E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

মহান স্বাধীনতা দিবস: আমাদের গৌরব, আত্মত্যাগ এবং বিজয়ের প্রতীক

২০২৫ মার্চ ২৫ ১৭:২৪:০৩
মহান স্বাধীনতা দিবস: আমাদের গৌরব, আত্মত্যাগ এবং বিজয়ের প্রতীক

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আগামীকাল বুধবার স্বাধীন বাংলাদেশ ৫৫ বছরে পা দিবে। মহান স্বাধীনতা দিবস ২০২৫। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায়। প্রতি বছর ২৬ মার্চ দিনটি বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধা ও গর্বের সঙ্গে পালন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ১৯৭১ সালে সংঘটিত তৎকালীন পশ্চিম পাস্তিানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র সংগ্রাম যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এই যুদ্ধের সূচনা ঘটে, যখন পাকিস্তানির সামরিক বাহিনী রাতের আঁধারে নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এই যুদ্ধ প্রায় ৯ মাস ধরে চলেছিল এবং ৩০ লাখের বেশি মানুষ শহীদ হন। এছাড়া প্রায় দুই লাখ নারী শারীরিকভাবে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, লাঞ্ছিত ও ধর্ষিত হন এবং অগনিত মানুষ ঘর ছাড়া হন এবং পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এমনকি এখনও পর্যন্ত অনেকের হদিস মেলেনি। তারা কে কোথায় আছে তা আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি। এই যুদ্ধে বাঙালি জাতির কিছু দালাল শত্রু ও পাকিস্তানি বাহিনীর তাবেদার ছাড়া মুক্তিবাহিনী, সেনা বাহিনী, নৌ বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, আনসার বাহিনী, বিডিআর বাহিনীসহ সকল শ্রেণির সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সকল স্তরের জনগন স্বতঃস্ফুর্তভাবে এমনকি ঐ সময়ে ভারত সরকারের ও সহযোগিতায় যৌথভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে এবং অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। এই দিনটি বাংলাদেশে বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুধু একটি সামরিক সংঘাত ছিল না। এটি ছিল বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এই যুদ্ধ বাঙালি জাতিকে এক নতুন দিক নির্দেশনা দিয়েছিল এবং তাদের মধ্যে জাতীয়বাদের চেতনাকে আরও শক্তিশালী করেছিল। এই যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয়। এই স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে শহীদ জিয়াউর রহমানের নাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিগত ১৭ বছরে তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলানোর অনেক ষড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু ইতিহাস কথা কয়। 

ইতিহাস কখনও মুছা যায় না। ইতিহাস কখনও কাউকে ক্ষমা করে না। ইতিহাস তো ইতিহাসই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে সকল মানুষ জানে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা কি ছিল। কিছু কুচক্রী দালাল বাটপারেরা নাম মুছে ফেলার চেষ্ট করলেও তা তারা করতে পারেনি, কারণ জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার অবদান অনস্বীকার্য। কেউ ভুলতে পারে না। ভুলার মতো নয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যখন অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করে তখন জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন মেজর। তিনি মেজর হয়েও তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং তার সৈন্যদের সংগঠিত করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

জিয়াউর রহমানের এই ঘোষণা মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি করে মুক্তিকামী মানুষের জন্য এবং সাথে সাথে দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাড়িয়ে পড়তে উৎসাহিত করে। জিয়া ছিলেন একজন দক্ষ সামরিক কর্মকর্তা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে জেড ফোর্সের নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ জয় করেন। তদানীন্তন সময়ে জিয়াউর রহমান গেরিলা যুদ্ধের কৌশল তৈরী ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেই সময়ে তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন গেরিলা অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সাহসী ও দৃঢ়চেতা নেতা। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ধরে রাখতে এবং তাদের মধ্যে দেশ প্রেমের চেতনা জাগিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

