E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

খাদ্যপণ্যে ভ্যাট: সাধারণ মানুষের দুঃখের আরেক অধ্যায়

২০২৫ জানুয়ারি ১৮ ১৬:৫২:২৮
খাদ্যপণ্যে ভ্যাট: সাধারণ মানুষের দুঃখের আরেক অধ্যায়

মীর আব্দুল আলীম


বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের একজোট হওয়া এবং দেশের নাগরিকদের পক্ষে কথা বলার মাঝে এক বিশাল সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যে ভ্যাট প্রত্যাহারের বিষয়টি যখন ব্যবসায়ীদের জন্য বড় দাবি হয়ে উঠছে, তখন তা সাধারণ জনগণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কলামে আমরা আলোচনা করব কীভাবে খাদ্যপণ্যে ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সরকার এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নেওয়া উচিত এবং তার জন্য কী কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসবে।

দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির বর্তমান পরিস্থিতি কি? বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থির। চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ, মাছ এবং মাংসের মতো খাদ্যপণ্যগুলোর দাম এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সাধারণ মানুষ এই পণ্যগুলি কেনার সামর্থ্য হারাতে বসেছে। এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ, যার মধ্যে অন্যতম সিন্ডিকেট ব্যবসা, আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক অস্থিরতা। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্যপণ্যে ভ্যাট প্রত্যাহার বা কমানোর দাবি ওঠা একেবারে যৌক্তিক। ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, খাদ্যপণ্যে ভ্যাট প্রত্যাহার না করা হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বেড়ে যাবে, যা ইতোমধ্যেই কষ্টকর হয়ে উঠেছে।

জনগণের দুঃখ-কষ্টের বিবেচনা চাই: আজকাল যে কোনো পণ্য কেনার সময় সাধারণ মানুষের মনে থাকে একটি প্রশ্ন "আমার পক্ষে এত দামে কেনা কি সম্ভব?" দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং খাদ্যপণ্যে অতিরিক্ত কর চাপানোর কারণে এই প্রশ্নটি আরও জটিল হয়ে উঠছে। শ্রমজীবী মানুষ, দিনমজুর, সাধারণ কর্মচারী কিংবা নিম্নআয়ের মানুষরা পণ্য কিনতে গিয়ে অক্ষম হয়ে পড়ছেন। তারা যখন চিড়া, পিয়াজ কিংবা টমেটো কিনে ঘরে ফেরেন, তখন এর মূল্য চিন্তা করে তাদের মন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। দুঃখজনক বিষয় হলো, আমাদের দেশে এখনো প্রায় ২৫% মানুষ গরিবের তালিকায় পড়ে, যারা দারিদ্র্যের কারণে জীবন ধারণ করতে সমস্যার সম্মুখীন। কেবলমাত্র সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা চিন্তা করলে নয়, ব্যবসায়ীদেরও উচিত তাদের মুনাফার দিকে তাকিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় ও দেশের দরিদ্র জনগণের পক্ষে সহানুভূতির সাথে ভাবা। ভ্যাট প্রত্যাহারের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে যদি ব্যবসায়ীদের মুনাফা সামান্য কমে যায়, তবে এই পরিমাণ ক্ষতির বিনিময়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি হতে পারে।

সিন্ডিকেট ভাঙা ও সঠিক সরবরাহের সুযোগ সৃষ্টি হউক : সরকারকে উচিত সিন্ডিকেট ভাঙার মাধ্যমে খাদ্যপণ্যের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণে সহায়তা করা। দেশের বাজারে বিভিন্ন ধরনের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা মূল্য বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো ভাঙতে হলে সরকারের তৎপরতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ এবং ব্যবসায়ীদের সহায়তায় প্রকৃত বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব। এর মাধ্যমে খাদ্যপণ্যের দাম কমানো সম্ভব, যা সরাসরি জনগণের কল্যাণে আসবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতা চালু থাকলে দাম কমে যাবে এবং এক্ষেত্রে মুনাফার হার কিছুটা কমলেও সরবরাহে কোনো অভাব হবে না। এই অবস্থায় সরকার যদি খাদ্যপণ্যের উপর ভ্যাট প্রত্যাহার করে, তাহলে বাজারে মূল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং সাধারণ মানুষ সুবিধা পাবেন।’

রোজার মাসের প্রভাব: পবিত্র রমজান মাস সামনে আসছে। এই সময়ে, সাধারণ মানুষ খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি আর সহ্য করতে পারবে না। দেশে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায়, রোজার মাসে সবার খাদ্য প্রয়োজনীয়তা বেশি হয়ে থাকে। এমন সময় যদি খাদ্যপণ্যের দাম না কমানো হয় এবং ভ্যাট প্রত্যাহার না করা হয়, তবে জনগণের জীবনযাত্রা আরো কঠিন হয়ে উঠবে। এতে শুধু হতাশা বাড়বে না, বরং সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। দ্রব্যমূল্যের সঙ্কট যত বাড়বে, ততই কষ্টে পড়বে দরিদ্র জনগণ, যারা ইতিমধ্যেই পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। এ কারণে সরকারকে রোজা মাসের আগে জরুরি ভিত্তিতে খাদ্যপণ্যের উপর ভ্যাট প্রত্যাহারের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে, ব্যবসায়ীদের একজোট হয়ে এই সিদ্ধান্তে সাহায্য করা উচিত, যাতে সরকারকে সহায়তা করা যায় এবং জনগণের কষ্ট কমানো সম্ভব হয়।

