E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

মহা শিবরাত্রির ইতিহাস ও জগতের মঙ্গল কামনা 

২০২৫ ফেব্রুয়ারি ২৫ ১৭:১৮:৩৮
মহা শিবরাত্রির ইতিহাস ও জগতের মঙ্গল কামনা 

মানিক লাল ঘোষ


সনাতনীদের ভাবনায় শিব দেবাদিদেব মহাদেব। ব্রহ্মা-বিষ্ণুর সঙ্গেই উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। একদিকে শিব মহাপ্রলয়ের দেবতা আর অপরদিকে কল্যাণ সুন্দর। পণ্ডিতগণ মনে করেন শিব প্রাগার্য সংস্কৃতির দেবতা। মহেঞ্জোদরোর একটি শিলে পশুপতির প্রতিকৃতি খোদিত দেখা যায়। আবার বৈদিক রুদ্র ছিলেন বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ঝড়ঝঞ্ঝার দেবতা। শিবের সঙ্গে এই রুদ্র সম্ভবত পরে  মিলেমিশে যান। 

শিবপত্নী উমা-পার্বতী। যুগ যুগ ধরে ভারতীয় উপমহাদেশপ দাম্পত্যের শ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। গুপ্ত-পাল-সেন পর্বে উমা-মহেশ্বরের যুগ্মমূর্তি বেশ জনপ্রিয় ছিল। বাংলার বিভিন্ন স্থানে এমন প্রস্তরমূর্তি অনেক দেখা গিয়েছে। পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার বিভিন্ন গ্রামে আজও হরগৌরীর প্রস্তরমূর্তি পূজা করা হয়। এছাড়াও কলিগ্রামে, মঙ্গলকোটের বনকাপাশি কিংবা কাটোয়ার বিকিহাটসহ অনেক গ্রামে এখনো কুমারী মেয়েরা মনের মতো বরের কামনায় শিবপূজা করেন। ভৌগোলিক সীমানার প্রাচীর ডিঙিয়ে বাংলাদেশের সনাতনী কণ্যাদের ওপরেও এর প্রভাব পড়েছে। শিব-পার্বতীর বিয়ের মূর্তিকে বৈবাহিক,পাণিগ্রহণ, কল্যাণসুন্দর মূর্তি বলা হয়। বিভিন্ন গুহাশিল্পে, মন্দিরগাত্র কিংবা স্বতন্ত্র মূর্তিফলক হিসেবে এই মূর্তি নান্দনিক শিল্পকর্ম হিসেেবে দেখা যায়।

শিবপুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ প্রভৃতি পুরাণে, মহাকাব্যে, প্রাচীন সাহিত্যে শিবের গার্হস্থ্য জীবন বর্ণিত হয়েছে। শিবের গলায় মালা দিয়েছিলেন দক্ষকন্যা সতী। শিবের চালচলন, পোষাক,ও সাংসারিক জীবনের প্রতি উদাসিনতার কারণে শিব-বিরোধী দক্ষ এক বার শিবহীন যজ্ঞের আয়োজন করলেন। সেখানে সতীর উপস্থিতিতে শিবের নিন্দা শুরু হল। সতী, পতির অপমান সইতে না পেরে যজ্ঞকুণ্ডে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। স্বামীর প্রতি সতীর এই ভালোবাসা, তার অপমানে আত্ম বিসর্জনে শিব দিশেহারা ও কোধান্বিত হয়ে দক্ষযজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করে সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নাচনে মেতে উঠলেন। সৃষ্টি বুঝি রসাতলে যায়। বিষ্ণু সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন বৃহত্তর ভারতবর্ষে। তার পরে মহাদেব গভীর ধ্যানে ডুবে গেলেন।

এ দিকে, সতী জন্ম নিলেন হিমালয়কন্যা উমা রূপে। স্বর্গরাজ্য তখন অসুর, দানবদের করতলে। তারকাসুরকে বধ করতে চাই শক্তিশালী দেবসেনাপতি। ব্রহ্মা বললেন, যেমন করেই হোক উমার সঙ্গে মহেশ্বরের বিবাহ দিতে হবে। তবেই জন্ম হবে কার্তিকের। দেবতাদের প্রচেষ্টায় গৌরীর তপস্যায় মদন ভস্মের পরেই হরগৌরীর পরিণয় সুসম্পন্ন হয়।