এই মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কারণে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত স্মরণীয়-বরণীয় এবং দেশ রক্ষার গ্রহণযোগ্য একজন অমর ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হন। তিনিই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা, দেশ নায়ক, দেশ প্রেমিক যে একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ও এ দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও কাদা মাটিতে নেমে, খালে নেমে, কোদাল হাতে নিয়ে জনগণ কে সংগে নিয়ে খাল খনন, নদী খননসহ অনেক কাজ হাতে নিয়ে এ দেশের জনগণকে শাসন শোষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ছিলেন অন্যন্য, ব্যতিক্রমধর্মী একজন দেশপ্রেমিক শাসক। জাতি আজ শ্রদ্ধার সাথে এই মহান ব্যক্তিকে চির স্মরণীয় করে রেখেছেন তাদের হৃদয়ে। তাই স্বাধীনতা দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিক দিবস নয়; এটি জাতির আত্মপরিচয়ের, আত্মত্যাগের এবং গৌরবের প্রতীক।

মহান স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য

স্বাধীনতা দিবস শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক দিন নয়; এটি বহুমাত্রিক গুরুত্ব বহন করে।

১. জাতীয় পরিচয় ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক: স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় পরিচয় গঠনের মূল ভিত্তি। একসময় বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র ছিল না, তারা শোষিত ও নিপীড়িত ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি। এ দিনটি আমাদের জাতীয়তা ও নিজস্ব সংস্কৃতির গৌরবময় স্বীকৃতি।

২. মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা: ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দিন। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। জাতি এ দিনটিতে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে শহীদদের স্মরণ করে।

৩. স্বাধীনতার চেতনা সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া: স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক অর্জন নয়, এটি নৈতিক ও আদর্শিক বিষয়ও। এই চেতনা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা দেশের প্রতি দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে।

৪. অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অনুপ্রেরণা: স্বাধীনতার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক কাঠামোর উন্নয়নে অগ্রসর হয়েছে। স্বাধীনতা দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এই অর্জনকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের স্ব-নির্ভর হতে হবে।

৫. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য জোরদার: এই দিবস দেশের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ও ঐক্যের বার্তা বহন করে। ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে এ দিনটি উদযাপন করে, যা জাতীয় ঐক্যকে শক্তিশালী করে।

স্বাধীনতা দিবস উদযাপন

বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবস অত্যন্ত উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে পালিত হয়। এদিন ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে সূচনা হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হয়। টেলিভিশন ও রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। দেশব্যাপী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মেলা ও নাটক প্রদর্শিত হয়, যা জাতীয় সংস্কৃতিকে আরো সমৃদ্ধ করে।

স্বাধীনতা দিবসের চেতনা ও বর্তমান বাস্তবতা

স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেতনা বাস্তবায়ন করাও ততটাই জরুরি। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেরও বেশি সময় পরেও আমরা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

১. দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য: বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে গেলেও এখনো দারিদ্র্য ও আয়ের বৈষম্য রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যা বাস্তবায়নে এখনো কাজ করতে হবে।

২. গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: স্বাধীনতার মূল আদর্শ ছিল গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতি এই লক্ষ্য অর্জনে বাধা সৃষ্টি করছে। স্বাধীনতা দিবস আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন করে।

৩. শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন: একটি সত্যিকারের স্বাধীন জাতি গঠনের জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে দেশ আরও স্বাবলম্বী হতে পারে।

৪. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা: বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ, কিন্তু মাঝে মাঝে বিভেদ তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন করা, যা আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

পরিশেষে বলতে চাই, মহান স্বাধীনতা দিবস আমাদের জাতীয় গৌরব ও চেতনার প্রতীক। এই দিনটি শুধু উৎসবের নয়, বরং আত্মবিশ্লেষণেরও সময়। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, কিন্তু এর প্রকৃত সুফল পেতে হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসার, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা—এসবই স্বাধীনতার পূর্ণতা এনে দিতে পারে।

স্বাধীনতা দিবস আমাদের জাতীয় দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, যাতে আমরা জাতির অগ্রগতি ও কল্যাণে অবদান রাখতে পারি। স্বাধীনতা অর্জনের মতো, স্বাধীনতার সুফল রক্ষা করাও আমাদের সবার দায়িত্ব। একসাথে কাজ করলে তবেই আমরা বাংলাদেশকে সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে পারবো।

লেখক : সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

২৬ মার্চ ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test