E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট: বাংলাদেশের টিকে থাকার লড়াই

২০২৫ জানুয়ারি ০৭ ১৬:৫১:১১
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট: বাংলাদেশের টিকে থাকার লড়াই

মীর আব্দুল আলীম


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো বর্তমানে গভীর সংকটের মুখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের অভাব, এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রাকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে গিয়ে আর্থিক কষ্টে ভুগছে। শ্রমজীবী মানুষের অভিযোগ, আয় দিয়ে ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। জীবনযাত্রার এই অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

চাল, চিনি, তেল, মাছ, মাংস, ডাল এবং পেঁয়াজের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ডিসেম্বর ২০২৪-এ মূল্যস্ফীতির হার ৯.৪৭ শতাংশে পৌঁছেছে। যদিও বেসরকারি পর্যবেক্ষকরা মনে করেন প্রকৃত হার আরও বেশি। টাকার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, এবং আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।

শ্রমজীবী মানুষের অভিযোগ আরও গভীর। জাতীয় দৈনিকের এক প্রতিবেদনে একজন রিকশাচালক বললেন, "চাল-তেলের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে আয় দিয়ে ব্যয় মেটানো অসম্ভব।" অন্যদিকে, চা বিক্রেতা আরিফুলের মতো মানুষও বলেন, "দিনের শেষে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালানো যায় না।"

বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব অর্থনীতি একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং মুদ্রাস্ফীতি—এগুলো মিলে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। যদিও বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে, সামগ্রিকভাবে সুসংবাদ খুবই কম।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। খাদ্যশস্য ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের মতো আমদানি-নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো এসব বৈশ্বিক সংকটের সরাসরি শিকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ২৪.৪৭ বিলিয়ন ডলার, যা বিগত সালের তুলনায় ৪৫ শতাংশ কম। ২০২৪ ও রিজার্ভ নামতে শুরু করে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে রিজার্ভের পরিমাণ ২৬.০৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। তবে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ মানদণ্ড অনুযায়ী নিট রিজার্ভের পরিমাণ ২১.৩৩ বিলিয়ন ডলার। এদিকে, দেশের ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ বর্তমানে ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এ সময় রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে রেমিট্যান্স প্রবাহের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এবং দাতা সংস্থার ঋণ ও অনুদানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২৮ দিনে দেশে বৈধ পথে ২৪২ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে, যা রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ার পর ২০২৪ সালে তা পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক সংকেত। যা কিনা কিছুটা আসার আলো দেখায়।

দেশের অর্থনীতির জন্য সুসংবাদ যে নেই, তা ঠিক নয়। তবে সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশ্ব নেতাদের উচিত হবে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়োগ করা। একই সাথে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি এবং পরিবেশ রক্ষার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সঠিক নীতিমালা এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। নতুবা, বর্তমান পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠতে পারে।

বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রভাব বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে আরও বেশি প্রকট হবে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃষিখাতের উন্নয়নই প্রধান সমাধান হতে পারে। দেশের প্রায় ২০ শতাংশ জমি এখনো অনাবাদী। এই জমিগুলোকে চাষের আওতায় আনতে হবে।

২০২৪ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষিখাতে কর্মসংস্থানের হার ১০ বছর আগের তুলনায় ৪ শতাংশ কমেছে। অথচ এই খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করার অনেক সুযোগ রয়েছে। পোলট্রি, মাছ চাষ, দুগ্ধ উৎপাদন এবং সবজি চাষের মতো উদ্যোগগুলো গ্রামের অর্থনীতি চাঙা করতে পারে।কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ফসলের সঠিক সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে কৃষিপণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে।

দেশের শিল্প খাত বর্তমানে চরম বিপদের মুখে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে মন্দা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (EPB) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এর ফলে বহু ছোট ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কারখানাগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। এতে শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (BGMEA) তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে প্রায় ৩০ হাজার পোশাক শ্রমিক কাজ হারিয়েছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি নতুন কর্মজীবী যোগ হচ্ছে। অথচ তাদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। ২০২৪ সালে সরকারি একটি বিভাগে মাত্র ৪০০ পদের জন্য আবেদন জমা পড়েছিল ১২ লাখ। তাতে বুঝা যায় বেকারের সংখ্যা কত বেড়েছে।

ঢাকার বাড্ডা, গুলিস্তান, এবং শ্যামলীর মতো এলাকায় প্রতিদিন শত শত দিনমজুর কাজের সন্ধানে বসে থাকেন। তাদের বেশিরভাগই কাজ না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যান।

বেকার সমস্যা দূরীকরণসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কী করতে হবে?

১. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি: অনাবাদী জমি চাষের আওতায় আনা। ক্ষুদ্র কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া। উন্নত প্রযুক্তি ও সেচ ব্যবস্থা চালু করা।

২. শিল্পখাতের পুনর্গঠন: গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো।পোশাক শিল্পে নতুন বাজার খুঁজে বের করা।

৩. কর্মসংস্থান সৃষ্টি: সরকারি ও বেসরকারি খাতে দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া।বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা।

৪. দাম নিয়ন্ত্রণ: বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে কঠোর নজরদারি। অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমিয়ে দেশীয় উৎপাদনে জোর দেওয়া।

৫. সামাজিক সুরক্ষা: দরিদ্র মানুষের জন্য ভর্তুকি এবং রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা।সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধি করতে হবে।

অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের দিশা কি? বাংলাদেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বর্তমানে এক গভীর সংকটে দিন পার করছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে কৃষি ও শিল্পখাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের হাতে আয় নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এবং বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করতে হবে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, সঠিক নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। তা না হলে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনের চাকা একসময় পুরোপুরি থেমে যেতে পারে। সংকট যত গভীরই হোক, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা উত্তরণের পথ খুঁজে পেতে পারি।

লেখক : সাংবাদিক ও সমাজ গবেষক, মহাসচিব -কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

০৮ জানুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test