E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সফলতা ও ব্যর্থতা এবং সমাধানের উপায় 

২০২৫ জানুয়ারি ১৮ ১৭:০৯:৫৬
বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সফলতা ও ব্যর্থতা এবং সমাধানের উপায় 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বাংলাদেশে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা খাত সাধারণত দুটি উপশাখায় বিভক্ত জনস্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা শিক্ষা। সুস্বাস্থ্য মানুষের অন্যতম প্রধান চাহিদা এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ লাভ সবার মৌলিক অধিকার। স্বাস্থ্যখাত একটি দেশের উন্নয়ন ও মানুষের জীবনমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরের নানা প্রচেষ্টা, অর্জন, ব্যর্থতা এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার মান ও সেবা ব্যবস্থার উন্নতি সম্ভব হয়েছে, তবে এখনো অনেক সমস্যা রয়ে গেছে।চিকিৎসা ব্যবস্থা একটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। এটি শুধু মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে না, বরং জাতীয় অর্থনীতিতেও বড় ভূমিকা রাখে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ চিকিৎসা খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করলেও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। চিকিৎসা সেবা অর্জনে সফলতা যেমন রয়েছে, তেমনি নানা ব্যর্থতাও বিদ্যমান। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সফলতা ও ব্যর্থতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

চিকিৎসা ব্যবস্থার সফলতা

১. স্বাস্থ্যসেবা খাতে প্রভূত উন্নতি: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জিত হয়েছে, বিশেষ করে মহামারি ও জরুরি স্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলায়। বাংলাদেশে জন্মহার কমেছে, শিশুমৃত্যুর হারও অনেক কমে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একসাথে কাজ করে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি করেছে।

২. শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমানো: গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। প্রসূতি ও নবজাতক সেবার উন্নতির ফলে বর্তমানে মাতৃমৃত্যু হার প্রতি ১ লাখ জীবিত জন্মে ১৭৩ থেকে কমে এসেছে প্রায় ১৬৫-তে। একইভাবে, শিশুমৃত্যু হার প্রতি ১০০০ জীবিত জন্মে ৩০-এর নিচে নেমে এসেছে।

৩. টিকাদান কর্মসূচি ও রোগ নির্মূল: বাংলাদেশে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফলে অনেক রোগ যেমন পোলিও, টিবি, দস্তা, হাম এবং চিকুনগুনিয়া প্রভৃতি রোগ ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের পোলিও মুক্ত দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা লাভ করেছে। দেশে বাচ্চাদের জন্য দেয়া টিকা প্রায় প্রতিটি গ্রামের শিশুর কাছে পৌঁছে গেছে।

৪. ওষুধ শিল্পের অগ্রগতি: বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বর্তমানে ৯৮% অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং প্রায় ১৫০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। বিশেষ করে, ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি এই শিল্পের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে।

৫. স্বাস্থ্য তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার: ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা বর্তমানে বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। টেলিমেডিসিন, অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট, মোবাইল হেলথ অ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা আরও সহজলভ্য হয়েছে।

৬. গণস্বাস্থ্য শিক্ষা: স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতি শুধু চিকিৎসা সেবা সরবরাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং জনসচেতনা বৃদ্ধির মাধ্যমে সবার কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার বিষয়ে জনগণ এখন অনেক সচেতন এবং এই সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিষয়ক ক্যাম্পেইন ও মিডিয়ার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৭. বিশ্ববিদ্যালয় এবং চিকিৎসক প্রশিক্ষণ: বাংলাদেশে অনেক উন্নতমানের চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ,সরকারী হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বাংলাদেশের প্রথম উচ্চতর(স্নাতক) হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল বাংলাদেশের প্রথম উচ্চতর(স্নাতক) ইউনানি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইত্যাদি। এছাড়াও, বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে চিকিৎসক প্রেরণ ও উচ্চমানের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশ অনেক দক্ষ চিকিৎসক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতের মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যর্থতা

১. স্বাস্থ্যসেবার বৈষম্য: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বড় ধরনের বৈষম্য রয়ে গেছে। শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। শহরে বড় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায়, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে সঠিক সেবা এবং সুবিধা পাওয়া বেশ কঠিন। অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে সঠিক চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকায় গ্রামবাসী নাজুক অবস্থায় পড়েন।

২. চিকিৎসার অপ্রতুলতা এবং অবকাঠামোগত সমস্যা: বাংলাদেশে হাসপাতালগুলোর অধিকাংশেরই আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। এছাড়া, অনেক হাসপাতালের অবকাঠামো অত্যন্ত পুরনো এবং সেবা ব্যবস্থাও অনেক সময় সঠিকভাবে কার্যকরী হয় না। এর ফলে চিকিৎসকরা প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। শহরের বড় হাসপাতালগুলির মধ্যে উপচেপড়া রোগীর চাপের কারণে অনেক সময় সেবা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা।

