E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

বিদেশে প্রবাসী জীবন, যন্ত্রণার মাঝে স্বপ্নের খোঁজ

২০২৫ জানুয়ারি ১০ ১৭:২৯:০৮
বিদেশে প্রবাসী জীবন, যন্ত্রণার মাঝে স্বপ্নের খোঁজ

মীর আব্দুল আলীম


৯ জানুয়ারি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নরওয়ের চারজন এবং বাংলাদেশের এক প্রবাসী নাগরিককে হেনস্তা করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনকে মারধর করে রক্তাক্ত করা হয়েছে। বিমানবাহিনীর কুইক রেসপন্স ফোর্স (কিউআরএফ) এবং আনসার বাহিনীর সদস্যরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রায়শই বিমানবন্দরে এমন ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশী প্রবাসী এবং নরওয়ের নাগরিকদের উপর ঘটে যাওয়া হেনস্তার এ ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং তা আন্তর্জাতিক মান ও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার একটি বড় কারণ। এই ধরনের ঘটনা শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য নয়, বিদেশি নাগরিকদের জন্যও অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে, যা দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

এ ধরনের ঘটনার মূল কারণ কী তা নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। বেশিরভাগ সময়, এই ধরনের সহিংসতার পেছনে অসংগতিপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যবস্থা, অদক্ষ কর্মীদের আচরণ, বা ভুল বোঝাবুঝি থাকতে পারে। তবে, এটি একটি চরম দৃষ্টান্ত, এবং এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটলে দেশের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা, কর্মকর্তাদের আচরণ এবং প্রশিক্ষণের ঘাটতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা, যাতে তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেন এবং আন্তর্জাতিক মানের পরিসেবা নিশ্চিত করেন। এই ধরনের ঘটনা চলতে থাকলে দেশের ইমেজ, পর্যটন খাত, এবং বিদেশি নাগরিকদের প্রতি বিশ্বাস নষ্ট হতে পারে। এই ধরনের ঘটনা যদি প্রতিকার না পায়, তবে এটি শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের নয়, বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সুনামকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। দেশের ভাবমূর্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে এ ধরনের ঘটনার প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু বিমানবন্দর নয় প্রবাসীরা প্রতিপদেই নানা কষ্টের মুখমুখী হন। এসব বিষয় নিয়ে নিচে আলোচনা জরুরী। প্রবাস জীবন, একটি শব্দ হলেও এর অন্তর্নিহিত অর্থ বহু বিস্তৃত। এটি শুধুমাত্র দূর-দেশে বসবাস নয়; বরং এটি ত্যাগের এক অনন্য রূপ। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমায়। তাদের মধ্যে কেউ শ্রমিক, কেউ পেশাজীবী, আবার কেউ উদ্যোক্তা। এরা সবাই স্বপ্ন দেখে পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর, নিজের এবং দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার। তবে প্রবাস জীবন মোটেও সহজ নয়। এটি একদিকে সম্ভাবনার যেমন দ্বার উন্মোচন করে, অন্যদিকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ আর কষ্টের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলতে হয় একজন প্রবাসিকে।

প্রবাসীদের জীবন শুধু তাদের ব্যক্তিগত সংগ্রামের নয়; বরং এটি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন। তাদের কঠোর পরিশ্রম, আত্মত্যাগ, এবং অর্থনৈতিক অবদান দেশের অর্থনীতির স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। তবে সমাজ তাদের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে এবং তারা যে অবিচার ও বৈষম্যের শিকার হন, তা গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে।

প্রবাস জীবনের কষ্ট ও ত্যাগ : একজন প্রবাসী যখন নিজের ঘরবাড়ি, স্বজন, এবং চেনাজানা পরিবেশ ছেড়ে বিদেশে যান, তখন তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এই অধ্যায় শুধুমাত্র কাজ বা অর্থ উপার্জনের নয়, বরং এটি এক ধরনের সংগ্রাম। ভাষাগত সমস্যা, সংস্কৃতিগত ভিন্নতা, এবং নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ প্রবাসীদের জন্য দৈনন্দিন বাস্তবতা। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এবং ইউরোপের মতো অঞ্চলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। নির্মাণশিল্প, পরিচ্ছন্নতা, কৃষি, এবং গৃহপরিচারিকার মতো পেশাগুলিতে তারা দিনরাত খেটে যান। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, প্রতিকূল আবহাওয়া, এবং অনিরাপদ কাজের পরিবেশে অনেক সময় তারা তাদের স্বাস্থ্যের ওপর চরম প্রভাব ফেলেন। এখানে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক কষ্টও তাদের নিত্যসঙ্গী। প্রিয়জনদের থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণা, পরিবারের প্রয়োজন পূরণের চাপ, এবং কখনো কখনো প্রবাসে নির্দিষ্ট সুযোগ-সুবিধার অভাব তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবু তারা নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে দেশ ও পরিবারের জন্য কাজ করে যান।