পুরাণ-লোকশ্রুতি অনুসারে শিব-গৌরীর বিয়ের স্থানটি উত্তরাখণ্ডে রুদ্রপ্রয়াগ জেলার ত্রিযুগীনারায়ণ গ্রামে। মন্দাকিনী ও শোনগঙ্গার মোহনায় অবস্থিত এই পৌরাণিক জনপদটি ছিল হিমালয় রাজার রাজধানী। এই বিবাহ দিয়েছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। আর নারায়ণ গৌরীকে সমর্পণ করেন শিবের হাতে। চৈত্র মাসে শিবগাজন উৎসব অনেকের মতে হর-কালীর বিয়ের অনুষ্ঠান। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি লিখেছেন, ‘‘শিবের গাজনের প্রকৃত ব্যাপার হর-কালীর বিবাহ। সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী। তাহাদের গর্জন হেতু গাজন শব্দ আসিয়াছে। ধর্মের গাজনে মুক্তির সহিত ধর্মের বিবাহ হয়। দুই বিবাহ-ই প্রচ্ছন্ন।’’

পৌরাণিক মতে, হরগৌরীর বিবাহ হয় শিবরাত্রির পুণ্যলগ্নে। অনেকেই বলেন, প্রতি কৃষ্ণপক্ষের চৌদ্দতম রাত্রিই শিবরাত্রি। কিন্তু ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চৌদ্দতম রাত্রি হল মহাশিবরাত্রি। এই মহা শিবরাত্রি মূলত শিবচতুর্দর্শী নামে অভিহিত।এই রাত্রিকে বছরের সবচেয়ে অন্ধকার রাত বলে মনে করা হয়। এই রাতেই মহাদেব গৌরীর পাণিগ্রহণ করেন। এ দিন ভারত ও বাংলাদেশের বহু শিবমন্দিরে হরগৌরীর বিবাহ অনুষ্ঠান কোথাওবা এ উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

কেউ কেউ পুণ্য সঞ্চয়ের অভিলাষ, কেউ কেউ দীর্ঘলালিত মনোস্কামনা পূরণের আশায় ভক্তি আর বিশ্বাসে ফাগুনের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে পালণ করে শিবরাত্রি।এই শিবরাত্রির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা কাহিনি এবং কিংবদন্তি। উৎসবের আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা রীতি রেওয়াজ। কোথাও শিব–পার্বতীর বিয়ে, কোথাও বা নানা উপচার নির্বিশেষে সারা দিনের উপবাসের শেষে শিবের পুজো করে থাকেন পুণ্য লাভের আশায়। এমনটাই তো চলে আসছে যুগ যুগান্তর ধরে।

