E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

ধর্ষিত সমাজ ও বিবেকের অপমৃত্যু

২০২৫ মার্চ ১০ ১৮:০৪:১০
ধর্ষিত সমাজ ও বিবেকের অপমৃত্যু

মীর আব্দুল আলীম


"ধর্ষণ" একটি শব্দ যা শুধুমাত্র এক নারীর, এক শিশুর, এক ব্যক্তির জীবনের ট্র্যাজেডি নয়; এটি একটি সভ্যতার কলঙ্ক, নৈতিকতার চরম অবক্ষয়। আমরা উন্নতির গল্প শুনি, সভ্যতার জয়গান গাই, কিন্তু আজ আমাদের শহরের বাতাস বিষাক্ত, নীরবতাও যেন চিৎকার করে কাঁদে। একটার পর একটা ধর্ষণের ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটে যাচ্ছে, অথচ সমাজের বিবেক যেন কোনো এক অন্ধকার গুহায় নিদ্রামগ্ন।

সমাজ যখন ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে ব্যর্থ হয়, তখন ধর্ষণ কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে রয়ে যায় না; এটি প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধে পরিণত হয়। প্রতিদিন সংবাদমাধ্যম খুললেই চোখে পড়ে- স্কুলগামী মেয়েটা ধর্ষিত হলো। মাদ্রাসার শিক্ষার্থী শিক্ষক দ্বারা নিপীড়িত। বাড়ির কাজের মেয়ে গৃহকর্তার লালসার শিকার। পথের কিশোরী রাতের অন্ধকারে ধর্ষিত হলো। বাসে ধর্ষিত নারী। এই গল্পগুলো নতুন কিছু নয়। একের পর এক মেয়েরা, শিশুরা, নারীরা, আয়া, বুয়া, বৃদ্ধা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, কিন্তু সমাজ কি বদলেছে?

নির্যাতিতাদের কান্না শুনতে পায় আকাশের তারা, রাতের নীরবতা, ধর্ষিত শিশুর ছেঁড়া পুতুলও সব শুনতে পায়- কিন্তু শুনতে পায় না এই সমাজ! ধর্ষকরা প্রকাশ্যে হাঁটে, চায়ের দোকানে বসে রাজনীতির কৌশল শেখে, টক শো-তে মুখরোচক কথা বলে। এই বাস্তবতা আমাদের সভ্যতার মুখে চপেটাঘাত ছাড়া আর কিছু নয়।

ধর্ষণের ভয়াবহতা

একটি ধর্ষণের ঘটনা শুধু একটি মেয়ের জীবনের নয়, এটি একটি সমাজের ধ্বংসপ্রক্রিয়া। ধর্ষিতা মেয়েটি শারীরিকভাবে বেঁচে থাকলেও মানসিকভাবে প্রতিনিয়ত মরে যায়। সমাজ তাকে ‘কলঙ্কিত’ বলে দূরে ঠেলে দেয়, পরিবার অনেক সময় তাকে বোঝা মনে করে, আর বিচার? সেটি হয় না বললেই চলে।
একটা মেয়ের স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করবে, বড় হবে, কিন্তু ধর্ষণের পর তার পরিচয় দাঁড়ায় ‘ধর্ষিতা’।
একটা শিশুর স্বপ্ন ছিল, কিন্তু সমাজ তার শৈশব কেড়ে নিল। একটা নারীর স্বপ্ন ছিল সংসার হবে, ভালোবাসবে—কিন্তু এক রাতের নির্মমতা তাকে নিঃশেষ করে দিল।

এই বাস্তবতা প্রতিদিন আমাদের শহরের গলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ছে। একটা মেয়ে রাতে বের হতে ভয় পায়, একটা মা চিন্তিত থাকে তার কিশোরী মেয়েকে স্কুল পাঠানোর সময়, একটা শিশু আর নির্ভয়ে খেলতে যেতে পারে না।

