E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম: কাব্য চর্চার উর্বর ক্ষেত্র

২০২৫ জানুয়ারি ২৯ ১৭:৩০:১৬
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম: কাব্য চর্চার উর্বর ক্ষেত্র

মীর আব্দুল আলীম


সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কাব্যচর্চার জন্য এক উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এর ব্যবহার যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সবখানে ছাপ রেখে যাচ্ছে, তেমনি এটি সাহিত্য ও কাব্য চর্চার ক্ষেত্রেও বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছে। বিশেষ করে করোনার মহামারির সময়, যখন মানুষ ঘরবন্দী হয়ে পড়েছিল, তখন এই মাধ্যম হয়ে ওঠে মানুষের মন খুলে বলার জায়গা। মহামারির সময় মানুষ ঘরে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করার চেষ্টা করে। জীবনের অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক দূরত্বের প্রভাব কবিতা লেখায় উদ্বুদ্ধ করে অনেককে। এই সময়ে নবীন কবিদের সক্রিয়তা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই কবিতার মাধ্যমে ভেতরের হতাশা বা আশা প্রকাশ করতে শুরু করে।

করোনার সময় মানুষ যখন জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিল, তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটি সান্ত্বনার আশ্রয় হয়ে ওঠে। এই মাধ্যমের মাধ্যমে মানুষ তার একাকিত্ব দূর করার পাশাপাশি সৃষ্টিশীলতার পথে পা বাড়ায়। কবিতা, গল্প, বা প্রবন্ধ—সবই যেন ঘরবন্দী জীবনের হতাশা, ভীতি, ও আবেগকে প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ উপায় হয়ে ওঠে। করোনার পরপরই বিভিন্ন অনলাইন সাহিত্য সংগঠন গড়ে ওঠে। নিয়মিত সাহিত্য আসর, প্রতিযোগিতা এবং কবিতা পাঠের লাইভ আয়োজন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তৈরি করে। এ সময় কবিতা চর্চা যেমন প্রসারিত হয়েছে, তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নতুন লেখক-কবিদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে।
কোভিডকালীন সময় যেমন কাব্যচর্চার উত্থান ঘটে তেমনি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকেও কেন্দ্র করে কবিতা ও সাহিত্যচর্চার নতুন মাত্রা তৈরি হয়। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং করোনার সংকট যেন মানবমনের সৃষ্টিশীলতাকে নতুন করে জাগ্রত করে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যা ৩৬ দিনব্যাপী চলেছিল, তাতে কবিতা প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে।

এই আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অনেক সাহিত্যিক এবং কবিতা প্রেমী মানুষ তাদের ভাবনা, প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিবাদ প্রকাশ করেন। কবিতা শুধু আন্দোলনের কণ্ঠস্বর নয়, বরং একটি ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। বিশেষত, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় অনেক মানুষকে কবিতা ও সাহিত্যচর্চায় সরব হতে দেখা গেছে। আন্দোলনের স্লোগান থেকে শুরু করে কবিতার ছত্রে ছত্রে প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছে। তখন অনেকেই উপলব্ধি করেছিল যে, সাহিত্য কেবল আত্মপ্রকাশের মাধ্যম নয়; এটি একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের হাতিয়ারও হতে পারে। তবে মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা এবং গঠনমূলক সমালোচনা। প্রবীণ ও নবীনদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় কাব্যচর্চার গুণগত মান বৃদ্ধি সম্ভব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই উত্থান যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে তা দেশের সাহিত্য সংস্কৃতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

নিজস্ব সম্পাদনায় কবিতা প্রকাশ সুফল ও সীমাবদ্ধতা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, যে কেউ খুব সহজে তার লেখা প্রকাশ করতে পারে। পত্রিকার মতো অপেক্ষা করতে হয় না কিংবা সম্পাদকের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। এটি অনেক নবীন কবি বা লেখকের জন্য একটি আশীর্বাদ। তারা তাদের সৃষ্টিশীল চিন্তা বা অনুভূতি মুহূর্তের মধ্যে প্রকাশ করতে পারে। তবে এই সুবিধার পাশাপাশি কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। সম্পাদনার অভাবের কারণে অনেক সময় কবিতার গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বানান ভুল, ছন্দপতন বা ভাবগত অস্পষ্টতা রয়ে যায়, যা পাঠকের জন্য বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে। আবার, এই মাধ্যমের সহজলভ্যতা লেখার মান যাচাইয়ের প্রথাগত পদ্ধতিকে দুর্বল করেছে। তবে আশার কথা হলো ঐসময়ে যারা কবিতা লেখা শুরু করে শুরুতে কবিতার মান যা ছিলো দিনে দিনে সেই মান অনেক গুণে বেড়েছে। দুর্বল শব্দ চর্চার নবীণ অনেক কবি এখন নিয়ম মেনে ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লিখতে সক্ষম। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছিল আমাদের সময়ের অন্যতম সামাজিক জাগরণের উদাহরণ। এই আন্দোলনে তরুণ থেকে প্রবীণ, সবাই বিভিন্নভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। কবিতা ছিল এই আন্দোলনের অন্যতম মাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কবিতার মাধ্যমে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা তৈরি হয়। অনেকেই এই সময়ে প্রথমবার কবিতা লিখতে শুরু করেন। কেউ কেউ তাদের আবেগ প্রকাশ করেছেন, কেউ সমাজের অসঙ্গতিকে তুলে ধরেছেন। কবিতায় প্রতিবাদী ভাষা, চেতনা ও সাহস মিশে এক নতুন মাত্রা তৈরি করে। সব কিছুরই কিছু ভালো ও মন্দ দিক থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কবিতা চর্চার উত্থান যেমন ইতিবাচক দিক নিয়ে এসেছে, তেমনি কিছু সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট।