খাদ্যপণ্যে ভ্যাট আরোপ আর্থিক লাভ বনাম আস্থা সংকট : বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রাষ্ট্রের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে ভ্যাট বা মূসক। এটি সরকারের ব্যয় মেটানোর ক্ষেত্রে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। তবে খাদ্যপণ্যের মতো মৌলিক প্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট আরোপ করলে আর্থিক লাভের বিপরীতে সরকারের ওপর জনআস্থার সংকট তৈরি হতে পারে। এ বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

আর্থিক লাভের দিকগুলো কি

১. রাজস্ব বৃদ্ধি: খাদ্যপণ্যে ভ্যাট আরোপ করলে সরকারের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এ রাজস্ব উন্নয়ন প্রকল্প, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাখাতে ব্যয় করা সম্ভব।

২. অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: ভ্যাট আরোপ খাদ্যপণ্যের অতিরিক্ত মজুতদারি ও অপ্রয়োজনীয় ভোগ কমাতে সহায়ক হতে পারে।

৩. বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: অনেক উন্নত দেশেও খাদ্যপণ্যে ভ্যাট আরোপ একটি সাধারণ বিষয়। এ ধরনের নীতি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় বৈশ্বিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের সঙ্গতি আনে।

আস্থা সংকটের দিক

১. খাদ্যপণ্যে ভ্যাট আরোপ করলে বাজারে মূল্যবৃদ্ধি অনিবার্য। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

২. সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে পারে। ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে আয়ের পার্থক্য আরও বেড়ে যেতে পারে। দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রার মান হ্রাস পাবে।

৩. সাধারণ জনগণ খাদ্যপণ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে দেখে। এ ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপকে অমানবিক ও জনবিরোধী নীতি হিসেবে গণ্য করা হতে পারে। তাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সম্ভাভনা রয়েছে।

৪. রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। মূল্যবৃদ্ধি জনবিক্ষোভ বা সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে, যা সরকারের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করবে।

বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি

সরকার যদি খাদ্যপণ্যে ভ্যাট আরোপ করতেই চায়, তবে জনআস্থার সংকট এড়াতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত-

১. স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণ: ভ্যাট আরোপের পাশাপাশি নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি বা রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা।

২. সচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণকে বোঝাতে হবে ভ্যাট আরোপের যৌক্তিকতা এবং এর মাধ্যমে কীভাবে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

৩. ভ্যাটের হার নির্ধারণে সংযম: মৌলিক খাদ্যপণ্যে অত্যন্ত কম হারে ভ্যাট আরোপ করা, যাতে নিম্নবিত্ত শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

৪. পরিচালনায় স্বচ্ছতা: ভ্যাট থেকে অর্জিত অর্থ জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় হচ্ছে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং এর বিষয়ে জনগণকে অবহিত করতে হবে।

খাদ্যপণ্যে ভ্যাট আরোপ সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। তবে এটি এমনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে আর্থিক লাভের পাশাপাশি জনআস্থা অটুট থাকে। সরকারকে জনগণের অনুভূতি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। অন্যথায় সাময়িক আর্থিক লাভের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে, যা জাতির সামগ্রিক অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

সরকারি ও ব্যবসায়িক সম্পর্কের সুসংহত প্রস্তাবনা: গণমানুষের কষ্ট ও অসুবিধার কথা মাথায় রেখে, একযোগীভাবে কাজ করা সরকারের দায়িত্ব। তবে এটাও লক্ষ্যণীয় যে, সরকারের একক পদক্ষেপ কোনোভাবেই ব্যবসায়ী মহলকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। তাই সরকারের পক্ষ থেকে সঠিকভাবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা এবং তাদের উদ্বেগের সঠিক সমাধান দেওয়ার প্রচেষ্টা হওয়া উচিত। সামনে রোজা আসছে, তাই ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারকে অবশ্যই খাদ্যপণ্যে ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে। এতে করে দেশের দরিদ্র জনগণের কষ্ট কিছুটা কমে যাবে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।

খাদ্যপণ্যে ভ্যাট প্রত্যাহার একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দাবি, যা সাধারণ জনগণের জন্য দারুণ সহায়ক হতে পারে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং রোজার মাসের পীড়াদায়ক পরিস্থিতির মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্য কমানোর জন্য সরকারের সহায়তা খুবই প্রয়োজনীয়। ব্যবসায়ীদের মুনাফার ক্ষতি না করে সরকারের উচিত জনগণের কষ্ট লাগাতে উদ্যোগী হওয়া। শুধু তখনই আমরা দেখতে পাবো একটি সুবোধ, সুখী এবং সহায়ক সমাজের সূচনা, যেখানে মানুষ নিরাপদে এবং শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারবে।

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

২০ জানুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test