পরিবারের প্রত্যাশা এবং প্রবাসীদের বাস্তবতা

প্রবাসীদের সঙ্গে সমাজের একটি সাধারণ মনোভাব হলো, তারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন এবং তাদের জীবন বিলাসবহুল। এটি প্রবাসীদের প্রতি একটি গভীর অন্যায় ধারণা। বাস্তবতা হলো, তাদের উপার্জনের একটি বড় অংশ পরিবারের খরচ, ঋণ পরিশোধ, এবং ভবিষ্যৎ বিনিয়োগে চলে যায়। অনেক সময় প্রবাসীরা পরিবারের প্রত্যাশার ভারে চাপা পড়েন। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন সবার আর্থিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে তারা নিজের প্রয়োজনগুলোকে তুচ্ছ করে দেন। কখনো কখনো তাদের পাঠানো অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার না হওয়ার কারণে, তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। জমি কেনা বা ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য পাঠানো অর্থের অপব্যবহার কিংবা আত্মীয়দের দ্বারা প্রতারণার শিকার হওয়ার ঘটনাও খুব সাধারণ। ফলে প্রবাস থেকে ফিরে এসে তারা নিজেদের নিঃস্ব অবস্থায় আবিষ্কার করেন।

সাংসারিক জীবনের জটিলতা

প্রবাস জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর প্রভাব সাংসারিক জীবনে। একজন প্রবাসী যখন দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে থাকেন, তখন তার ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো দূরে সরে যেতে শুরু করে। অনেক সময় তাদের স্ত্রী, সন্তান বা অন্যান্য নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়।অনেক প্রবাসী অভিযোগ করেন যে, তাদের স্ত্রীরা দীর্ঘ অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে অন্যত্র সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এটি শুধু সাংসারিক জীবনে বিভাজনই সৃষ্টি করে না, বরং একজন প্রবাসীর মানসিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাকেও নষ্ট করে দেয়। সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এই দূরত্ব প্রভাব ফেলে। বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার পেছনে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ভূমিকা অপরিসীম। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বৈদেশিক রেমিটেন্স দেশের মোট জিডিপির ৭%-এর বেশি। তারা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতি মজবুত করে তুলছেন। তবে এই রেমিটেন্স যোদ্ধারা প্রায়ই উপেক্ষিত হন। দেশে ফেরার সময় বিমানবন্দরে হয়রানি, অযথা জিজ্ঞাসাবাদ, কিংবা দুর্ব্যবহারের শিকার হওয়া তাদের নিত্যদিনের ঘটনা। ২০২৫ সালের ৯ জানুয়ারি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীদের লাঞ্ছনার ঘটনা তারই একটি উদাহরণ। তাদের কষ্টের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ, তারা দেশের উন্নয়নের একটি প্রধান চালিকাশক্তি।

প্রবাসীদের প্রতি আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা জরুরি। তাদের আত্মত্যাগ এবং কষ্টের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

১. সম্মানজনক ব্যবহার: বিমানবন্দরসহ দেশের প্রতিটি সেক্টরে প্রবাসীদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করা উচিত।

২. অর্থনৈতিক সুরক্ষা: প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা প্রয়োজন।

৩. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা: প্রবাসীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে বিশেষায়িত সেবা চালু করা উচিত।

৪. পরিবারের সচেতনতা বৃদ্ধি: প্রবাসীদের পরিবারকে তাদের কষ্ট ও ত্যাগ সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করা জরুরি।

৫. রেমিটেন্স ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন: ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আরো সহজ এবং কার্যকর করার মাধ্যমে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানো প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও ঝামেলামুক্ত করতে হবে।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রবাসীরা যে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান, তা দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (এউচ)-এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। তারা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে রেমিটেন্স প্রবাহ ছিল প্রায় ২,৫০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির ৭-৮%। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি কর্মীরা এই রেমিটেন্স পাঠান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো (যেমন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার) থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা সাধারণত নির্মাণশ্রমিক, গৃহপরিচারক, এবং অন্যান্য নিম্নআয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কানাডার মতো দেশগুলো থেকে উচ্চ আয়ের পেশাজীবীরা (যেমন ডাক্তার, প্রকৌশলী, বা ব্যবসায়ী) উল্লেখযোগ্য রেমিটেন্স পাঠান।

দেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্সের ভূমিকা অপরিসীম। রেমিটেন্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এই রিজার্ভ দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, এবং মুদ্রার স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়। রেমিটেন্সের একটি বড় অংশ সরাসরি গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রবাহিত হয়। গ্রামীণ অঞ্চলের পরিবারগুলো প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দিয়ে তাদের জীবনমান উন্নত করে। এই অর্থ ব্যবহার করে তারা বাড়িঘর নির্মাণ, সন্তানদের শিক্ষা, এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারে। রেমিটেন্স দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে। অনেক প্রবাসী তাদের সঞ্চিত অর্থ দেশে ব্যবসা বা ছোট উদ্যোক্তা প্রকল্পে বিনিয়োগ করেন। এটি স্থানীয় অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান এবং আয়ের সুযোগ তৈরি করে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রেমিটেন্স সরাসরি দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক। এটি দরিদ্র পরিবারগুলোকে আর্থিক স্থিতিশীলতা দেয় এবং তাদের জীবনযাত্রার মান বাড়ায়।

প্রবাস জীবন এটি একটি শব্দ বা ধারণা হলেও এর পেছনে লুকিয়ে থাকে একেকটি গল্প। গল্পগুলো প্রায়ই ত্যাগ, কষ্ট, পরিশ্রম, এবং ভালোবাসার। বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায় নিজেদের জীবনের মানোন্নয়নের জন্য কিংবা পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করতে। কিন্তু প্রবাস জীবনের এই যাত্রা মোটেও সহজ নয়। প্রবাসীরা একদিকে কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেন, অন্যদিকে পারিবারিক, সামাজিক এবং মানসিক চাপে জর্জরিত হন। একজন প্রবাসীকে নিজের পরিচিত পরিবেশ, পরিবার, এবং বন্ধুবান্ধব ছেড়ে চলে যেতে হয় একটি অচেনা দেশে। যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি, এবং জলবায়ু তার জন্য নতুন এবং অনেক সময় প্রতিকূল। সেখানে টিকে থাকতে হলে তাকে নতুন করে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। প্রবাসীরা অনেকেই শারীরিক পরিশ্রম নির্ভর কাজ করেন, যা অত্যন্ত কঠিন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করেও অনেকে ন্যায্য মজুরি পান না। অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হন।

শুধু শারীরিক নয়, মানসিক চাপও প্রবাসীদের জীবনের একটি বড় অংশ। পরিবার-পরিজনের থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, এবং কখনো কখনো নির্দিষ্ট সময়ে অর্থ পাঠাতে না পারার চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাদের অনেকেই বিষণ্ণতায় ভোগেন, কিন্তু এর জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক সেবা পাওয়া তো দূরের কথা, তাদের কষ্টগুলোও কেউ বোঝে না।

পরিবারের প্রত্যাশা ও বাস্তবতা : প্রবাসীদের জীবন নিয়ে একটি সাধারণ ভুল ধারণা হলো, তারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। পরিবার এবং সমাজের অনেকেই তাদের “টাকার গাছ” হিসেবে মনে করেন। কিন্তু প্রবাসীদের উপার্জনের পেছনে যে সীমাহীন পরিশ্রম লুকিয়ে থাকে, সেটি কেউ ভাবে না। অধিকাংশ প্রবাসী তাদের উপার্জিত অর্থ পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য খরচ করেন। বাবা-মা, ভাই-বোনের চাহিদা পূরণে তারা নিজেদের প্রয়োজনগুলো ত্যাগ করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রবাসীরা অনেক সময় পরিবার থেকে প্রতারণার শিকার হন। একজন প্রবাসী তার উপার্জনের টাকা জমি কেনা বা ব্যবসার জন্য পাঠান। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন সেই টাকা যথাযথভাবে ব্যবহার হয়নি। অনেকে তো নিজেদের সঞ্চিত অর্থ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান।

সাংসারিক জীবনে প্রবাসীদের কষ্টের গল্প : প্রবাসীদের আরেকটি বড় কষ্ট হলো তাদের সাংসারিক জীবনের জটিলতা। প্রবাসে থাকার কারণে অনেক সময় তাদের স্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। কিছু ক্ষেত্রে স্ত্রীরা অন্যত্র সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যা একজন প্রবাসীর জীবনে চরম ধাক্কা হয়ে আসে। শুধু তাই নয়, সন্তানদের সঙ্গেও তাদের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়, কারণ সন্তানের শৈশব বা কৈশোরের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রবাসীরা তাদের পাশে থাকতে পারেন না।