ভালো দিক

১. নবীন লেখক- কবিরা সহজেই তাদের সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করার সুযোগ পান।

২. বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

৩. তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়ার ফলে লেখকরা তাদের কাজের ভালো-মন্দ দিক বুঝতে পারেন।

৪. আন্দোলন বা সামাজিক ইস্যু নিয়ে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে কবিতা আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

মন্দ দিক

১. মানহীন লেখার আধিক্য অনেক সময় পাঠকের বিরক্তির কারণ হয়।

২. গঠনমূলক সমালোচনার অভাব লেখকদের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

৩. অনেক জনপ্রিয় কবি এই প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় না থাকায় নবীনদের দিকনির্দেশনা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

৪. অনেক ক্ষেত্রে একই ধরনের বিষয় বা আবেগঘন লেখার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়, যা পাঠককে একঘেয়ে করে তোলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপ্তি আজ শুধু যোগাযোগের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি সৃষ্টিশীলতারও এক বিশাল ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধসহ নানাবিধ সাহিত্যচর্চায় এই মাধ্যম অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখছে। তবে সৃষ্টিশীলতার এই উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মানের অবনতি এবং দায়িত্বহীন প্রকাশের প্রবণতা একটি উদ্বেগজনক দিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মান উন্নয়নে করণীয় : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কবিতা চর্চার মান উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

১. সম্পাদনার গুরুত্ব দেওয়া: লেখাগুলো প্রকাশের আগে পেশাদার সম্পাদকের পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

২. সাহিত্য সংগঠনের প্রসার: অনলাইন সাহিত্য সংগঠনগুলোকে আরও সক্রিয় করা উচিত। প্রতিযোগিতা, কর্মশালা ও লাইভ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে লেখকদের দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব।

৩. গঠনমূলক সমালোচনা: পাঠকদের উচিত লেখার প্রতি সঠিক মন্তব্য ও পর্যালোচনা করা, যা লেখকদের উন্নতির পথ দেখাবে।

৪. জনপ্রিয় কবিদের অংশগ্রহণ: প্রতিষ্ঠিত কবিদের এই প্ল্যাটফর্মে আরও সক্রিয় হতে উৎসাহিত করতে হবে।

৫. নতুন লেখকদের জন্য প্রশিক্ষণ: নবীন কবিদের জন্য অনলাইন প্রশিক্ষণ বা কর্মশালার আয়োজন করলে তাদের মানসিক এবং সাহিত্যিক দক্ষতা বাড়বে।

৬. স্থানীয় সংগঠনকে শক্তিশালী করা: জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সাহিত্য সংগঠনগুলোকে কার্যকরী করতে প্রশাসনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উপজেলা জেলা পর্যায়ে গড়ে ওঠা নতন সাহিত্য সংগঠনগুলোকে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা জরুরী। সেসব সংগঠনের জন্য জমি বরাদ্ধ দেওয়াসহ ভবন নির্ন্মানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সেসঙ্গে নিজনিজ জেলা উপজেলার প্রবীন কবি সাহিত্যিকদের নতুন গড়ে ওঠা সংগঠনকে এগিয়ে নিতে এবং মানোন্নয়নে ভুমিকার রখতে হবে।

৭. প্রবীণদের ভূমিকা: প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ কবিদের নবীনদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া এবং পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত।

৮. প্রকাশনা সহায়তা: নবীনদের জন্য সাশ্রয়ী ব্যয়ে বই প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি।

৯. সাহিত্য কর্মশালা: স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সাহিত্য কর্মশালার আয়োজন করা প্রয়োজন, যেখানে নবীনরা দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবে।

১০. নতুনদের উৎসাহ: নতুন লেখকদের লেখা জাতীয় দৈনিক ও সাহিত্য ম্যাগাজিনে জায়গা দিতে হবে, যাতে তারা আরও উৎসাহ পায়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আজকের দিনে কাব্যচর্চার জন্য এক নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষত ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম বা ব্লগ, তরুণ প্রজন্মকে কাব্যচর্চার দিকে আকৃষ্ট করেছে। এখানে নবীন থেকে প্রবীণ সবাই তাদের সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করতে পারে। তবে এই মাধ্যমের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে গুণগত মান রক্ষা, গঠনমূলক সমালোচনা এবং দক্ষ পরিচালনার দিকে নজর দিতে হবে। করোনা কালীন সময় এবং বৈষম্য বিরোধ আন্দোলন আমাদের শিখিয়েছে যে, সাহিত্য শুধু সৃষ্টির আনন্দ নয়; এটি পরিবর্তনের হাতিয়ার। যদি আমরা সঠিকভাবে এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করতে পারি, তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কাব্যচর্চার জন্য একটি শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষেত্র হিসেবে টিকে থাকবে।

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

৩০ জানুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test