৩. চিকিৎসকের অবস্থা এবং ঘাটতি: বাংলাদেশে চিকিৎসকের সংখ্যা এবং তাদের মান নিয়ে ব্যাপক সমস্যা রয়েছে। শহরের বড় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের অভাব দেখা দেয়, এবং অধিকাংশ চিকিৎসকরা তাদের পেশাগত জীবন ও পড়াশোনা শেষ করার পর বিদেশে চলে যান, যা দেশের স্বাস্থ্য খাতে এক বিরাট ঘাটতি সৃষ্টি করে। একইভাবে, কম বেতন ও খারাপ পরিবেশে অনেক চিকিৎসক কাজ করতে রাজি হন না, ফলে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

৪. হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি: সরকারি হাসপাতালগুলোর অনেক জায়গায় চিকিৎসা সেবার মান নিম্নমানের। দুর্নীতির কারণে সরকারি হাসপাতালের ওষুধ কালোবাজারে বিক্রি হয়, চিকিৎসা পেতে ঘুষ দিতে হয়, এবং রোগীদের ঠিকমতো সেবা দেওয়া হয় না।

৫. বেসরকারি হাসপাতালের বাণিজ্যিকীকরণ: বেসরকারি হাসপাতালগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। ফলে চিকিৎসার খরচ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। অনেক হাসপাতাল অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে।

৬. মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অবহেলা: বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনো উপেক্ষিত। খুব কমসংখ্যক হাসপাতাল ও চিকিৎসক মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিযুক্ত রয়েছেন। মানসিক রোগের বিষয়ে সামাজিক কুসংস্কারও সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

৭. মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণায় সীমাবদ্ধতা: দেশের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল ও সুযোগের অভাবের কারণে বাংলাদেশ চিকিৎসা ক্ষেত্রে উদ্ভাবনীমূলক গবেষণায় পিছিয়ে রয়েছে।

৮. ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের অভাব: বাংলাদেশে কিছু নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যায়। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রম ও পর্যাপ্ত মান নিয়ন্ত্রণের অভাবের কারণে অনেক সময় রোগীরা সঠিক মানের ওষুধ পায় না।

৯. রোগ নির্ণয়ের অগ্রগতি ধীরগতির: প্রায়ই রোগ নির্ণয়ের জন্য উন্নত পরীক্ষা প্রয়োজন হয়, যা দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে নেই। উন্নত ল্যাব সুবিধার অভাবে রোগ শনাক্ত করতে দেরি হয়, ফলে সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয় না।

সমাধানের উপায়

১. সরকারি স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধি: বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট জিডিপির মাত্র ২-৩%। এটি বাড়িয়ে কমপক্ষে ৫-৬% করা দরকার, যাতে সরকারি হাসপাতালগুলোর উন্নয়ন করা যায়।

২. গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন: গ্রামে পর্যাপ্ত ডাক্তার নিয়োগের জন্য প্রণোদনা দিতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করতে হবে।

৩. সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন: দুর্নীতি কমিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান উন্নত করতে হবে, যাতে মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসা পায়।

৪. বেসরকারি হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ ও নীতিমালা প্রণয়ন: বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যাতে তারা ন্যায্য মূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে।

৫. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিস্তৃত করা: প্রত্যেক জেলায় মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে এবং মানসিক রোগ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

৬. ওষুধ ও চিকিৎসা গবেষণায় বিনিয়োগ: দেশীয় গবেষণাকে উৎসাহিত করতে মেডিকেল গবেষণায় অর্থায়ন বাড়াতে হবে এবং আন্তর্জাতিক গবেষণার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে হবে।

পরিশেষ বলতে চাই, সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলতে চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও স্বাস্থ্য সহকারীদের সমন্বয়ে গঠিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়। আর উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গঠনে ব্যর্থতার কারণে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে, সেটাও সত্য। এ কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন

সরকারের অধীনে রাষ্ট্র মেরামতের সব অঙ্গের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতকে অধিকতর প্রাধান্য দেওয়া আবশ্যক। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে গভীর-পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে চলমান সংকটগুলো চিহ্নিত করা অপরিহার্য। তবে তা প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং উন্নয়নের মাধ্যমে আরও কার্যকরী ও সুদৃঢ় হতে পারে। তবে দেশের জনসাধারণের সামগ্রিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য লাগসই পরিকল্পনা ও তার দুর্নীতিমুক্ত বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। সঠিক নীতির বাস্তবায়ন, সকল স্তরের স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য সমানভাবে নিশ্চিত করা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

২০ জানুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test