোনো সেবা মেলে না। জরিপের তথ্য মতে, গত বছর সার্বিকভাবে ঘুষের শিকার (ঘুষ দিতে বাধ্য) হওয়া খানার হার ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ।

সার্বিকভাবে দেখলে দুর্নীতির ব্যাপকতার সাথে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটি সম্পর্ক আছে। একথার সত্যতা স্বীকার করে নিয়ে বলতে হয় যে, কেবল মূল্যবোধের অবক্ষয় বাংলাদেশের দুর্নীতির ব্যাপক প্রসারের প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা জনগণের মনে যে পরিমাণ হতাশার সৃষ্টি করে তা তুলনাহীন। দুর্নীতি কেবল ওপর মহলে হয় তাই নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণকে দুর্নীতির প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। এই অংশগ্রহণের কারণ, সব ক্ষেত্রেই শুধু লোভ নয় বরং অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে ন্যূনতম জীবনযাপনের প্রচষ্টা। এই অসহায়ত্বের সাথে যুক্ত হয়েছে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃষ্টান্তের, যেখানে দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি হয় না, বরং জনগণকে মূল্য দিতে হয় সৎ থাকার জন্য। জনগণের কাছে এই ধারণা ক্রমেই দৃঢ় হয়েছে, সমাজে নীতিবান হয়ে থাকার মাঝে কোনো গৌরব নেই, বরং আছে বহু ভোগান্তি। সমাজের সুশীল অংশেও ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে বেআইনি পথে থাকার সুবিধা রয়েছে অনেক। জনগণের মনে এই ধারণা যত ক্রমবিকাশমান হচ্ছে, হতাশা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে বিরূপতা তত বেশি বেড়ে যাচ্ছে। এই হতাশার ফলে আমরা হয়ে যাচ্ছি বছরের পর বছর দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ।

সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা দেশের জনগণের মনে তীব্র হতাশার সৃষ্টি করেছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে সৃষ্টি করেছে বাধা। যতদিন এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভূমিকা কার্যকরভাবে পালন করতে পারবে না, ততদিন সমাজে দুর্নীতির ব্যাপক দৌরাত্ম্যের প্রতাপ আমাদের দেখে যেতে হবে। দুর্নীতির যে ধারণা আমরা সৃষ্টি করেছি, সেই ধারণাকে বদলাতে হবে আমাদেরই। আর তা করতে হবে কথাকে কাজে পরিণত করার মাধ্যমে। বেশিরভাগ সময়েই যারা দুর্নীতি করে তারা পার পেয়ে যায়। দুর্নীতির অভিযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমলে নেয়া হয় না, দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শাস্তি পায় না, ফলে দুর্নীতি রোধ করাও সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতি রোধে আইনের কঠোরতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি এ জাতীয় অপরাধে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ একটি প্রধান দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ, এই ধারণাটি সৃষ্টি হয়েছে দেশের আমজনতার মনে। কারণ, রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ভূমিকা পালনের অবকাশ রাখেনি। তবে ইউনুস সরকার কিছু ক্ষেত্রে ঘুষ ও দুর্নীতি কমিয়ে আশার আলো দেখাচ্ছে। যদি সরকার আরও সময় পায়, তাহলে ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি এবং এ আশায় বুক বাঁধতে চাই। এদেশে দুর্নীতিমুক্ত হউক এই প্রত্যাশা আমাদের।

লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

৩১ মার্চ ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test