প্রবাসীদের অবদান এবং অসম্মান : প্রবাসীরা যখন ছুটিতে দেশে আসেন, তখনও তারা হয়রানির শিকার হন। বিশেষ করে বিমানবন্দরে লাঞ্ছনা, ঘুষ এবং দুর্ব্যবহার তাদের জন্য নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৯ জানুয়ারি, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যে ঘটনা ঘটেছে, তা শুধুই একটি উদাহরণ। এসব লাঞ্ছনার কারণে প্রবাসীদের মনোবল ভেঙে যায়। অথচ দেশের জন্য তাদের এই ত্যাগ ও অবদানকে সম্মান জানানো উচিত। গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রভাব ফেলে। রেমিটেন্সের একটি বড় অংশ সরাসরি গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রবাহিত হয়। গ্রামীণ অঞ্চলের পরিবারগুলো প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দিয়ে তাদের জীবনমান উন্নত করে। এই অর্থ ব্যবহার করে তারা বাড়িঘর নির্মাণ, সন্তানদের শিক্ষা, এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারে।

রেমিটেন্স দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে। অনেক প্রবাসী তাদের সঞ্চিত অর্থ দেশে ব্যবসা বা ছোট উদ্যোক্তা প্রকল্পে বিনিয়োগ করেন। এটি স্থানীয় অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান এবং আয়ের সুযোগ তৈরি করে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রেমিটেন্স সরাসরি দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক। এটি দরিদ্র পরিবারগুলোকে আর্থিক স্থিতিশীলতা দেয় এবং তাদের জীবনযাত্রার মান বাড়ায়। রেমিটেন্সের কারণে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরতা কমে যায়। এটি রাষ্ট্রকে আরো স্বাধীনভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করে।

তবুও প্রবাসীদের অবদান উপেক্ষিত কেন? তাদের এত বড় অবদান থাকা সত্ত্বেও, প্রবাসীদের প্রাপ্য সম্মান এবং সুবিধা প্রদান করা হয় না। দেশে ফেরার সময় তারা বিমানবন্দর থেকে শুরু করে নানা জায়গায় হয়রানির শিকার হন। তাদের কষ্ট এবং ত্যাগের সঠিক মূল্যায়ন হয় না।

রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য প্রবাসীদের যৌক্তিক সুবিধা প্রদান রাষ্টের দ্বায়িত্ব বটে। প্রবাসীদের জন্য কি করা উচিত?

১. ব্যাংকিং প্রক্রিয়া সহজীকরণ: প্রবাসীদের জন্য রেমিটেন্স পাঠানোর প্রক্রিয়া আরো সহজ, সাশ্রয়ী, এবং দ্রুত করতে হবে।

২. প্রণোদনা বৃদ্ধি: সরকার প্রবাসীদের জন্য রেমিটেন্স প্রেরণে প্রণোদনা বাড়িয়ে দিতে পারে, যেমন লেনদেনের ফি কমানো বা কর সুবিধা প্রদান।

৩. সুরক্ষা নিশ্চিত করা: প্রবাসী শ্রমিকদের কাজের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং তাদের বৈধ অধিকার রক্ষায় শক্তিশালী কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।

৪. বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি: প্রবাসীদের সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় প্রকল্প তৈরি করতে হবে। যেমন, প্রবাসীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা যেতে পারে।

প্রবাসী জীবন কেবল কষ্টের গল্প নয়, এটি ত্যাগ, সংগ্রাম, এবং দেশপ্রেমের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাদের পাঠানো অর্থে দেশের অর্থনীতি মজবুত হয়, কিন্তু তাদের নিজস্ব জীবন হয় প্রায়শই নিঃস্ব এবং কষ্টকর। আমাদের দায়িত্ব হলো তাদের কষ্টগুলো বোঝা, তাদের ত্যাগকে স্বীকৃতি দেওয়া, এবং তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা। প্রবাসীদের সম্মানিত করা মানে শুধু তাদের নয়, দেশের ভবিষ্যৎকেই সম্মানিত করা। প্রবাসীরা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতির নীরব নায়ক। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের প্রতি দায়িত্বশীল এবং সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সবার রাখা উচিত। প্রবাসীদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

১৪ জানুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test