সমাজের ভয়ের সংস্কৃতি ও নারীর জীবনসংকট

নারীর জীবনসংকট ও ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে পুরো সমাজে। একটি মেয়ে রাতের অন্ধকারে রাস্তায় বের হওয়ার আগে একশবার ভাবে, কিন্তু একজন পুরুষ নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়।
একটি মা তার মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর আগে প্রতিদিন আতঙ্কে থাকে, কারণ তার মনে প্রশ্ন জাগে—সে কি নিরাপদে ফিরবে? একটি শিশু আর বন্ধুদের সঙ্গে মুক্ত মনে খেলা করতে পারে না, কারণ সমাজ তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। নারীরা আজ নিজেদের দোষী ভাবতে শুরু করেছে, তাদের চলাফেরা, পোশাক, কথাবার্তা সবকিছুতেই যেন সমাজের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। অথচ মূল অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বিচারহীনতা ধর্ষকদের আস্কারা দেয়

যে সমাজ ধর্ষককে চায়ের দোকানে বসিয়ে রাখে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আগলে রাখে, তাদের মুখরোচক বক্তৃতায় সম্মান দেয়, সে সমাজে ধর্ষণের সংখ্যা বাড়বেই। আমরা দেখেছি,‌ ধর্ষক রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে পার পেয়ে যায়।‌ প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান হলে মামলা ‘ফাইলবন্দি’ হয়ে যায়। কোনো মাদ্রাসার শিক্ষক হলে, সমাজ বলে ‘ধর্মীয় ব্যক্তি, কুৎসা রটানো হচ্ছে’। বিচার পেতে গেলে উল্টো নির্যাতিতাকে দোষারোপ করা হয়-‘মেয়েটার পোশাক ঠিক ছিল না’, ‘ও কেন রাতে বের হয়েছিল?’ এভাবেই একটি রাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। সমাজ ধর্ষকদের রক্ষা করতে ব্যস্ত, আর ধর্ষিতা বিচার চেয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকে।

ধর্ষণ বন্ধ করা কি সম্ভব

ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব, যদি আমরা ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে সচেতন হই। পরিবার থেকে সন্তানদের শেখাতে হবে, ধর্ষণ শুধু অপরাধ নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক ব্যাধি। ছেলেদের শেখাতে হবে নারীর প্রতি সম্মান কীভাবে দেখাতে হয়। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যেন অপরাধীরা বেরিয়ে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণের শাস্তি দ্রুত কার্যকর করতে হবে। ধর্ষকের পরিচয় বড় নয়, অপরাধ বড়। রাজনৈতিক দলগুলোকে ধর্ষকদের রক্ষা করা বন্ধ করতে হবে। রাস্তায় পর্যাপ্ত সিসিটিভি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে, যাতে কেউ নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে।

সমাধানের পথ কোথায়?

এই ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে মুক্তি পেতে হলে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে।

১. বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। ধর্ষণের দ্রুত ও কঠোর বিচার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অপরাধীরা ভয় পায়।

২. নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। ধর্ষিতাকে ‘অপমানের প্রতীক’ নয়, বরং একজন বীরযোদ্ধা হিসেবে দেখতে হবে, যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও বেঁচে আছে।

৩. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নারীদের আত্মরক্ষা প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং সমাজে নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

৪. সমাজের নীরবতা ভাঙতে হবে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে, যাতে অপরাধীরা বুঝতে পারে, এটি কোনো ‘সাধারণ’ অপরাধ নয়, এটি একটি সামাজিক ব্যাধি।

আমরা এভাবে আর কতদিন চুপ থাকবো?একটা সমাজের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য তখনই ঘটে, যখন মানুষের বিবেক মরে যায়। আমরা কি সেই মৃত বিবেকের সমাজে বাস করছি? নাকি এখনো আমাদের কিছু করার আছে? একটি শিশু ধর্ষিত হলে, শুধু সে একা কাঁদে না। এই সমাজ, সভ্যতা কাঁদে। ধর্ষণের প্রতিটি ঘটনা আমাদের জন্য কলঙ্ক। আমরা কি চাই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এমন একটা সমাজ রেখে যেতে, যেখানে মায়েরা সারাক্ষণ সন্তানের নিরাপত্তার জন্য আতঙ্কে থাকবে?

আজ সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর। নীরবতা ভাঙতে হবে, বিচার চাইতে হবে, অপরাধীদের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর অধিকার কেড়ে নিতে হবে। নাহলে একদিন আমাদের প্রতিটি সকাল হবে ‘নষ্ট সকাল’, প্রতিটি রাত হবে ‘রক্তমাখা রাত’, আর আমরা শুধু শুনবো- ছি! সভ্যতা মরে গেছে!

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

১১ মার্চ ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test