এই শিবরাত্রি নিয়ে শোনা যায় এক প্রচলিত কাহিনি। কাশীতে এক ব্যাধ বাস করত। সারা দিন বনে শিকার করে সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরত। এমনই এক বনে গিয়ে সারাদিন অনাহারে ক্লান্ত সেই ব্যাধ একটি গাছের নীচে বিশ্রাম নিচ্ছিল। যখন তার ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। ব্যাধ বুঝতে পারল সে দিন আর গভীর জঙ্গল অতিক্রম করে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। তাই ঠিক করল একটি গাছের উপরে রাত কাটিয়ে পর দিন বাড়ি ফিরবে। কাছেই ছিল একটি প্রাচীন বেলগাছ। ব্যাধ তখন কাছেই একটি বেলগাছের ডালে শিকারগুলিকে বেঁধে রেখে নীচে একটি শক্ত ডালের উপরে বসে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সেই বেলগাছের কাছেই একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ছিল। গাছের উপরে ব্যাধের নড়াচাড়ার ফলে একটি বেলপাতা সেই শিবলিঙ্গের উপরে গিয়ে পড়ে। সে দিন ছিল শিবচতুর্দশী বা শিবরাত্রি। নিজের অজান্তেই উপবাসী থেকে বেলগাছের একটি পাতা শিবলিঙ্গের উপরে পড়ায় সেই ব্যাধের ব্রত পালন হয়ে গিয়েছিল। পর দিন বাড়ি ফিরে, স্নান সেরে সে খেতে বসবে, এমন সময় তাঁর বাড়িতে অতিথি এসেছিল। ব্যাধ অতিথি সেবার রীতি মেনে খাওয়ানোরও ব্যবস্থা করল। ফলে নিজের অজান্তে সে ব্রতের সম্পূর্ণ ফল লাভ করেছিল। বহু বছর পরে ব্যাধের মৃত্যুর সময় এক দিকে যমদূতেরা, অন্য দিকে শিব দূতেরা তাকে নিতে উপস্থিত হল। এই নিয়ে যুদ্ধও বেঁধে গেল। অবশেষে যখন যমদূতরা কৈলাসে শিবের কাছে নালিশ করতে গিয়েছিল ঠিক তখনই শিবের প্রহরী নন্দী যমদূতদের বলেন, যেহেতু ব্যাধ শিবচতুর্দশীর ব্রত পালন করে পুণ্য অর্জন করেছে তাই তাকে যমদূতেরা নিয়ে যেতে পারেন না। যমদূতরা, যমরাজের কাছে গিয়ে যখন এ কথা জানাল যমরাজ নাকি বলেছিলেন, এই ব্রত যে পালন করবে তার উপর যমের কোনও অধিকার থাকবে না। এই ব্রত মানুষকে সর্ব পাপ থেকে উদ্ধার করে। সেই বিশ্বাস নিয়ে পুণ্যার্জনের আশায় নারী-পুরুষ যুগ যুগ ধরে এই ব্রতের পালন করে আসছে।

সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায় সিন্ধু সভ্যতার যুগেও বিক্ষিপ্ত ভাবে লিঙ্গ রূপে শিব পূজিত হতেন। পরবর্তী কালে বৈদিক যুগে রুদ্রের সঙ্গে তিনি মিলিত হলেন। তবে প্রাক আর্য যুগ থেকেই শিব ঊর্বরতা এবং প্রজননের দেবতা হিসেবে পূজিত হয়েছেন। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্যান্য নানা গুণ।

ব্রতকথা অনুযায়ী, শিবরাত্রি ব্রতের ব্যাখ্যা করেন মহাদেব স্বয়ং। পার্বতী মহাদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, প্রভু, এমন এক সহজ ব্রত বলে দিন, যা সকলেই পালন করে পাপমুক্ত হতে পারে। মহাদেব বললেন, ‘ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে যে ভয়ানক অন্ধকার রাত্রি হয়, তা-ই শিবরাত্রি। শিবরাত্রিতে যে উপবাস করে, আমি তার উপর খুব সন্তুষ্ট হই।… শিবরাত্রিতে চার প্রহরে চারটি গঙ্গামাটির শিব গড়ে পূজা করবে।… ওই দিন রাত্রি জাগবে…’ পুজোর উপকরণ সরল, বেলপাতা আর গঙ্গাজলই যথেষ্ট। জটিল মন্ত্রতন্ত্র কিছু নেই, দীর্ঘ প্রস্তুতিরও প্রয়োজন নেই। সাধে কি আর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্রত, সহজে পাপমুক্তি আর সপরিবার মঙ্গলের ব্যবস্থা!

জাগতিক পাপমোচন ও পরিবারের মঙ্গলকামনায় প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশীতে সনাতনধর্মালম্বীরা ভক্তি সহকারে শিব পূজা করে আসছেন।আর আবাহনকাল থেকেই বাঙালিরা
অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী বলে শিবপূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে যে মেলা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় তা আজ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সার্বজনীন আনন্দ মেলায় পরিনত হয়ে বাঙালির লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

লেখক : ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সহ সভাপতি এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক।

পাঠকের মতামত:

০৬ মার্চ ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test